দেশজুড়ে

কারিগরি প্রশিক্ষণ পেয়ে মূল স্রোতে শেরপুরের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী

শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান্তঘেঁষা দুর্গম পাহাড়ে ছোট-বড় টিলায় ঘেরা নিভৃত গ্রাম দাওধারা। গ্রামটিতে নাগরিক সুবিধা কমবেশি পৌঁছলেও শিক্ষার আলো খুব একটা পৌঁছেনি। মান্ধাতা আমলের নেতিবাচক চিন্তাভাবনা নিয়ে এখানে বসবাস বেশ কয়েকটি হাজং পরিবারের। রয়েছে বেশ কিছু গারো সম্প্রদায়ও। যারাা এখনও কৃষি জমিতে হালচাষ, পাহাড়ে কাঠ কেটে কিংবা লাকড়ি সংগ্রহ করে জীবনজাপন করছেন।

Advertisement

আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল থাকায় বেশিরভাগ পরিবারের শিশুরা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। তবে এ অবস্থা থেকে একটু আলাদা চিন্তা করতেন সুকুমার হাজং। তার ইচ্ছা ছিল যত কষ্টই হোক সন্তানদের শিক্ষিত করবেন। সেখানেও বাধা হয়ে দাঁড়ায় আর্থিক অস্বচ্ছলতা। মেয়ে শান্তা হাজং (২০) এসএসসি পাস করার পর থেমে যায় তার কলেজে ভর্তি হওয়া। হতাশ শান্তা হাজংও থেমে যায়। তবে প্রায় এক বছর পর ২০১৬ সালে শেরপুর শহর কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নেয়। এরপর ঘুরে যায় তার ভাগ্যের চাকা। প্রশিক্ষণ শেষে ওই প্রতিষ্ঠানেই কম্পিউটার অপারেটর পদে তার চাকরি হয়।

শান্তা হাজং জাগো নিউজকে জানায়, কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টারে প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজে চলার পথ সুগম করার পাশাপাশি পরিবারকেও কিছু আর্থিক সহায়তা করছে। বর্তমানে সে প্রশিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছে। তার পরিকল্পনা ভবিষ্যতে কম্পিউটার বিষয়ে আরও শিক্ষা গ্রহণ করে আইটি সেক্টরে ভালো অবদান রাখা।

শান্তা হাজংয়ের মতো পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সন্তান নালিতাবাড়ী উপজেলার ১২ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের নিকটবর্তী ভটপুর গ্রামের কৃষি শ্রমিক বঙ্কিম বর্মনের ছেলে তপন বর্মন (২১)। এসএসসি পাসের পর আর্থিক অস্বচ্ছলতায় ঝড়ে পড়া তপন বর্মনও প্রায় দুই বছর আগে ৬ মাস মেয়াদী কম্পিউটার মেরামত প্রশিক্ষণ নেন। বর্তমানে সে শেরপুর শহরের এবি কম্পিউটার সেলস অ্যান্ড সার্ভিস সেন্টারে কাজ করছেন।

Advertisement

তপন বর্মন বলেন, আমি এখন মাসিক আড়াই হাজার টাকা বেতনে কাজ করছি। একই সঙ্গে কলেজে ভর্তি হয়ে পড়ালেখাও শুরু করেছি। এতে আমার লেখাপড়াটা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে।

ভটপুর গ্রামের স্বপন বর্মনও (২৪) গত বছর শহরের রঘুনাথ বাজার এলাকার একটি ইলেক্ট্রনিক্স ওয়ার্কশপে ফ্রিজ-টেলিভিশন, বৈদ্যুতিক পাখা, মোটর মেরামতের প্রশিক্ষণ নেন। প্রায় এক বছর আগে ৬ মাস প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর এখন ওই ওয়ার্কশপেই দৈনিক দেড়শ’ টাকা বেতনে কাজ করছেন।

তিনি জানান, বেতনের টাকায় নিজের খরচ চালাতে পারছেন। ইচ্ছে ভবিষ্যতে বড় ইলেক্ট্রিশিয়ান হবেন এবং একটি ওয়ার্কশপ গড়ে তুলবেন।

শান্তা হাজং, তপন বর্মন ও সুমন বর্মনের মতো অনেক আদিবাসী (ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী) যুবক-যুবতী এখন কারিগরি প্রশিক্ষণ নিয়ে সমাজের মূল স্রোতে সম্পৃক্ত হচ্ছেন। এক সময় শেরপুরের গারো, কোচ, হাজং, বর্মন, বানাই, ডালু, রাজবংশী, হদি, ক্ষত্রিয় সম্প্রদায়ের লোকজন নিজের এলাকা, সমাজ-সংস্কৃতির বাইরে খুব একটা যেতে চাইতেন না। তাদের জীবনেও এখন পরিবর্তনের ঢেউ লেগেছে।

Advertisement

সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগ ও উন্নয়ন প্রচেষ্টা তাদের জীবনকে পাল্টে দিচ্ছে। গৃহস্থালী কর্ম, কৃষি ছিল যাদের মূল পেশা, উপার্জনের প্রধান উৎস। তারাই এখন নানা কর্মমুখী ও কারিগরি প্রশিক্ষণ নিয়ে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বিতার সঙ্গে নিজেদের জীবনমানেরও উন্নয়ন ঘটাচ্ছেন।

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নেতা সুমন্ত বর্মন জানান, শেরপুরে সীমান্তবর্তী তিনটি উপজেলা ও সদরসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রায় ৩০/৩৫ হাজার লোকের বসবাস। এসব জনগোষ্ঠির লোকজন কৃষি ও নিজেদের ঐতিহ্যগত পেশার বাইরে খুব একটা স্বাচ্ছন্দ বোধ করতেন না। যে কারণে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর লোকজন পিছিয়ে পড়তে থাকে এবং তাদের জীবনমানের অবস্থাও খুব একটা উন্নত নয়।

তিনি বলেন, কিন্তু সময়ের প্রয়োজনেই এখন তারা বিভিন্ন ধরনের কারিগরি ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে এবং সমাজের মূল স্রোত ধারায় সম্পৃক্ত হতে চেষ্টা করছে।

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের জীবনমান উন্নয়নে সহায়তা করতে এগিয়ে এসেছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর অ্যানভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইইডি)।

এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের সক্ষমতা উন্নয়ন কর্মসূচি’ নামে শেরপুরে গত দুই বছর ধরে কম্পিউটার, ইলেক্ট্রনিক্স, মোটর মেকানিক, প্লাম্বিং-সেনেটারি ওয়ারিং-সহ বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করেছে আইইডি। এটা স্থানীয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের জীবনমান পরিবর্তনে খুব সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।

আইইডি’র প্রকল্প সমন্বয়কারী জ্যোতি চট্টোপাধ্যায় জানান, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ঝড়ে পড়া যুবক-যুবতীদের নিজ এলাকা থেকে শহরে এনে ওয়ার্কশপে রেখে বিভিন্ন ট্রেডে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। ২০১৬ সালে ২৬ জন কারিগরি প্রশিক্ষণ নিয়ে ইতোমধ্যে ১৪ জন কর্মে নিয়োজিত হয়েছেন। তারা এখন উপার্জন করছেন।

তিনি আরও বলেন, ২০১৭ সালে আরও ৫ জন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছেন। পর্যায়ক্রমে আরও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর যুবক-যুবতীদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হবে। তবে পিছিয়ে পড়া ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের মূল স্রোত ধারায় ফিরিয়ে আনতে সরকার এবং উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে আরও সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।

কারিতাস এবং আরও কয়েকটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার পক্ষ থেকে গারো এবং বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর যুবক-যুবতীদের ড্রাইভিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ওয়ারিং, সেলাই প্রশিক্ষণ, বিউটি পার্লারের ওপর প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার পক্ষ থেকেও নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠির জন্য বিভিন্ন ধরনের কারিগরি প্রশিক্ষণ ও সহায়তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অনেকে আবার ব্যক্তিগত উদ্যোগেও নানা ধরনের কারিগরি প্রশিক্ষণের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন।

শ্রীবরদী ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি প্রাঞ্জল এম. সাংমা বলেন, মূলত টিকে থাকার লড়াইয়ে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর লোকজন এখন ঐতিহ্যগত পেশা ছেড়ে বৃত্তিমূলক ও কর্মমুখী কাজে ধাবিত হচ্ছে। এতে কিছু ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি হলেও অনেক ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা বাড়েছে। সবকিছু মিলিয়ে সময়ের প্রয়োজনে, জীবনের তাগিদে অনেকেই নানা কর্মে নিয়োজিত হচ্ছে। আমরাও কারিগরি প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য নানাভাবে উৎসাহিত করছি।

এদিকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি, সমতলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় ও ভূমি কমিশন গঠনের দাবির মধ্য শেরপুরে আজ (৯ আগস্ট, বুধবার) ‘বিশ্ব আদিবাসী দিবস’ উপলক্ষে বিভিন্ন সংগঠন নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।

নাগরিক সংগঠন জনউদ্যোগ শেরপুর কমিটি বাংলাদেশ গারো ছাত্র সংগঠন (বাগাছাস), কোচ সংগঠন পিলাচ, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, রজিবা ও আইইডি’র সহায়তায় শহরের চকবাজার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আলোচনা সভা, র্যালি ও জেলা প্রশাসকের নিকট প্রধানমন্ত্রী বরাবরে লিখিত স্মারকলিপি প্রদানের কর্মসূচি পালন করছে।

হাকিম বাবুল/আরএস/আইআই