আইন-আদালত

‘প্রশ্নবিদ্ধ হলে নিজেকে অযোগ্য ঘোষণা করা উচিত’

‘বিচারের বিষয়ে বিচারকের নিরপেক্ষতা নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন উঠলে নিজেকে অযোগ্য ঘোষণা করে সরে যাওয়া উচিত’। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে দেয়া পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর্যবেক্ষণে এমনটি উল্লেখ করা হয়েছে।

Advertisement

বিচারপতি অপসারণ সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে গত বছরের ৫ মে যে রায় দেন হাইকোর্ট চলতি বছরের ৩ জুলাই তা বহাল রাখেন সর্বোচ্চ আদালত। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে ৭৯৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়।

পর্যবেক্ষণে বিচারকদের আচরণবিধি সংক্রান্ত ৩২টি নির্দেশনার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। সেগুলো হলো-

১. বিচার বিভাগের সংরক্ষিত সততাও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য একজন বিচারকের উচ্চতর মান বজায় রেখে বিচারকাজে অংশগ্রহণ করা উচিত।

Advertisement

২. দেশের সংবিধান ও আইনের প্রতি সম্মান রেখে বিচারকের কাজ করা উচিত যাতে বিচার বিভাগের প্রতি জনগণের আস্থা বজায় থাকে।

৩. একজন বিচারকের রায় পারিবারিক, সামাজিক বা অন্যান্য সম্পর্কের দ্বারা প্রভাবিত হবে না। নিজের বা অন্য কারও ব্যক্তিগত স্বার্থে বিচার কাজ প্রভাবিত হবে না।

৪. আইনানুযায়ী একজন বিচারকের পেশাদারি যে এখতিয়ার বা ক্ষমতা রয়েছে তা আইনের প্রতি সম্মান ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে প্রয়োগ করতে হবে। কোনো জনগণের দাবি বা সমালোচনার ভয়ে প্রভাবিত হওয়া যাবে না।

৫. প্রত্যেক বিচারকের বিচারকাজ পরিচালনায় ধৈর্যশীল হতে হবে। সম্মান, শ্রদ্ধাবোধ ও পক্ষপাতদুষ্টহীনভাবে আইনজীবী ও সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ আচরণের মাধ্যমে বিচারকাজ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

Advertisement

৬. ঘোষিত রায় বা আদেশ প্রকাশ করতে অযাচিত বিলম্ব করা উচিত নয়। মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করা উচিত। একটি রায় ঘোষণার পর ছয় মাসের বেশি সময় পর স্বাক্ষর করা ঠিক নয়। তার আগেই স্বাক্ষর করতে হবে।

৭. মুলতবি বা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় থাকা মামলার ক্ষেত্রে বিচারককে মন্তব্য এড়াতে হবে।

৮. বিচারকের নিরপেক্ষতা যদি ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয় তবে সেই মামলার বিচারের ক্ষেত্রে নিজেই নিজেকে অযোগ্য ঘোষণা করা উচিত।

৯. কোনো ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, কোনো মামলার সঙ্গে আগে সম্পর্ক ছিল বা আগে ওই মামলায় তিনি আইনজীবী হিসেবে লড়েছেন বা মামলার কোনো পক্ষের সঙ্গে বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল এই ক্ষেত্রে নিজেকে ওই মামলার বিচারকাজে তিনি নিজেকে অযোগ্য ঘোষণা করবেন।

১০. একজন বিচারক ওই বিষয়ে শুনানি গ্রহণ করবেন না যেটায় তার স্ত্রী বা সন্তানরা ও আত্মীয়-স্বজন কোনোভাবে জড়িত থাকেন। অথবা এমন কোনো ব্যক্তি জড়িত থাকেন যার দ্বারা বিচারক প্রভাবিত হতে পারেন।

১১. বিচার বিভাগীয় ব্যবস্থায় নিরবচ্ছিন্নতা ও বিচার বিভাগীয় কার্যালয়ের শপথ রক্ষার সনদ থাকতে হবে একজন বিচারকের।

১২. বিচার কার্যালয়ের মর্যাদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ আচরণ অনুশীলন করতে হবে বিচারককে।

১৩. একজন বিচারক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিজে বা কোনো সংগঠন বা সমিতির সঙ্গে ব্যবসায় জড়িত থাকতে পারবেন না।

১৪. বিচারকের কার্যালয়ের সম্মানহানি হয় জনগণের অপ্রত্যাশিত এমন কোনো কাজ বিচারক করবেন না। অবশ্যই তাকে সচেতন থাকতে হবে যে তিনি জনগণের নজরদারির মধ্যে আছেন।

১৫. দেশ-বিদেশের কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে কোনো বিচারক জড়িত থাকতে পারবেন না।

১৬. একজন বিচারকের সম্পদ ও দায়-দায়িত্ব নিয়ে প্রধান বিচারপতির কাছে জবাবদিহিতা থাকতে হবে।

১৭. শুধু বিচার করলেই হবে না। দৃশ্যমান হতে হবে যে একজন বিচারক ন্যায় বিচার করেছেন। উচ্চ আদালতের বিচারকের জনগণের বিশ্বাসকে বিবেচনা করতে হবে। নিরপেক্ষতার সঙ্গে তা করতে হবে।

১৮. আইনজীবী সমিতির কোনো সদস্যের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক রয়েছে এমন কেউ তার আদালতে মামলা পরিচালনা করলে সেটা পক্ষদোষে দোষী হবে।

১৯. একজন বিচারকের স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে, শ্যালক, শ্যালিকা বা ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজন যারা আইনজীবী সমিতিতে অনুশীলন করেন তাদের কাউকে তার আদালতে মামলা পরিচালনার অনুমতি ওই বিচারক দেবেন না।

২০. পরিবারের সদস্য নয়, কিন্তু আইনজীবী সমিতির সদস্য এমন কোনো ব্যক্তিকে কোনো বিচারক তার বাসস্থানে রাখতে পারবেন না।

২১. একজন বিচারক জনবিতর্কে অংশ নিতে পারবেন না। প্রকাশ্যে কোনো রাজনৈতিক বিতের্কও অংশ নিতে পারবেন না। এমনকি বিচার বিভাগে মুলতবি রয়েছে এমন কোনো বিষয়েও বিতের্ক জড়াতে পারবেন না।

২২. একজন বিচারক রায় দেবেন, নিজেদের মধ্যে কথা বলবেন। কিন্তু কোনোভাবেই গণমাধ্যমে সাক্ষাতকার দেবেন না।

২৩. বিচারক যদি কোনো মামলায় সিদ্ধান্ত দিতে অক্ষম হন তাহলে তিনি ওই মামলা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেবেন।

২৪. একজন বিচারক নিজেই যুক্তিসঙ্গত পর্যবেক্ষণ দ্বারা নির্ধারণ করবেন যে তার আচরণ বা তিনি যা করছেন তা সঠিক।

২৫. একজন বিচারককে তার আচরণ ও কাজ দিয়ে বিচার বিভাগের মর্যাদা ও জনগণের বিশ্বাস অর্জন করতেহবে।

২৬. অসদাচরণ ও অযৌক্তি কার্যাবলী থেকে একজন বিচারক সব সময় বিরত থাকবেন।

২৭. সাধারণ জনগণের কথা বিবেচনা করে ন্যায় বিচারের স্বার্থে একজন বিচারকের ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতা গ্রহণ করে কাজ করা উচিত।

২৮. জজ আদালতে অনুশীলন (মামলা পরিচালনা করেন) করেন এমন কোনো নিকটাত্মীয়কে বিচারকের এড়িয়ে চলা উচিত। যাতে কোনো প্রকার পক্ষপাতিত্বের সন্দেহ কেউ করতে না পারে।

২৯. বিচারকের পরিবারের কোনো সদস্য যদি কোনো মামলার কোনো পক্ষের প্রতিনিধিত্ব করে তাহলে ওই বিষয়ে বিচারক অংশ নিতে পারবেন না।

৩০. আইন পেশায় জড়িত রয়েছেন এবং মক্কেল গ্রহণ করেন এমন কোনো ব্যক্তিকে বিচারকের বাসস্থানে স্থান দেবেন না।

৩১. একজন বিচারকের পরিবারের কোনো সদস্যকে তার আদালতের কোনো বিষয়ে সামাজিক বা অন্যকোনো সম্পর্কের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার অনুমতি দেবেন না।

৩২. একজন বিচারক কারও সম্পদ ব্যবহার করতে পারবেন না বা কারও কাছ থেকে ঋণ নিতে পারবেন না।

এফএইচ/এমএআর/জেআইএম