রাজধানীর শাহজাদপুরের বাসিন্দা রাহাত হাওলাদার। গতবার আফতাব নগরের হাট থেকে ৬৫ হাজার টাকা দিয়ে একটি দেশি গরু কিনেছিলেন। শরিক ছিলেন পাঁচজন। সে অনুযায়ী প্রত্যেকের কাছ থেকে ১০ হাজার করে নিয়ে মোট ৫০ হাজার টাকার মধ্যে একটি গরু কেনার টার্গেট ছিল। কিন্তু হাটে গিয়ে মাথায় হাত। ৬০-৬৫ হাজারের নিচে কোনো গরু নেই। পরে বাধ্য হয়ে অন্যান্য কেনাকাটায় কাটছাট করে ৬৫ হাজার টাকা দিয়ে গরু কেনেন।
Advertisement
এবারও চিন্তিত রাহাত হাওলাদার। আয় সামান্য, মোটামুটি মানের একটি গুরু হলেই যথেষ্ট। গতবারের মতো এবারও ভারতীয় গরু আসছে না। স্বাভাবিকভাবেই গরুর দাম চড়া থাকবে। নিত্যপণ্যের দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে গরুর দাম সহনীয় পর্যায়ে থাকবে না বলে তার দৃঢ় বিশ্বাস। ব্যয় বাড়লেও আয় বাড়েনি। এবার তাই শরিক বাড়ানোর চিন্তা করছেন তিনি।
শুধু রাহাত হাওলাদার নন, আসন্ন ঈদুল আজহায় কোরবানির পশুর দাম নিয়ে চিন্তিত মধ্যবিত্তরা। বর্তমানে এক কেজি গরুর মাংসের দামই ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে, সেখানে কোরবানির পশুর দাম কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে- তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তারা।
অনেকের ধারণা, ভারত থেকে গরু আমদানি বন্ধ থাকায় এর প্রভাব পড়বে কোরবানির হাটে। কিন্তু রাজধানীর বৃহৎ পশুর হাট গাবতলীর ব্যবসায়ীরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের মতে, দেশে কোরবানির চাহিদা মেটানোর মতো পর্যাপ্ত পশু আছে। ফলে কোরবানিতে ভারতীয় গরু না আসলেও চলবে।
Advertisement
ভালো সংবাদের পরই দুঃখের খবর জানান তারা। গরু ব্যবসায়ীদের যুক্তি, ভারতীয় গরু আনা হলেও বাজারে দামে তেমন প্রভাব পড়বে না। সেক্ষেত্রে দেশীয় গরুর খামারিরা ঠকবেন, ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
সরেজমিন সোমবার রাজধানীর সবচেয়ে বড় পশুর হাট গাবতলীতে গিয়ে সেখানকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
গরু ব্যবসায়ীদের দাবি, কোথা থেকে গরু আমদানি হলো কিংবা কত সংখ্যক আমদানি হলো সেটি বড় বিষয় নয়, দাম না কমার পেছনে ভিন্ন কারণ রয়েছে। তারা জানান, রাস্তাঘাটে যে পরিমাণ চাঁদাবাজি হয়, তা উসুল করে লাভের মুখ দেখতেই গরুর দাম বাড়ে।
এছাড়া পশু খাদ্যসহ অন্যান্য জিনিসের দাম বেড়েছে ব্যাপকহারে। ফলে বাধ্য হয়েই পশুর দাম বাড়াতে হয় তাদের। এর বাইরে আর কোনো কারণ নেই।
Advertisement
চাঁদাবাজিসহ অন্যান্য সমস্যার সমাধান হলেই পশুর দাম স্বাভাবিক হবে বলে মনে করেন তারা।
গাবতলী পশুর হাটে প্রবেশ করতেই কথা হয় ইকবাল মিয়ার সঙ্গে। ওপরে টিনের চালা নির্মিত তার গরুর ঘর। সেখানে গরু লালন-পালন ও বিক্রি করেন তিনি। কুষ্টিয়ার এ ব্যবসায়ী তিন যুগ ধরে এ ব্যবসা করছেন। এবার ঈদে ভারতীয় জাতের ৩০টি গরু কোরবানি ঈদের জন্য মোটাতাজা করেছেন। প্রতিটি গুরুর আকৃতি বিশাল।
জাগো নিউজকে ইকবাল বলেন, এখানেই গরু মোটাতাজা করি। একই সঙ্গে বিক্রিও চলে সমানতালে। এবার কোরবানির জন্য ৩০টি গরু প্রস্তুত করেছি। গরুগুলোর প্রতিটির গড় ওজন ১২-১৬ মণের কম হবে না।
তিনি বলেন, দেশে পর্যাপ্ত গরু আছে। কল্পনাও করতে পারবেন না কত গরু আছে! যে সংখ্যক গরু দেশীয় খামারিদের কাছে আছে, তা দিয়ে আগামী দুই কোরবানির ঈদের চাহিদা মেটানো সম্ভব।
তার মতে, ভারতীয় গরুর কোনো দরকার নেই। রাস্তাঘাটের উপরি খরচ (চাঁদাবাজি) বন্ধ করা গেলে এবং গরুর খাদ্যের দাম কমানোসহ অন্যান্য সমস্যার সমাধান করা গেলে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে চলে আসবে পশুর দাম।
দাম প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, সবারই ধারণা, ভারতীয় গরু আনলে দাম কমবে। কিন্তু সেটা কখনই হবে না। বরং ভারতীয় গুরু আসলে মাঠপর্যায়ের কিছু খামারি মার খাবেন, দামে ঠকবেন। লাভবান হবেন দালালরা (মধ্যস্বত্বভোগীরা)।
পশুর হাটের আরেক অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, একসময় আমি এই পশুর হাটে ইজারাদারের চাকরি করতাম। এরপর নিজেই ব্যবসায় নামি। প্রথম দিকে ব্যাপক লাভ ছিল; এখন পশুর দাম বাড়ছে, কিন্তু ব্যবসায় লাভ বাড়েনি বরং কমেছে।
তার ভাষায়, ‘লাভের ধন পিঁপড়ায় খায়। খরচ অনেক বেড়েছে, আগেও ছিল, কিন্তু এখনকার মতো না। পশুর দাম কম ছিল, বিক্রি বেশি ছিল। লাভও ছিল বাম্পার। এখন টাকা চোখেই দেখি না।’
তিনি আরও বলেন, ভারতীয় গরু এখনও আসছে। তাতে পশুর দাম কমেনি, বরং বাড়ছে। এজন্য দেশীয় খামারিদের ওপর আস্থা রেখে ব্যবসায়ীদের খরচ কমাতে হবে। এতে খামারিরা আরও উৎসাহিত হবেন, উৎপাদন বাড়াবেন। তারাও লাভবান হবেন, ক্রেতারাও হবেন।
মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, মানুষ কোরবানি করা কমিয়ে দিয়েছে। অনেকের হাতে টাকা আছে কিন্তু মনে আনন্দ নেই। পশু বিতরণ বন্ধ হয়ে গেছে। পশুর দাম বেড়ে যাওয়ায় এমনটি হয়নি, কারণ অন্যকিছু।
একই হাটের মহিষ বিক্রেতা আলাউদ্দীন বলেন, গরু, মহিষ যাই বলেন কোনোটার দাম কম না। আমরা মহিষ বিক্রি করি মণপ্রতি ১৮ হাজার টাকা হিসেবে। বর্তমানে একটি পাঁচ মণ ওজনের মহিষের দাম স্বাভাবিকভাবে ৯০ হাজার টাকা। এর বাইরে ইজারা খরচ ও পরিবহন ব্যয়ও ক্রেতার। সুতরাং পশুর দাম কম নয়।
তিনি দাবি করেন, গত ঈদে পশুর দাম বরং কমই গেছে। বাজার রেটের চেয়ে কম মূল্যে পশু বিক্রি হয়েছে। লস দিয়ে তো বিক্রি করা যায় না। কিন্তু আরও কম দামে বিক্রি করা যেত, যদি খরচ কম হতো।
তিনি আরও বলেন, ভারতের গরু-মহিষ কমবেশি সারা বছরই আসে। কিন্তু গত ২/৩ বছর কোরবানিতে ভারতীয় গরু কম এসেছে। এতে কোরবানি থেমে নেই, দেশে গরু পালনের খরচ বেড়েছে। ইচ্ছা করলেই খামারিরা কম দামে গরু বিক্রি করতে পারেন না। এজন্য ভারতীয় গরু আসলেও আমাদের খুব একটা সমস্যা হবে না। তবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন দেশী খামারিরা।
এমএ/এসআর/এমএআর/বিএ