সাহিত্য

রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো কথন

রবীন্দ্রনাথের জন্ম ১৮৬১ সালে কোলকাতার জোড়াসাকোর ঠাকুর বাড়িতে আর ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো জন্মেছেন আর্জেন্টিনার বুয়েনোস আইরেসে ১৮৯০ সালে। বয়সের দিক দিয়ে ওকাম্পো থেকে রবীন্দ্রনাথ ২৯ বছরের বড় ছিলেন। কেবল বয়সের ব্যবধানই নয়, দু’জনের জন্মস্থানের মধ্যে ব্যবধান কয়েক হাজার মাইল। কেননা একজন জন্মেছেন এশিয়ায় মহাদেশে, অন্যজন বেড়ে উঠেছেন দক্ষিণ আমেরিকায়। তবু স্থানিক অথবা বয়সের দূরত্ব তাঁদের ‘প্রেমসুলভ’ বা ‘অন্যরকম’ সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো বাধা হতে পারেনি। ওকাম্পোর প্রতি রবীন্দ্রনাথের ভিন্নরকম ভালো লাগা, পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের প্রতি ওকাম্পোর চোরাটান— এটি বিশ্ব সাহিত্য অঙ্গনেরও একটি আলোচিত বিষয়। ওকাম্পো-রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক নিয়ে প্রচুর লেখালেখি, আলোচনা ও সমালোচনা হয়েছে। এ সম্পর্ককে ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্রও। ‘ওকাম্পো’ রবীন্দ্রনাথের সমগ্র জীবনের আলো-আঁধারীময় একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

Advertisement

রবীন্দ্রনাথের সাথে ওকাম্পোর সম্পর্কের যোগসূত্রের স্থানটি ছিলো সাহিত্য। দু’জনই সাহিত্যচর্চা ও সাহিত্যের প্রতি বিপুল আগ্রহী ছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে ওকাম্পোই আগে খুঁজে পেয়েছিলেন ১৯১৪ সালে, গীতাঞ্জলি ফরাসি ভাষায় অনূদিত হওয়ার পর। নোবেল বিজয়ীর ‘গীতাঞ্জলি’ পড়ে ওকাম্পো মুগ্ধ হন। তিনি রবীন্দ্রনাথের অনুরাগী পাঠক হয়ে পড়েন। বইয়ের ভেতরকার রবীন্দ্রনাথ ওকাম্পোর সামনে জলজ্যান্ত হয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন তারও দশ বছর পর।

১৯২৪ সালে রবীন্দ্রনাথ পেরু ও মেক্সিকো ভ্রমণকালে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি তখন বাধ্য হয়ে আর্জেন্টিনায় যাত্রা বিরতি করে বুয়েনোস আইরেসের প্লাসা হোটেলে অবস্থান করেন। বুয়েনোস আইরেসে রবীন্দ্রনাথ আছেন জেনে তাঁকে দেখতে সেখানে ছুটে যান ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। আগেই বলেছি, ওকাম্পো ছিলেন পাড় রবীন্দ্রভক্ত। নিজের প্রিয় একজন কবিকে দেখে তিনি মুগ্ধ হলেন, শিহরিত হলেন।

রবীন্দ্রনাথের সাথে প্রথম দর্শনের অনুভূতি সম্পর্কে ওকাম্পো নিজেই লিখেছেন : ‘প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তিনি এলেন; নীরব, সুদূর, তুলনাহীন বিনীত। ঘরে এসে দাঁড়ালেন, আবার এও সত্যি যে ঘরে যেন তিনি নেই। তেষট্টি বছর, প্রায় আমার বাবার বয়সী, অথচ কপালে একটি রেখাও নেই, যেন কোন দায়িত্বভারই নষ্ট করতে পারে না তাঁর সোনালী শরীরের স্নিগ্ধতা। সুগোল সমর্থ গ্রীবা পর্যন্ত নেমে এসেছে উছলে-ওঠা ঢেউতোলা সাদা চুলের রাশি। ...মসৃণ ত্বকের অন্তরালে তাঁর সমগ্র মুখাবয়বের গড়ন এক অবিশ্বাস্য সৌন্দর্য রচনা করেছে, তেমনি সুন্দর তাঁর কালো চোখ, নিখুঁত টানা ভারী পল্লব।’

Advertisement

রবীন্দ্রনাথকে অসুস্থ দেখে ওকাম্পোই তাঁকে নিজের বাড়ি ‘ভিলা ওকাম্পো’তে নিয়ে আসেন। কবিগুরুর সাথে ছিলেন তাঁর সহকারী লের্নাড এলমর্হাস্ট। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন ৬৩। আর ওকাম্পো ছিলেন ৩৪-এ পা রাখা নারী। এ সত্ত্বেও আতিথ্যের দিনগুলোতে রবীন্দ্রনাথও ওকাম্পোর অনুরাগী হয়ে পড়েন। আমরা দেখি- ওকাম্পো কবিগুরুর জীবনে বিশেষ প্রভাব ফেলতে সক্ষম হন। বদলে যান রবীন্দ্রনাথও। যদিও এ প্রভাব উভয় পক্ষেরই ছিলো।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘চিত্রকর রবীন্দ্রনাথ’ হয়ে ওঠার পেছনে ছিলো ওকাম্পোর উৎসাহ ও উদ্দীপনা। নারীদের সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন হয়েছে ওকাম্পোকে দেখার পর। যেই রবীন্দ্রনাথ একদিন নারীর অধিকার নিয়ে বলেছিলেন, ‘আজকাল একদল মেয়ে ক্রমাগত নাকী সুরে বলছে, আমরা পুরুষের অধীন, আমরা পুরুষের আশ্রয়ে আছি, আমাদের অবস্থা অতি শোচনীয়। তাতে করে কেবল এই হচ্ছে যে, স্ত্রী পুরুষের সম্বন্ধবন্ধন হীনতা প্রাপ্ত হচ্ছে; অথচ সে-বন্ধন ছেদন করবার কোনো উপায় নেই...।’ তিনি আরো বলতেন, ‘সাহিত্যে, কলায়, বিজ্ঞানে, দর্শনে, ধর্মে, বিধিব্যবস্থায় মিলিয়ে আমরা যাকে সভ্যতা বলি সে হল পুরুষের সৃষ্টি।’ ‘প্রকৃতিই রমণীকে বিশেষ কার্য্যভার ও তদনুরূপ প্রবৃত্তি দিয়া গৃহবাসিনী করিয়াছেন, পুরুষের সার্বভৌমিক স্বার্থপরতা ও উৎপীড়ন নহে, অতএব বাহিরের কর্ম দিলে তিনি সুখীও হইবেন না, সফলও হইবেন না।’

সেই রবীন্দ্রনাথই ওকাম্পো-সাক্ষাতের পরবর্তী সময়ে বলেছেন— ‘এ দিকে প্রায় পৃথিবীর সকল দেশেই মেয়েরা আপন ব্যক্তিগত সংসারের গণ্ডি পেরিয়ে আসছে। আধুনিক এশিয়াতেও তার লক্ষণ দেখতে পাই। তার প্রধান কারণ সর্বত্রই সীমানা-ভাঙার যুগ এসে পড়েছে। যে-সকল দেশ আপন আপন ভৌগোলিক ও রাষ্ট্রিক প্রাচীরের মধ্যে একান্তবদ্ধ ছিল তাদের সেই বেড়া আজ আর তাদের তেমন করে ঘিরে রাখতে পারে না, তারা পরস্পর পরস্পরের কাছে প্রকাশিত হয়ে পড়েছে।’ শুধু তা-ই নয়, আমরা শেষের কবিতায় যে লাবণ্যকে পাই, অনেক গবেষক মনে করেন— গুণান্বিত লাবণ্য ওকাম্পোর চরিত্রকে অস্পৃশ্যভাবে ধারণ করে আছে।

রবীন্দ্রনাথ ওকাম্পোকে বিজয়া বলে ডাকতেন। তিনি তাঁর বিজয়ার আতিথ্যে প্রায় দু’মাস বুয়েনোস আইরেসে ছিলেন। সেখানে কবিগুরু ৩০টির মতো কবিতা রচনা করেন। প্রথম সাক্ষাতেই যে ওকাম্পো রবীন্দ্রনাথের মন জয় করে নিয়েছিলেন সেটির প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর লেখা সে সময়ের কবিতাগুলো ঘাটলে। রবীন্দ্রনাথ নিজেই ওকাম্পোকে চিঠিতে লেখেন : ‘তুমি জানো যে ভাস্বর সেই দিনগুলি আর তার কোমল শুশ্রুষার স্মৃতিপুঞ্জ ধরা আছে আমার কবিতাগুচ্ছে, হয়তো আমার অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা (পূরবী)। পলাতক স্মৃতিগুলি আজ কথায় বন্দী। ...তোমাকে নিশ্চিত বলতে পারি যে, এ কবিতা বেঁচে থাকবে অনেকদিন।’ আর ১৯২৫ সালে প্রকাশিত পূরবী কাব্যগ্রন্থটি রবীন্দ্রনাথ ওকাম্পোকেই উৎসর্গ করেন।

Advertisement

বিজয়া রবীন্দ্রনাথের প্রতি যথেষ্ট আনুগত্য ও আন্তরিকতা দেখিয়েছিলেন। তাঁরা পরস্পরের মধ্যে কমপক্ষে অর্ধশত চিঠি চালাচালি করেছেন। জানা যায়, রবীন্দ্রনাথকে আপ্যায়িত করতে গিয়ে ওকাম্পোকে তাঁর দামি হীরের টায়রাটি বিক্রি করতে হয়েছিলো। মজার বিষয় হলো রবীন্দ্রনাথের সাথে ওকাম্পোর দেখা হয়েছিলো মাত্র দুবার, দ্বিতীয়বার ১৯৩০ সালে প্যারিসে। দ্বিতীয়বারও ওকাম্পো কবিগুরুর জন্যে যথেষ্ট করলেন। অনেক খেটেুখুটে প্যারিসে প্রখ্যাত ‘পিগাল গ্যালারি’তে কবিগুরুর আঁকা ছবিগুলোর প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে দিলেন। এরপর আর বিজয়ার সাথে কবিগুরুর দেখা হয়নি।

রবীন্দ্রনাথের জীবনে ওকাম্পো প্রথম নারী ছিলেন না। ওকাম্পোর জীবনেও রবীন্দ্রনাথ প্রথম পুরুষ নন। বলা হয়ে থাকে, ওকাম্পো গুণী ও সুদর্শন পুরুষের প্রতি বরাবরই আসক্ত ছিলেন। অনেক সুদর্শন বিখ্যাত ব্যক্তির সাথে ওকাম্পোর প্রণয় ছিলো। প্রণয় ছিলো বিখ্যাতদের বাইরের ঘরানার মানুষদের সাথেও। কিন্তু এসব বিষয়-আশয় রবীন্দ্রনাথ-ওকাম্পোর সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। তবে ওকাম্পোকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের একটি আক্ষেপ ছিলো। কবিগুরু চাইতেন তাঁর বিজয়া শান্তি নিকেতনে আসুক, কটা দিন কাটিয়ে যাক। তিনি ওকাম্পোকে এ ব্যাপারে চিঠিও লিখেছিলেন : ‘প্রিয় বিজয়া, সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে চাই তুমি তোমার ভ্রমণসূচীতে ভারতবর্ষে রাখো একবার, আমার নিজের জায়গা শান্তিনিকেতনে এসে আমাকে দেখে যাও। অসম্ভব কেন হবে? নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে বছরের শেষ পর্যন্ত আবহাওয়া খুব ভাল এখানে, এবং তোমাকে স্বাচ্ছন্দ্যে রাখবার চেষ্টায় আমার কোন ত্রুটি হবে না...।’

কিন্তু ওকাম্পো তখন তাঁর সম্পাদিত ‘সুর’ পত্রিকাটি নিয়ে খুবই ব্যস্ত ছিলেন। ফলে ফেমিনিস্ট ওকাম্পোকে শান্তি নিকেতনে রবীন্দ্রনাথের আর দেখা হয়ে উঠেনি। হয়তো এই না আসা রবীন্দ্রনাথের সেতারে বিরহ হয়ে বেজেছিলো। বেজেছিলো কি?

এসইউ/এমএস