নওগাঁর সীমান্তগুলোতে চোরাচালান প্রবণতা বেড়েই চলেছে। সামনে কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে ভারত থেকে অবৈধভাবে গরু আনার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশি গরু ব্যবসায়ীরা আটক হচ্ছেন।
Advertisement
গত মাসে (জুলাই) নওগাঁর পোরশা ও সাপাহার সীমান্ত এলাকা থেকে এক রাখালসহ ১০ বাংলাদেশি গরু ব্যবসায়ীকে আটক করেছে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। আহতাবস্থায় একজন পালিয়ে এসেছে। আটকদের ভারতের বিভিন্ন থানায় সোপর্দ করা হয় বলে জানা গেছে।
পত্নীতলা বিজিবি-১৪ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালে জানুয়ারি-জুলাই পর্যন্ত বিএসএফের হাতে ২৭ জন বাংলাদেশি আটক হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কোন নিহতের ঘটনা ঘটেনি। এছাড়া ২০১৬ সালে আটক হয় ৩ জন ও নিহত হয় ২ জন। ২০১৫ সালে আটক হয় ৯ জন ও নিহত হয় ৫ জন। ২০১৪ সালে আটক হয় ১৫ জন ও নিহত হয় ২ জন।
সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর মধ্যে ভারতের খুবই নিকটবর্তী নওগাঁ জেলা। এ জেলার সঙ্গে ভারতের নয়টি সীমান্ত অবস্থিত। এগুলো হচ্ছে- সাপাহার উপজেলার হাঁপানিয়া ও করমুডাঙ্গা সীমান্ত, পোরশা উপজেলার নীতপুর সীমান্ত এবং ধামইরহাট উপজেলার কালুপাড়া, চকিলাম, চকচণ্ডি, বস্তাবর, শিমুলতলী ও তালান্দার সীমান্ত।
Advertisement
জানা গেছে, অবৈধভাবে গরু পারাপারে বেশি ব্যবহার হয় সাপাহার উপজেলার হাঁপানিয়া ও করমুডাঙ্গা সীমান্ত এবং পোরশা উপজেলার নীতপুর সীমান্ত। মাদক পাচারে ধামইরহাট উপজেলার সীমান্তগুলো ব্যবহৃত হয়।
অবৈধভাবে রাতের অন্ধকারে ভারত থেকে বাংলাদেশি গরু ব্যবসায়ীরা গরু নিয়ে আসায় বিএসএফের হাতে মাঝে মধ্যে হতাহতের ঘটনা ঘটত। বিজিবির পক্ষ থেকে বিএসএফের সঙ্গে বেশ কয়েকবার বৈঠক ও আলোচনার পর হত্যা-নির্যাতন বন্ধ হয়।
এদিকে এক বছর পূর্বে সাপাহার উপজেলায় একটি বিট করিডোর খাটাল স্থাপন করা হয়েছিল। সে সময় করিডোরটি মাত্র ছয় মাস চলার পর সেখান থেকে সরকার কয়েক কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করে। কিন্তু এলাকার কিছু অর্থলোভী ও স্বার্থান্বেষী মহল অবৈধভাবে ভারত অনুপ্রবেশ করে গরু চুরিসহ নানা অনিয়মের কারণে করিডোরটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর থেকে চোরাকারবারিরা বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিবি) চোখ ফাঁকি দিয়ে চোরাই পথে গরু আনা অব্যাহত থাকে। ফলে প্রতিনিয়ত সীমান্ত এলাকায় বাংলাদেশি গরু ব্যবসায়ীরা আটক হচ্ছে।
সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত গ্রামগুলো বেশির ভাগ নিম্নবৃত্ত ও অশিক্ষিত। সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোর মধ্যে কৃষ্ণসদা, করমুডাঙ্গা, কামাচপুর, বেলডাঙ্গা, দুয়ারপাল ও টেকঠা। আধুনিকতার শিক্ষা ও চিকিৎসা ব্যবস্থা থেকেও তারা বঞ্চিত। ফলে অসাধু কিছু গরু ব্যবসায়ী স্থানীয় যুবকদের প্রলোভন দিয়ে ভারত থেকে গরু নিয়ে আসার জন্য উদ্ভূত করে। প্রতি গরুতে ৩-৪ হাজার টাকার বিনিময়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভারত থেকে নিয়ে আসে তারা। অবৈধভাবে গরু নিয়ে আসতে কিছু অসাধু বিজিবি সদস্য সহযোগিতা করে বলেও অভিযোগ আছে।
Advertisement
গরু বিক্রির লাভের একটি মোটা অংশ চলে যায় ব্যবসায়ীদের পকেটে। ফলে তারা আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ বনে যায়। আর বিএসএফের হাতে নিহতদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তিদের হারিয়ে এখন প্রায় নিঃস্ব। ভারত থেকে চোরাই পথে গরু নিয়ে আসার সুবাদে রাখালদের সঙ্গে সেখানকার ব্যবসায়ীদের একটা সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। একসময় রাখালই গরু ব্যবসায়ী হয়ে যায়। অনেকে আবার ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বাকিতে গরু নিয়ে আসে। হাটে গরু বিক্রির পর টাকা পরিশোধ করে। আর অবৈধভাবে গরু নিয়ে আসায় সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারায়।
চোরাকারবারিদের সঙ্গে গত চার বছর আগে কৃষ্ণসদা গ্রামে বিএসএফের মারপিটের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিএসএফ সদস্যরা কৃষ্ণসদা গ্রামে প্রবেশ করে সাধারণদের ওপর হামলা চালিয়ে গুলি করে। এতে ওই গ্রামের তিনজন নিহত হয়। এরপর সেখানে বিজিবির পক্ষ থেকে একটি অস্থায়ী ক্যাম্প চালু করা হয়। তবে সেখানে বিজিবি সদস্য থাকেন না। অথচ প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে হাঁপানিয়া-১৪ ক্যাম্প অবস্থিত।
সাপাহার উপজেলার হাঁপানিয়া সীমান্তের কৃষ্ণসদা গ্রামের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রাখাল বলেন, ভারতে হাতিডাঙা নদী পার হয়ে প্রায় ৫ কিলোমিটার অভ্যন্তরে গরু ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বাংলাদেশি গরু ব্যবসায়ীরা ৫-৬ হাজার টাকায় গরু কিনে। এরপর আমার মতো অনেক রাখালকে দিয়ে চোরাইপথে গরু নিয়ে আসে। সেখানে গরু প্রতি ভারতের বিএসএফকে দিতে হয় ২০ হাজার টাকা। এরপর বাংলাদেশের বিভিন্ন হাট-বাজারে গরু মোটা টাকায় বিক্রি করে চোরাকারবারীর লাইনম্যান পান ১০-১২ হাজার টাকা। আর আমরা রাখাল পাই ৩-৪ হাজার টাকা। যা খুবই সামান্য। এ পর্যন্ত কোনো সমস্যায় পড়িনি। এখন প্রতি রাতে প্রায় ৪০০-৫০০টি গরু পারাপার হচ্ছে।
কৃষ্ণসদা গ্রামের তৈয়মুর রহমান বলেন, বিশেষ করে কোরবানির ঈদের আগে রাতে আধারে চোরকারবারীরা প্রচুর গরু বাংলাদেশে নিয়ে আসে। ফলে আমাদের ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। আর আমাদের বাড়ির গরু হাট-বাজারে বিক্রি করতে গেলে সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়। গরুর কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও বিজিবি তা আটক করে কাস্টমে জমা করে। স্থানীয় চেয়ারম্যান-মেম্বারদের সুপারিশ দিয়েও কোনো লাভ হয়না। যদি পুনরায় করিডোর খাটাল চালু করা হয় তাহলে সমস্যা দূর হবে বলে মনে করি।
অস্থায়ী ক্যাম্পের পাশেই বসবাসকারী গৃহবধূ ফাহেমা খাতুন বলেন, প্রথমে যখন ক্যাম্প করা হয়েছিল বিজিবি সদস্যদের নিয়মিত দেখা যেত। এখন আর বিজিবি সদস্যদের তেমন দেখা যায়না। যার কারণে এ এলাকা দিয়ে চোরাচালান বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্যাম্পে যদি বিজিবি সদস্য নিয়মিত থাকে তাহলে এলাকায় চোরাকারবারীর ঘটনা ঘটতনা।
সাপাহার উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সামছুল আলম শাহ চৌধূরী বলেন, একটি খাটালের অনুমোদন থাকলেও তা বন্ধ আছে। যার কারণে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর কারণে চোরাচালান বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা ঘরে বসে থেকে সামান্য কিছু টাকা রাখালকে দেয়ার প্রলোভন দিয়ে ভারতে পাঠায়। এতে প্রায় অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটছে। আর তাদের কারণে এলাকাবাসীর বাড়ির গরু হাটে বিক্রি করতে গিয়েও সমস্যায় পড়তে হয়। বিজিবি-১৪ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল ইঞ্জিনিয়ার খিজির খান বলেন, কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে সীমান্ত এলাকায় অপরাধ প্রবণতা একটু বেড়েছে। অবৈধভাবে ভারতে অনুপ্রবেশ করে গরু আনতে গিয়ে নওগাঁ সীমান্ত এলাকায় বাংলাদেশিরা আটক হচ্ছেন। তবে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সীমান্ত এলাকায় বিজিবির টহল জোরদার করা হয়েছে। সেই সঙ্গে মানুষকে সচেতন করতে সীমান্ত মানুষদের সঙ্গে নিয়মিত মতবিনিময় করা হচ্ছে।
সীমান্ত অপরাধ, চোরাচালান ও মাদক প্রতিরোধে গত ২৭ জুলাই হাঁপানিয়া ক্যাম্পে এলাকাবাসীর সঙ্গে মতবিনিময় করেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) উত্তর-পশ্চিম রিজিয়ন রংপুরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক একেএম সাইফুল ইসলাম।
তিনি বলেন, ভারতের অভ্যন্তরে অবৈধ অনুপ্রবেশ করে ওই দেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর হাতে আটক হয়ে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে। সীমান্ত দিয়ে বৈধভাবে গরু বা অন্য কোনো ভারতীয় পণ্য নিয়ে আসতে বিজিবির কোনো বাঁধা নেই। তবে অবৈধভাবে কোনো বাংলাদেশিকে সীমান্ত রেখা পার হতে দেয়া হবে না। বৈধভাবে গরু আনতে সাপাহার সীমান্ত এলাকায় ঈদুল আজহার আগেই খাটাল (করিডর) করে দেয়া হবে।
তিনি আরও বলেন, যদি বিজিবির কোনো সদস্য চোরাকারবারী বা অসাধুদের সঙ্গে জড়িত থাকে প্রমাণ পেলে তাকে চাকরি থেকে সরিয়ে দেয়া হবে।
আব্বাস আলী/এমএএস/আরআইপি