বিশেষ প্রতিবেদন

সেশনজটমুক্ত করাই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ

অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। আগামী ২৪ আগস্ট দায়িত্ব নেয়ার দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ হতে যাচ্ছে। দায়িত্ব পালনের দীর্ঘ সময়ে প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির নানা বিষয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র।

Advertisement

দীর্ঘ আলোচনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজট, আবাসিক সঙ্কট, শিক্ষার মান, শিক্ষক ও ছাত্র রাজনীতি, ডাকসু, শিক্ষক নিয়োগসহ নানা প্রসঙ্গ গুরুত্ব পায়। সফলতার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা সমস্যার কথা তুলে ধরেন তিনি। গুরুত্ব পায় শিক্ষকদের গ্রুপভিত্তিক নানা কর্মকাণ্ডের বিষয়ও। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু ও মুনির হোসাইন। তিন পর্বের ধারাবাহিকের প্রথমটি আজ প্রকাশিত হলো।

জাগো নিউজ : আপনার দুই মেয়াদের দায়িত্ব শেষ হতে যাচ্ছে। প্রত্যাশার জায়গা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে কতটুকু দিতে পারলেন?

আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক : সাড়ে আট বছর ধরে উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করে আসছি। প্রথমবার মনোনীত হিসেবে দায়িত্ব পাই। পরেরবার সিনেট কর্তৃক নির্বাচিত হই।

Advertisement

এমন একটি জায়গায় দায়িত্ব পেয়ে অনেক প্রত্যাশা থাকে। অনেক কিছু দেয়ারও থাকে। আমি কতটুকু দিতে পেরেছি, এর মূল্যায়ন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা করতে পারবেন। তবে আমার পক্ষ থেকে চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিল না।

জাগো নিউজ : দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালন করলেন। শিক্ষার্থীদের সমস্যাগুলো নিয়ে কী বলবেন?

আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক : একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই হচ্ছে প্রাণ। এ কারণে তাদের চাহিদাই সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজটমুক্ত করা ছিল বড় চ্যালেঞ্জ।

শিক্ষার্থীদের অনেক সমস্যা আছে বলে আমি মনে করি। এর মধ্যে আবাসন ও সেশনজটের সমস্যা মুখ্য বলে আমার কাছে মনে হয়েছে।

Advertisement

আমি দেখেছি, সেশনজটের কারণে একজন শিক্ষার্থীর চার বছরের স্নাতক শেষ করতে প্রায় সাড়ে সাত বছরের মতো সময় লাগত। মাস্টার্সসহ পাঁচ বছরের কোর্স শেষ করতে অনেকের আট বছরের মতো সময় লেগেছে। এখানে পড়তে আসা অধিকাংশ শিক্ষার্থীই গ্রামের দরিদ্র কৃষক পরিবারের। সেশনজটের কারণে একজন শিক্ষার্থীকে অতিরিক্ত সময় এবং অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক এবং অভিভাবক হিসেবে এটি আমাকে পীড়া দিয়েছে। বিষয়টির প্রতি আমরা অধিক গুরুত্ব দিয়েছি বলেই আজ বিশ্ববিদ্যালয় সেশনজটমুক্ত। প্রায় শূন্যের ঘরে নেমে এসেছে বিভাগগুলোর সেশনজট। আমরা সময়মতো সমাবর্তনের আয়োজন করে শিক্ষার্থীদের আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় দিচ্ছি। সমাবর্তন পাওয়া একজন শিক্ষার্থীর স্বপ্ন থাকে। আমরা ধারাবাহিকভাবে এটি পূরণ করে আসছি।

একই সঙ্গে আমরা শিক্ষার্থীদের আবাসন সঙ্কট নিরসনেও গুরুত্বারোপ করেছি।

জাগো নিউজ : সেশনজটমুক্ত করা চ্যালেঞ্জের বটে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ ক্ষেত্রে সফল। তবুও বেশ কয়েকটি বিভাগে জট তো রয়েছে।

আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক : হ্যাঁ, কয়েকটি বিভাগে এখনও সেশনজট রয়েছে। প্রায় ৯৪টি বিভাগ ও ইনস্টিটিউট রয়েছে এখানে। সবাইকে সমান তালে চলতে দেখা যায়নি বলেই কয়েকটি বিভাগে এ সমস্যা রয়ে গেছে।

জাগো নিউজ : জটমুক্ত হতে বিভাগগুলোর উদ্দেশ্যে কী বলবেন?

আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক : আমি মনে করি, বিভাগগুলোর শিক্ষকদের আন্তরিকতার ওপরই সেশনজটের বিষয়টি নির্ভর করে। ক্লাসে নিয়মিত এবং পরীক্ষার ফলাফল দ্রুত প্রকাশ করতে পারলে সেশনজট নামের অভিশাপ থেকে শিক্ষার্থীরা রেহাই পাবেন। এটি শিক্ষক হিসেবে দায়ের ব্যাপার।

তবে আমি মনে করি, শিক্ষকরাও এখন এ ব্যাপারে অধিক আন্তরিক।

জাগো নিউজ : আবাসিক সঙ্কটের কথা বলছিলেন…

আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক সঙ্কট এখনও প্রকট। আমাদের এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থীকে আমরা আবাসিক সুযোগ দিতে পারি। বাকি শিক্ষার্থীদের সে সুযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।

পর্যায়ক্রমে আমরা আবাসিক সঙ্কট নিরসনের চেষ্টা করেছি এবং করছি। আমরা আবাসিক হলগুলোর তলা বাড়িয়ে কক্ষ বাড়িয়েছি। বিজয় একাত্তর হল নির্মাণের পর শিক্ষার্থীদের আবাসিক সঙ্কট খানিকটা দূর করা সম্ভব হয়েছে। হলটি সর্বাধুনিক। কবি সুফিয়া কামাল হল নির্মাণ করে ছাত্রীদের থাকার সুব্যবস্থা করা হয়েছে। রোকেয়া হলের ভেতরে ‘৭ই মার্চ ভবন’ নির্মাণ করা হয়েছে।

জাগো নিউজ : এরপরও আবাসিক সঙ্কট তীব্র, যা আপনিও বলছিলেন। এ সঙ্কট থেকে উত্তরণের উপায় কী?

আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক : মোট শিক্ষার্থীর এক-তৃতীয়াংশের জন্য আবাসন ব্যবস্থা রয়েছে। অনেক শিক্ষার্থী আছে যার এক রাতের জন্যও ঢাকা শহরে অন্যত্র থাকার জায়গা নেই। তারা বাধ্য হয়ে গণরুমে অথবা বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করে হলে থাকে।

তবে আমি মনে করি, এ সমস্যা একদিনে দূর করা সম্ভব নয়। আমাদের এ সঙ্কট ক্রমান্বয়ে নিরসন করতে হবে। ক্যাম্পাসে জায়গার সঙ্কট প্রকট। নতুন একটি হল করব সে জায়গাও নেই। বিকল্প হিসেবে বিদ্যমান হলগুলোকে বিশেষ করে তিন-পাঁচতলার হলগুলো ভেঙে ২০/২৫তলা ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে।

সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের তিনতলা ভবনটি ভেঙে সেখানে ২০তলা কিংবা ২৫তলা ভবন নির্মাণ করা গেলে সমস্যা অনেকেটা লাঘব হবে। আমরা সে উদ্যোগ নিয়েছি। এ বিষয়ে অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে আলোচনা চলছে।

জাগো নিউজ : সরকার বিষয়টি কীভাবে দেখছে?

আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক : সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি সব সময় সংবেদনশীল। প্রধানমন্ত্রী কয়েক মাস আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ৬২০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন। ইতোমধ্যে উন্নয়ন কাজ শুরু হয়েছে। পরবর্তীতে আবার যখন উন্নয়ন বাজেট পাওয়া যাবে, তখন আবাসিক সংকট নিরসনে ভবন নির্মাণ করা হবে। শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও আবাসিক সঙ্কট দূর করার চেষ্টা চলছে।

জাগো নিউজ : ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি এখন অনেক শান্ত। কিন্তু অভিযোগ আছে, বিরোধীপক্ষের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের হলে সহাবস্থানের সুযোগ দেয়া হয় না। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য।

আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক : এটি একেবারেই ভুল তথ্য। কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ক্লাস পরীক্ষাগুলো হচ্ছে সেখানে শতভাগ শিক্ষার্থীর উপস্থিতি রয়েছে। ক্যাম্পাসে সহাবস্থানের সুযোগ না থাকলে পরীক্ষার হলে শতভাগ উপস্থিতি থাকত না। বিএনপি-জামায়াত জোটের শাসনামলে আমরা দেখেছি, এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের জন্য আলাদা পরীক্ষা নেয়ার ব্যবস্থা করতে। তারা সাধারণ পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে হলে গিয়ে পরীক্ষা দিতে পারত না।

আমাদের কাছে সবার আগে পরিচয় সে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কি না? শিক্ষার্থী হলে তার শিক্ষাজীবন শেষ করার সুযোগ করে দেয়া আমাদের দায়িত্ব। কে কোন দলের সে পরিচয় আমাদের কাছে মুখ্য নয়। বিরোধীপক্ষ যখন আগুন জ্বালিয়ে সারাদেশে তাণ্ডব চালিয়েছে, ঠিক তখনও ছাত্রদল ও শিবিরের নেতাকর্মীরা পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে।

এমন চিত্র আপনি বিএনপি-জামায়াতের আমলে দেখতে পাবেন না।

জাগো নিউজ : আপনি পরীক্ষার হলে সহাবস্থানের কথা বললেন। কিন্তু হলে বিরোধী সংগঠনের কর্মীরা প্রায় নিষিদ্ধ?

আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক : এ অভিযোগ ঠিক নয়। আবাসিক হলে ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরাও অবস্থান করছে। হয়তো তারা তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে না। নিজেদের হয়তো সেভাবে পরিচয়ও দেয় না। কিন্তু আমি জানি, যারা ছাত্রশিবিরের সঙ্গে যুক্ত তারা হলে আছে। মাঝে মধ্যে এগুলো নিয়ে কিছুটা উত্তেজনা দেখা দেয়। কিন্তু তারপরও আমাদের হল প্রশাসন বিশেষ করে প্রাধ্যক্ষরা তাদের বিভিন্নভাবে প্রটেকশন দেন। তারা থাকছে। অতএব এটা বলা ঠিক হবে না যে সহাবস্থান নেই। যারা অতীতে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা ধরনের অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিল তাদের সাধারণরা গ্রহণ করতে চায় না। তারা নিজেরাও ক্যাম্পাস থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছে।

জাগো নিউজ : উচ্চশিক্ষার প্রাণকেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা সংস্কারের কথা বলেছিলেন। কিন্তু শিক্ষার মান নিয়ে এখনও প্রশ্ন ওঠে…

আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক : শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন সব সময় থাকবে। মানোন্নয়ন চলমান প্রক্রিয়া। শিক্ষার মান গত ১০ বছরে অনেক দূর এগিয়েছে বলে আমি মনে করি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে শিক্ষার মান নিয়ে আমরা সন্তুষ্ট। শিক্ষার মান নিয়ে প্রতিদিনই আমরা অসন্তুষ্টিতে ভুগি।

জাগো নিউজ : বিশ্বের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তুলনা করে কী বলবেন?

আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক : ১০ বছর আগে শিক্ষার যে মান ছিল এখন তা থেকে আমরা অনেক এগিয়েছি। আমি নিশ্চিতভাবে বলব যে, শিক্ষার মান অনেক বেড়েছে। এখন যে মানের ছাত্র-ছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসছে তাদের মান বেড়েছে, যে মানের শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পেশায় যোগদান করেছেন তাদেরও মান বেড়েছে।

অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন শিক্ষকদের পিএইচডি ডিগ্রির সংখ্যা অনেক বেশি। ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়ে আসা শিক্ষকদের সংখ্যাও অনেক বেশি।

প্রশ্ন হচ্ছে, এই মানে কি আমরা সন্তুষ্ট? একবিংশ শতাব্দীর যে চ্যালেঞ্জ এবং সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমরা শিক্ষার্থীদের বিশ্বমানের হিসেবে দেখতে চাই। তারা যাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় গিয়ে তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে পারে, সে অনুযায়ী তাদের গড়ে তুলতে চাই।

আমাদের যে আর্থিক অবস্থা, গ্রন্থাগারের অবস্থা এবং গবেষণাগারের অবস্থা- এগুলো নিয়ে আমরা কখনও সন্তুষ্ট নই। গবেষণার মান না বাড়ালে উচ্চশিক্ষার মান বাড়বে না। উন্নত বিশ্বের মোকাবেলায় সেই মানের শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি এবং আমরা সে চেষ্টাই অব্যাহত রেখেছি। আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিশ্বের নামি-দামি প্রতিষ্ঠানে গিয়ে সফলতার সাক্ষর রাখছে। বর্তমানে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিশ্বকে চ্যালেঞ্জ করার প্রত্যয় নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে।

এএসএস/এমএইচ/এমএআর/আরআইপি