দেশজুড়ে

মাজারের বাইরে গান করে বদলে যাচ্ছে নাজমার জীবন

ইংরেজ কবি জন মিল্টন, গ্রিক কবি হোমার, ফার্সি কবি রোদাকী, মিশরের বিশিষ্ট লেখক তাহা হুসাইনরার দৃষ্টিহীনতাকে জয় করে সাফল্যের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছার আদর্শ ধারণ করেই এগিয়ে যাচ্ছে গাজীপুরের শ্রীপুরের দৃষ্টিহীন নাজমা। সকলের কাছেই অনুকরণীয় নাজমা বেগম। তার কাছে যেন কোনো কিছুই আজ অসাধ্য নয়।

Advertisement

সময়টা ২০০৪ সাল। বাবা বারেক মিয়া এলাকার কিছু লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে মেয়ের দৃষ্টি ফেরার আশায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কেল্লার মাজারের বাৎসরিক ওরসে নিয়ে যান তার দৃষ্টিহীন শিশু কন্যা নাজমা বেগমকে। সেখানে কিছু লোকের অনুরোধে গান ধরেন শিশু কন্যা নাজমা, ছোট্ট একটি জটলা তৈরি হয়।

এরই মধ্যে এগিয়ে আসেন মঞ্জু সমাদ্দার নামে এক ভদ্রলোক। দৃষ্টিহীন নাজমার প্রতিভা ধরা দেয় তার কাছে। দৃষ্টিহীন নাজমাকে একটি মিশনারিজ স্কুলে ভর্তি করার প্রস্তাব রাখেন বাবা বারেক মিয়ার কাছে। কথা শুনে অবাক বারেক মিয়া। দৃষ্টিহীনরা কী পড়তে পারে! বাড়িতে এসে সংসারের অভাব ও দারিদ্রতা কথা চিন্তা করে দৃষ্টিহীন নাজমাকে তুলে দেন মঞ্জু সমাদ্দারের হাতে। তাকে ঢাকার একটি মিশনারিজ স্কুলে ভর্তি করান। শুরু হয় নাজমার আলোকিত জীবনের নতুন এক অধ্যায়।

দৃষ্টিহীনতাকে পরাজিত করে নাজমা একে একে প্রাথমিক সমাপনী, জুনিয়র সার্টিফিকেট এবং সবশেষ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট পরীক্ষায় জিপিএ ৪.৬৩ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়। এখন উচ্চ শিক্ষার আশায় মাওনা পিয়ার আলী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের মানবিক বিভাগের একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছেন।

Advertisement

এক ভাই, দুই বোন, বাবা ও মাকে নিয়ে নাজমাদের বাড়ি গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলার মাওনা ইউনিয়নের সিংদীঘী গ্রামে। বাবা এক সময় কাঁচামাল বিক্রির ব্যবসা করলেও এখন আর কাজ করতে পারেন না। অনেক কষ্ট করে সন্তানদের লেখা করাচ্ছেন। আর নাজমার ভর্তির পর তাকে কলেজের পক্ষ থেকে সকল ধরনের সহযোগিতা করে যাচ্ছেন শিক্ষকরা। আর সহপাঠীরা নাজমাকে বাড়ি থেকে কলেজে আনা নেওয়ায় সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেন।

কলেজে ভর্তির পর নাজমাকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত তার শিক্ষক ও সহপাঠীরা। তাদের দাবি নাজমা খুবই মেধাবী। অন্য শিক্ষার্থীরা যেখানে বইপত্র নিয়ে শ্রেণি কক্ষে আসেন সেখানে নাজমার ভরসা শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের পাঠদান শোনা। প্রতিদিন সকল ক্লাসের প্রথম সারিতে থাকে নাজমার উপস্থিতি। একবার একটি বিষয় শুনলেই তা ধারণ করেন নিজের হৃদয়ে। স্মৃতি ধরে রাখার শক্তিও প্রখর।

ছোটবেলা থেকে দৃষ্টিহীনদের সঙ্গে ব্রেইল পদ্ধতি ও শ্রুতিলেখকের মাধ্যমে পড়াশোনা করলেও এখন উচ্চ মাধ্যমিকে এসে নতুন অভিজ্ঞতায় পড়েছে নাজমা। এখানে শুধু নাজমা একাই দৃষ্টিহীন। শ্রেণিকক্ষের বাইরে দৃষ্টিহীনদের পড়াশোনার আরেক মাধ্যম রিডারের ব্যবস্থা না থাকায় অনেকটা প্রতিবন্ধকতায় রয়েছে নাজমা। তবে তার ধারণা তিনি সকল প্রতিবন্ধকতা জয় করে সাফল্যের শিখরে পৌঁছবেন।

গান পাগল নাজমা

Advertisement

জন্মের পর থেকে রেডিও টেলিভিশনে গানের শব্দ হলে থেমে যেতেন নাজমা। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গানের প্রতি আসক্তি আরো বেড়ে যায়, শুরু হয় গান গাওয়া। অভাব আর দারিদ্র্যতার কারণে কোনো ওস্তাদের কাছে গানের তালিম নিতে পারেনি। শুনে শুনে গান গায় সে। স্কুল প্রতিযোগিতায় দুই বার গান গেয়ে সেরা হওয়ার অভিজ্ঞতাও রয়েছে দৃষ্টিহীন নাজমার। এখন তার গানের প্রতিভা ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন এলাকায়।

দেশাত্মবোধক, নজরুলগীতি, রবীন্দ্র সংগীতে রয়েছে তার ব্যাপক আগ্রহ। কারো সহযোগিতা পেলে গানের কোনো ওস্তাদের নিকট তালিম নিতে চায় সে।

নাজমার স্বপ্ন আইনজীবী হওয়া

নাজমার মনের ভিতর শুরু হয়েছে স্বপ্নের বীজ বোনা। তার মনের লালিত স্বপ্ন অনুযায়ী সে লেখাপড়া করে আইনজীবী পেশাকে বেছে নিতে চায়। এলাকার অসহায় মানুষ যারা আইনের সহযোগিতা থেকে দূরে তাদের পক্ষে দাঁড়িয়ে একজন দৃষ্টিহীন হিসেবে এ পেশাকে জয় করতে চান।

নাজমার বাবা বারেক মিয়া বলেন, সে মায়ের গর্ভ থেকে ইভিটামিন 'ই'র অভাবে দৃষ্টিহীন হিসেবে জন্মগ্রহণ করে। পরে সংসারে অভাব ও দারিদ্র্যতার কারণে তাকে ভালো চিকিৎসা করাতে পারেননি। তবে নাজমা ছোটকাল থেকেই খুবই মেধাবী। একটি বিষয় একবার শুনলেই সে স্মরণ রাখতে পারে। আগে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হিসেবে নাজমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকলেও এখন তাকে নিয়ে আশায় বুক বেঁধেছি।

পিয়ার আলী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আহমেদুল কবির বলেন, সারাদেশে স্কুল পর্যায়ে যখন বিনামূল্যে বই বিতরণ আনন্দ একযোগে উপভোগ করে তখন দৃষ্টিহীন নাজমারা এ আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়। তাদের জন্য সরকারের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। নাজমা খুবই মেধাবী, পড়াশোনার প্রতি তার প্রচণ্ড আগ্রহ।

তবে শ্রেণিকক্ষের বাইরে পড়াশোনার ব্যবস্থা না থাকায় পুরোপুরি ক্লাসে শিক্ষকদের পাঠদানের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে তাকে। কলেজের পক্ষ থেকে নাজমার ক্লাস ও মাসিক পরীক্ষার জন্য শ্রুতি লেখকের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমরা আন্তরিকভাবে নাজমার পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি।

পিয়ার আলী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অধ্যক্ষ একেএম আবুল খায়ের বলেন, নাজমার কলেজের যাবতীয় খরচ মওকুফ করা হয়েছে। নাজমার দৃষ্টি ফেরাতে ভাল চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া হবে।

আমিনুল ইসলাম/এফএ/আই্আই