বিশেষ প্রতিবেদন

কতিপয় সহকর্মী গণমাধ্যমকে প্রভাবিত করছেন

অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। আগামী ২৪ আগস্ট দায়িত্ব নেয়ার দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ হতে যাচ্ছে। দায়িত্ব পালনের দীর্ঘ সময়ে প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির নানা বিষয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। দীর্ঘ আলোচনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজট, আবাসিক সঙ্কট, শিক্ষার মান, শিক্ষক ও ছাত্র রাজনীতি, ডাকসু, শিক্ষক নিয়োগসহ নানা প্রসঙ্গ গুরুত্ব পায়। সফলতার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা সমস্যার কথা তুলে ধরেন তিনি। গুরুত্ব পায় শিক্ষকদের গ্রুপভিত্তিক নানা কর্মকাণ্ডের বিষয়ও। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু ও মুনির হোসাইন। তিন পর্বের ধারাবাহিকের দ্বিতীয়টি আজ প্রকাশিত হলো।

Advertisement

জাগো নিউজ : আপনার সময়ে শিক্ষক নিয়োগে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। গণমাধ্যমেও বিষয়টি প্রকাশ পেয়েছে। আপনার সময় মোট ৯০৭ শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে। এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য…

আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক : শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরগুলো অবশ্যই আমার নজরে এসেছে। শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে অপসাংবাদিকতা হচ্ছে বলে মনে করি। অপসাংবাদিকতার কোনো খবর নিয়ে আমরা চিন্তিত নই।

যদি কোনো অনিয়মের ঘটনা থাকতো তাহলে আমরা উদ্বেগ প্রকাশ করতাম। শিক্ষক নিয়োগে আমরা সব সময় শক্ত অবস্থানে ছিলাম। আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ নিয়ে পত্রিকায় যেসব সংবাদ প্রকাশ হচ্ছে, তা নতুন নয়। যখনই সিলেকশন হয়েছে তখনই পত্রিকায় নানা বিষয় প্রকাশ পেয়েছে। এখনও প্রকাশ পাচ্ছে।

Advertisement

এখন যেহেতু উপাচার্য প্যানেল মনোনয়নের সময় এসেছে সেহেতু ইচ্ছাকৃতভাবে আমাদেরই কিছু সহকর্মী তারা পত্র-পত্রিকা অফিসে দৌড়াদৌড়ি করে এসব তথ্য প্রকাশের জন্য অনুরোধ করছেন। কতিপয় সহকর্মী গণমাধ্যমকে প্রভাবিত করছেন। জাগো নিউজ : আপনার সহকর্মীরা গণমাধ্যমকে কেন প্রভাবিত করবেন? এতে তাদের লাভ কী? আর শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে অপসাংবাদিকতা হচ্ছে- সেটাইবা কেন মনে করছেন?

আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক : দলের বিবেচনায় নয়, সবাই আমার সহকর্মী। শিক্ষক নিয়োগে এসব সহকর্মীরাই সম্পৃক্ত ছিলেন। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ, বিশেষ করে সহকারী অধ্যাপক, জুনিয়র লেভেলের নিয়োগ, রিক্রুমেন্টগুলো- এটা কখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়ন্ত্রণ করেন না।

জাগো নিউজ : অভিযোগ উঠেছে বিজ্ঞাপনের বিপরীতে অধিক সংখ্যক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এ অভিযোগ আপনার দলের শিক্ষকরাও করেছেন। আপনার পক্ষে ভোট বাড়াতেই এত সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক : যেটাই করা হয়েছে সেটা সিলেকশন কমিটি করেছে। সিলেকশন কমিটি যেভাবে সুপারিশ করেছে, সেটার ভিত্তিতেই নিয়োগ দেয়া হয়েছে। নিয়োগ সংক্রান্ত আলাদা কমিটি আছে। উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) সেই কমিটির সভাপতি।

Advertisement

কমিটিতে থাকেন সংশ্লিষ্ট বিভাগের চেয়ারম্যান, অনুষদের ডিন, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ এবং সিন্ডিকেট সদস্যগণ। তারা যখন সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিয়ে আসেন তখন সেই সিদ্ধান্তের বাইরে বেশিকিছু করা যায় না। এরপরও উপাচার্য হিসেবে আমি যখন মনে করেছি কোথাও সঠিক সিদ্ধান্ত হচ্ছে না, তখন রিভিউর জন্য পুনরায় কমিটির কাছে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু রিভিউ করার পরও সেটি যখন আসে তখন আর কিছুই করার থাকে না।

জাগো নিউজ : নিয়োগ কমিটি আপনার মতকে প্রাধান্য দিয়েই সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকে- এমনও অভিযোগ উঠেছে।

আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক : এই অভিযোগগুলো গণমাধ্যমেও প্রকাশ পাচ্ছে। এ ব্যাপারে আমার বক্তব্য হচ্ছে, অপসাংবাদিকতা নিয়ে আমি চিন্তিত নই।

আমি খুব শক্ত অবস্থান নিয়ে বলছি, শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে এখানে যা করা হয়েছে তা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে, শিক্ষার স্বার্থে করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার স্বার্থের বাইরে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি।

জাগো নিউজ : স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদেরও নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এর তো প্রমাণ রয়েছে?

আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক : হ্যাঁ। তবে ধারণা না থাকার কারণে এমন অভিযোগ তোলা হয়েছে। একটি বিভাগের কথা বলা হচ্ছে যে, স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের সেখানে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এটি ঠিক যে, যাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে তারা স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থী। কিন্তু এটা বলা হচ্ছে না যে, তারা প্রকৌশল বিষয়ে স্নাতক। এটা বলা হচ্ছে না যে, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে যাদের নিয়োগ দেয়া হয় তারা স্নাতক পর্যায়ের হলেও চলে। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকদেরই নিয়োগ করা হয় এবং পরবর্তীতে তারাই শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়েও ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগে সেভাবেই নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এর কারণ সেখানে প্রকৌশল বিষয়ে নিয়োগ দেয়া হয়েছে এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে স্নাতকদেরই নিয়োগ দেয়া হয়। ফলে এ অভিযোগ প্রকৌশল বিভাগগুলোতে প্রযোজ্য হবে না।

অন্য বিভাগে এভাবে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে কি না- সে ব্যাপারে কিন্তু অভিযোগ নেই।

জাগো নিউজ : এভাবে শিক্ষক নিয়োগের কোনো নজির আগে কি ছিল? আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক : এমবিবিএস ডিগ্রিধারী স্নাতকরা এ বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু আগে যোগদান করেছিলেন এবং তারা পরবর্তীতে অধ্যাপকও হয়েছেন। শুধু এমবিবিএস ডিগ্রি দিয়েই তারা শিক্ষক হয়েছেন। অতএব এখানে এভাবে নিয়োগ দেয়ার বিধান ছিল এবং দৃষ্টান্তও আছে। শিক্ষার্থীদের স্বার্থেই প্রকৌশলী শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু এ কথাটা বল হচ্ছে না যে, তারা প্রকৌশল বিষয়ে স্নাতক।তবে আমি মনে করি, এ ধরনের বিভ্রান্তিকর তথ্য যেসব সাংবাদিক ছড়ান, তারা হয়তো বিষয়টি ভালো করে জানেন না। তারা অন্য শিক্ষক দ্বারা প্রভাবিত হয়ে লিখে থাকতে পারেন। সহকর্মীরা যারা প্রশাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন, বেশকিছু উদাহরণ এনে তারা অভিযোগ করেছেন যে, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে উচ্চ সিজিপিএ পেয়েছেন, কিন্তু নিয়োগ পাননি।

অনার্স, মাস্টার্স ভালো করলেও এসএসসি ও এইচএসসি’র ফলাফল ভালো না করলে তিনি নিয়োগ পেতে পারেন না। আর বিষয়টি সিন্ডিকেট দ্বারা নির্ধারিত হয়।

আবার শিক্ষক নিয়োগের যে কমিটি আছে, সেই কমিটি যদি মনে করে মৌখিক পরীক্ষায় ভালো করেছে; অনার্স, মাস্টার্সে প্রথম বা দ্বিতীয় স্থান অধিকার করা, শ্রেণীকক্ষেও অন্যদের থেকে ভালো করেছে সেক্ষেত্রে এসএসসি ও এইচএসসিতে যদি ফলাফল খানিক খারাপও থাকে তবে নিয়োগ কমিটি তার জন্য সুপারিশ করতে পারেন। সিন্ডিকেটই সেই শর্ত থেকে কিছুটা নমনীয় হয়ে নিয়োগের সুপারিশ করেন।

এ বিশ্ববিদ্যালয়ে অতীতে অনেক অ্যাডহক নিয়োগ হয়েছে। অস্থায়ীভাবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বহু শিক্ষককে উপাচার্য ইচ্ছকৃতভাবে অস্থায়ীভাবে নিয়োগ দিয়েছেন। কিন্তু আমার সময়ে একজনকেও অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হয়নি। যা কিছু করা হয়েছে সিলেকশন কমিটির মাধ্যমে হয়েছে। সিলেকশন কমিটিতে যারা ছিলেন তারা সবাই বিজ্ঞ ব্যক্তি বলে মনে করি। তারা ভালোদের জন্যই সুপারিশ করেছেন।

অতীতে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে চিরকুট দিয়েও নিয়োগ দেয়া হয়েছে। চিরকুট আমরা ফাইল থেকে উদ্ধার করেছি। চিরকুট দিয়ে এখানে হরহামেশা নিয়োগ পেয়েছেন অনেকে। সেই অতীতে আমরা যেতে চাই না। বিগত সাড়ে আট বছরে যা কিছু্ই ঘটেছে সচ্ছতার ভিত্তিতে আইন ও বিধি-বিধানের ভিত্তিতে করা হয়েছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থেই করা হয়েছে।

জাগো নিউজ : এরপরও জানতে চাইছি, আপনার সময়েই ৯০৭ শিক্ষক নিয়োগ পেয়েছেন। সংখ্যাটি বেশি দেখায় কি না?আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক : সংখ্যাটি সঠিক কি না, তা ফাইল না দেখে বলতে পারছি না। গত এক দশকে বেশ কয়েকটি নতুন বিভাগ খোলা হয়েছে। অনেকেই ছুটি নিয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য দেশের বাইরে রয়েছেন। এ সময়ে প্রচুর শিক্ষক অবসরে গেছেন।

অসংখ্য শিক্ষকের পদ খালি রেখে তো একটি বিশ্ববিদ্যালয় চলতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম গতিশীল রাখতেই শিক্ষক নিয়োগ দিতে হয়। পদ তো আমরা সৃষ্টি করি না। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন যেসব শূন্য পদ সৃষ্টি করে দেয়, তার ভিত্তিতেই শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। চাইলেই পদ সৃষ্টি হয় না। সকল দিক বিবেচনা করেই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন পদ সৃষ্টি করে।

জাগো নিউজ : অভিযোগ রয়েছে, কিছু শিক্ষককে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়ে পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। ওই শিক্ষকরা আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আবারও চাকরি ফিরে পেয়েছেন। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য…

আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক : বাধ্যতামূলকভাবে আমরা খুব বেশি শিক্ষককে অবসরে দেইনি। যেসব শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছিল বিশেষ করে নৈতিক স্খলনজনিত, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে অবসরে দেয়া হয়েছে। তদন্ত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতেই শিক্ষকদের বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়েছে।

যাদের বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়েছে তারা আদালতে মামলা করেছেন। সেসব মামলা এখনও তদন্তাধীন। অতএব তাদেরকে যে আমরা আবারও গ্রহণ করেছি, তা নয়। দু-একটি জায়াগায় বাধ্যতামূলক ছুটি দেয়া হয়েছে। এক-দু’জন হয়তো আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ফিরে এসেছেন। এটা হতেই পারে। প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের পর, উপাচার্যের প্যানেল সিনেট মনোনীত করেছে। সে বিষয়েও তো আমাদের সহকর্মীরা মামলা করেছেন। জাগো নিউজ : আইনি প্রক্রিয়ায় ফিরে এসেছেন বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো শিক্ষকরা। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের হার হলো কি না?

আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক : না, আমার কছে তা মনে হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো একটা সিদ্ধান্ত, সেটা আদালতে যেতেই পারে। আদালতের সিদ্ধান্ত মানব, এটাই স্বাভাবিক।

এএসএস/ এমএইচ/এমএআর/আরআইপি