অর্থপাচার, সন্ত্রাসে অর্থায়ন, চাঁদাবাজি আর প্রতারণার অবৈধ লেনদেনের সহজ মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা ‘বিকাশ’। নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে বারবার নির্দেশনা সত্ত্বেও পাত্তা দিচ্ছে না প্রতিষ্ঠানটি।
Advertisement
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের করা নিয়মনীতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে রমরমা অবৈধ বাণিজ্য করছে প্রতিষ্ঠানটি। এক পরিচয়ে শুধু একাধিক অ্যাকাউন্টই নয়, অবৈধ এজেন্টও রয়েছে বিকাশের। ফলে নিরাপত্তা প্রশ্নে বাংলাদেশ ব্যাংকের সব উদ্যোগই বিফলে যাচ্ছে। তাই প্রতিষ্ঠানটির স্বেচ্ছাচারিতা ঠেকাতে ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, একজন গ্রাহক তার জাতীয় পরিচয়পত্রের মাধ্যমে বিকাশ, রকেট, শিওর ক্যাশ, মাইক্যাশসহ প্রতিটি কোম্পানির জন্য একটির বেশি হিসাব খুলতে পারবেন না। এ নিয়ম মানছে না দেশের মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলো। ‘বিকাশ’ এর মধ্যে অন্যতম।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমাদের নির্দেশনা সত্ত্বেও একটি জাতীয় পরিচয়পত্রের মাধ্যমে একাধিক হিসাব খোলা হচ্ছে। এর মাধ্যমে বিকাশসহ অন্যান্য এজেন্ট আইন লঙ্ঘন করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবার এ অনিয়ম বন্ধে উদ্যোগ নিয়েছে।
Advertisement
উদ্যোগের অংশ হিসেবে একাধিক অ্যাকাউন্ট ব্যবহারকারীর সংখ্যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জানানোর জন্য শিগগিরই মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশনা দেয়া হবে। এর মাধ্যমে গ্রাহকের প্রকৃত সংখ্যা ও পরিচয় জানা যাবে। প্রতারণাও বন্ধ হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, একাধিক সিম ও পরিচয়পত্রের মাধ্যমে একাধিক হিসাব খুলে অর্থ আত্মসাৎ করছে বেশ কয়েকটি প্রতারক চক্র। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্দেশিত কেওয়াইসি ফরম যথাযথভাবে পূরণ না করেও এজেন্ট হচ্ছেন অনেকে, যা প্রতারণার অন্যতম হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে দুবাই ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে পাঠানোর নামে অপহরণসাপেক্ষে মুক্তিপণ আদায় করছে অসাধু একটি চক্র। এ অর্থ আদায় করা হচ্ছে ব্যাংকের সাবসিডিয়ারি মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে।
দেশের জেলা ও উপজেলা থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে মোবাইল ব্যাংকিং সিস্টেম ‘বিকাশ’র মাধ্যমে হুন্ডির শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। যার প্রভাব পড়েছে প্রবাসী আয় রেমিট্যান্সের ওপর। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিকাশের লোগোসহ সাইনবোর্ড ও ব্যানার ব্যবহারের মাধ্যমে অর্থ লেনদেন হচ্ছে। যার কোনো অনুমোদন নেই। বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাই হুন্ডি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বিকাশ এজেন্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দিয়েছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাটি।
Advertisement
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা জাগো নিউজকে বলেন, মালয়েশিয়া, কাতারসহ বেশ কয়েকটি দেশে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের অন্যতম মাধ্যম ‘বিকাশ’র নাম ব্যবহার করে অবৈধ লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ এটি। তাই এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বিকাশের অবৈধ লেনদেন বন্ধের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে বিকাশসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে যেসব অনিয়ম হচ্ছে তা নিজ উদ্যোগে বন্ধের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে প্রযোজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, মোবাইল ব্যাংকিংয়ে নিরাপত্তা জোরদার এবং এসব অনিয়ম নিয়ন্ত্রণে নীতিমালা করা হয়েছে। নীতিমালা যারা না মানবেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বিকাশের হেড অব কর্পোরেট কমিউনিকেশনস শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম এ প্রসঙ্গে জাগো নিউজকে বলেন, বিকাশ বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম মেনেই ব্যবসা পরিচালনা করছে। এজেন্টদের কর্মকাণ্ডের ওপর নিয়মিত মনিটরিং করা হয়। এরপরও কোনো এজেন্ট যদি নিয়ম মেনে না চলেন তবে অভিযোগের ভিত্তিতে এবং তদন্ত-সাপেক্ষে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
তিনি আরও বলেন, বিকাশে হুন্ডির মাধ্যমে অবাধ লেনদেন হচ্ছে- অভিযোগটি সঠিক নয়। তবে কিছু অসাধু ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা চক্র বিদেশে নিজেদের বিকাশ এজেন্ট পরিচয় দিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশিদের অবৈধ মাধ্যম ব্যবহার করে দেশে টাকা পাঠাতে প্ররোচিত করছে। বিকাশের সঙ্গে ওইসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কোনো সম্পর্ক নেই। বাংলাদেশের বাইরে বিকাশের কোনো এজেন্ট বা বুথও নেই।
ওই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানিয়ে সংশ্লিষ্ট আটটি দেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসে চিঠি দিয়েছে বিকাশ। যারা অনুমোদনহীনভাবে বিকাশ লোগো ব্যবহার করে প্রতারণা করছে তাদের বিরুদ্ধে আইনি নোটিশ প্রেরণ করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম আরও বলেন, গুটিকয়েক দুষ্টচক্র বিকাশের সেবার অপব্যবহার করছে। মোবাইল ফোন প্রযুক্তির অপব্যবহার করে কল দিয়ে অথবা ভুয়া মেসেজ প্রদান করে কিছু অপরাধী চক্র মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্ট/গ্রাহকদের প্রতারণার ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করছে। বিকাশ কর্তৃপক্ষ প্রতারণার এ বিষয়ে অবগত।
বিকাশের পক্ষ থেকে প্রতারণা এড়াতে নিয়মিত গ্রাহকদের সচেতনতার পাশাপাশি সতর্কতামূলক বিভিন্ন পরামর্শও দেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।
সহজ ও দ্রুত হওয়ায় এবং মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মূল্য পরিশোধের সুবিধা থাকায় এ ধরনের ব্যাংকিংয়ের জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে। বিপুলসংখ্যক গ্রাহক জড়িয়ে পড়েছেন মোবাইল ব্যাংকিংয়ে। তবে আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে, এ পদ্ধতিতে অর্থ লেনদেনে গ্রাহকের কোনো তথ্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বা প্রতিষ্ঠানের কাছে নেই। ফলে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে জালিয়াতি বন্ধ হচ্ছে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) মাধ্যমে প্রতিদিন গড় লেনদেনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক হাজার কোটি টাকা। দৈনিক গড় লেনদেনের সংখ্যা ৬০ লাখ ৬৪ হাজার। বর্তমানে এমএফএস এজেন্ট সংখ্যা সাত লাখ ৫৮ হাজার এবং মোট গ্রাহক সংখ্যা পাঁচ কোটি ৩৭ লাখ। এমএফএস প্রদানরত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১৭টি।
এসআই/এমএআর/আরআইপি