গত সপ্তাহে বৈরী আবহাওয়ার কারণে সমুদ্রে যেতে পারেননি জেলেরা। বর্তমানে আবহাওয়া মাছ শিকারের উপযোগী। বঙ্গোপসাগরে ধরাও পড়ছে প্রচুর ইলিশ। কিন্তু উপকূলের অন্যতম মৎস্য বন্দর কুয়াকাটা-আলীপুর ও মহিপুরে বরফের অভাবে ইলিশ ব্যবসায় বিপর্যয় দেখা দিয়েছে।
Advertisement
সরেজমিনে জানা গেছে, ভয়াবহ বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে বরফ উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে বরফ সংকটে সমুদ্রে যেতে পারছে না জেলেরা। ঘাটে বসে অলস সময় পার করছে শতাধীক ট্রলার। তারপরও দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বরফ সংগ্রহ করে কিছু ট্রলার সমুদ্রে গিয়ে মাছ শিকার করে ঘাটে ফিরলেও আহরিত ইলিশ সংরক্ষণ করতে পারছে না। ক্রেতারাও মাছ কিনতে অনিহা প্রকাশ করছে।
ক্রয়কৃত মাছ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠাতে না পারায় চরম স্থবিরতা দেখা দিয়েছে দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম ইলিশ বাজারজাত কেন্দ্র আলীপুর-মহিপুর ও কুয়াকাটায়। কেবলমাত্র ভয়াবহ বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে বরফ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
শনিবার দুপুরে কুয়াকাটা, মহিপুর ও আলীপুর ইলিশের আড়দ ও সমুদ্রগামী মাছধরা ট্রলারের জেলে এবং বরফকল মালিকদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া যায়।
Advertisement
মাছধরা ট্রলারের জেলে জাহাঙ্গীর মাঝি জানান, সাগরে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ছে। কোনোরকম জাল নিয়ে সাগরে গেলেই ট্রলার বোঝাই করে ইলিশ নিয়ে ঘাটে ফেরা যায়। কিন্তু কেবল বরফ নিতে না পারায় সাগরে যাওয়া যাচ্ছে না। ঘাটে অসংখ্য ট্রলার বসে আছে। একই অভিযোগ ফারুক মাঝি, রহিম মাঝি, জয়নাল মাঝিসহ অগণিত জেলের।
গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার ইলিশ ব্যবসায়ী সুধারাম বাবু অভিযোগের সুরে বলেন, প্রতি বছর এখানে ইলিশ কিনতে আসি। মহিপুর আলীপুর থেকে ইলিশ কিনে দেশের বিভিন্ন বাজারে ট্রাকযোগে নিয়ে বিক্রি করি। এবার বরফ না থাকায় ইলিশের ভরা মৌসুমে বসে মূলধন খাচ্ছি।
সুধারামা বাবু আরও বলেন, বিদ্যুৎ যায় কয়বার তা বলা যাবে না, বরং থাকে কতটুকু সময় সেটি বলা যায়। তাই বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নতি না হলে আগামী কয়েকদিনের মধ্যে এ বছরের মত ব্যবসা গুটিয়ে ফিরে যেতে হবে।
এদিকে গত দুদিনে খুলনা, সাতক্ষীরা, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ট্রাকযোগে বরফ আনা হয়েছে। মহিপুর হাওলাদার ফিসের মালিক আ. জলিল হাওলাদার বলেন, প্রতিদিন অন্তত ৫০ ট্রাক বরফ নিয়ে আসা হচ্ছে। মহিপুর আলীপুরের সামান্য কিছু উৎপাদিত বরফ নিয়ে যাওয়া মাছধরা ট্রলারগুলো থেকে যে ইলিশ পাওয়া যায় সেগুলো সংরক্ষণের জন্য এসব বরফ ব্যবহার করা হয়।
Advertisement
ওইসব মোকামে প্রতিক্যান বরফ ১৫০ থেকে ২শ টাকায় ক্রয় করলেও ট্রাকযোগে এখানে পৌঁছাতে প্রায় ৫শ’ টাকা খরচ হয়ে যায়। বিদ্যুৎ ব্যবস্থা অত্যন্ত খারাপ থাকায় ইলিশের ব্যবসা এবার থামকে গেছে বলেও মনে করেন জলিল হাওলাদার।
মহিপুরের ইলিশের আড়ৎ গাজী ফিস’র মালিক মজনু গাজী জানান, উপকূলের অন্তত দুই হাজার মাছধরা ট্রলার বরফের অভাবে সাগরে মাছ শিকারে যেতে পারেনি। বিদ্যুৎ আসে আবার কয়েক মিনিটের মধ্যে চলে যায়, এ অবস্থায় বরফকল গুলোতে বরফ উৎপাদন করা যাচ্ছে না।
মজনু গাজী বলেন, বর্তমানে ৫শ থেকে ৭ শ গ্রামের ব্যাপক ইলিশ ধরা পড়ছে সাগরে। অন্তত ৩৫ হাজার টাকা মণের ইলিশ আজ ২১ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে।
একই ভাবে ফয়সাল ফিসের মালিক হাজী ফজলু গাজী জানান, গত এক মাসে বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে কেবলমাত্র প্রয়োজনীয় বরফ না পাওয়ায় এক একটি মাছধরা ট্রলারে অন্তত ১০ লাখ টাকা লোকসানে পড়েছে। সে হিসেবে অন্তত ২শ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে কুয়াকাটা, মহিপুর ও আলীপুর এলাকার এবছরের ইলিশ মৌসুমে। আলীপুরের বরফকল আমেনা আইচ প্লান্টের মালিক আনোয়ার হোসেন খান বলেন, বিদ্যুতের লোডশেডিং নয়, ২৪ ঘণ্টার দু’ ঘন্টাও ঠিকভাবে বিদ্যুৎ পাওয়া যায় না। ঘনঘন বিদ্যুৎ আসা যাওয়ায় প্রতিটি বরফকলের লাখ লাখ টাকার যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে বিদ্যুৎ বিলের বোঝা তো রয়েছেই। সব মিলিয়ে বিদ্যুতের অভাবে বরফ উৎপাদন একেবারে বন্ধ রয়েছে বলা যায়। বছরের তিন মাস সাধারণত ইলিশ ধরা পড়ে। ইলিশ মৌসুমের অর্ধেক সময় ইতোমধ্যে অতিবাহিত হয়ে গেছে বলেও মন্তব্য আনোয়ার হোসেন খানের। সূত্র জানায়, কুয়াকাটা, মহিপুর ও আলীপুর মিলিয়ে অন্তত ৩৫টি বরফকল রয়েছে।
মহিপুর মৎস্য আড়ৎদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক বাবু নিমাই চন্দ্র দাস বলেন, আমার ধরণা মহিপুর আলীপুর মৎস্য বাজারজাত কেন্দ্রটি ধ্বংস করে দিতে কোনো মহল ষড়যন্ত্র করছে। প্রতিবছর ইলিশ মৌসুম এলেই বিদ্যুৎ নিয়ে নানা তালবাহানা শুরু হয়।
বিদ্যুতের ভয়াবহ বিপর্যয়ের কারণ সম্পর্কে পটুয়াখালী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) মনোহর কুমার বিশ্বাস বলেন, ঘনঘন বিদ্যুৎ যাওয়ার বিষিয়টি ছিল জাতীয় গ্রিডের সমস্যা। এছাড়া দু’ একদিন আগেও আমরা চাহিদার ২৫ শতাংশ বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারিনি।
এফএ/এমএস