আইন-আদালত

নিম্ন আদালত নিয়ন্ত্রণে ‘রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সংবিধান পরিপন্থী’

বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালনরত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বিধানে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সংবিধানের পরিপন্থী বলে রায় দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।

Advertisement

ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ে এমন মতামত তুলে ধরেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহা। ওই মামলায় সাত বিচারপতির মধ্যে প্রধান বিচারপতি তার রায়ের অংশে এ মতামত দেন।

এ মতামতের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার। তবে প্রধান বিচারপতির এ মতের সঙ্গে একমত হতে ‘অক্ষমতা’প্রকাশ করেছেন বেঞ্চের অন্য বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। এ মামলার বিষয়বস্তু না হওয়ায় ১১৬ অনুচ্ছেদের বিষয়ে মতামত দেয়া থেকে বিরত থাকার কথা বলেছেন বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা এবং বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। তারা বলেছেন, এখানে অন্য ইস্যু নিয়ে সিদ্ধান্ত দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে ১১৬ অনুচ্ছেদ বিষয়ে কিছুই বলেননি বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী।

এদিকে রায় প্রকাশের পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, প্রধান বিচারপতি রায়ের এক জায়গায় অনুচ্ছেদ ১১৬ সম্পর্কে বলেছেন, এটা সংবিধান পরিপন্থী। কিন্তু রায়ের শেষাংশে যেখানে সবাই একমত হয়েছেন সেখানে এটা পেলাম না। তিনি বলেন, রায়ের ভিতরে যাই বলা থাকুক না কেন, রায়ের সমাপনীতে কি বলা আছে সেটি দেখতে হবে। অর্ডার অব দ্য কোর্ট কোনটা, সেখানে কিন্তু ১১৬ সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। তিনি বলেন, আমি বলব এটা একজন জাজের অভিমত হতে পারে। কিন্তু রায়ের শেষাংশে, যেটাকে অর্ডার অব দ্য কোর্ট আমরা বলি, সেখানে ১১৬ সম্পর্কে বলা হয়নি। তাহলে ১১৬ বাতিল হয়েছে বলে ধরা যায় না। মাহবুবে আলম আরও বলেন, ১১৬ ধারা যদি বাতিল করলে সবাইকে সেখানে সই করতে হতো। অর্ডার অব দ্য কোর্ড তাই হতো।

Advertisement

এক প্রশ্নের উত্তরে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘১১৬ অনুচ্ছেদ তো কোনো ইস্যু ছিল না। ইস্যু ছিল ৯৬ অনুচ্ছেদ। ইস্যু না থাকলেও রায়ে বিষয়টি আসতে পারে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা উচিত নয়। সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালরত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলাবিধান রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত থাকিবে এবং সুপ্রিম কোর্টের সহিত পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তাহা প্রযুক্ত হইবে।’

রায়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, চতুর্থ সংশোধনীতে ১১৬ অনুচ্ছেদে ‘সুপ্রিম কোর্ট’র পরিবর্তে ‘রাষ্ট্রপতি’শব্দটি প্রতিস্থাপন করে নিম্ন আদালতের স্বাধীনতাকে হত, সঙ্কুচিত, কুঠারের নিচে (whittled down) ফেলা হয়েছে। এটা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর লঙ্ঘন এবং ‘রাষ্ট্রপতি’শব্দ প্রতিস্থাপন সংবিধানের পরিপন্থী।

এর আগে সকালে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়। আজ মঙ্গলবার ৭৯৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় ওয়েবসাইটে পাওয়া যাবে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে থাকছে না। এ ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে ন্যস্ত করে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। এর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল ৩ জুলাই খারিজ করে দিয়েছেন আপিল বিভাগ।

বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী জাতীয় সংসদে পাস হয়। ‘বিচারকদের পদের মেয়াদ’সংক্রান্ত ষোড়শ সংশোধনী বিল অনুসারে, সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের ২ দফায় বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতাসংক্রান্ত বিধান রাখা হয়েছে। এতে বলা হয়, ‘প্রমাণিত ও অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের কারণে সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দ্বারা সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ ব্যতীত কোনো বিচারককে অপসারিত করা যাবে না।’৩ দফায় বলা হয়েছে, এই অনুচ্ছেদের (২) দফার অধীন প্রস্তাব-সম্পর্কিত পদ্ধতি এবং কোনো বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করবে। একই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়।

Advertisement

ওই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একই বছরের ৫ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের নয়জন আইনজীবী হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১৬ সালের ৫ মে হাইকোর্টের তিনজন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন।

এ রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ গত ৪ জানুয়ারি আপিল করে। আপিলের ওপর গত ৮ মে শুনানি শুরু হয়, যা ১১তম দিনে গত ১ জুন শেষ হয়। ওইদিন আদালত মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখেন। গত ৩ জুলাই রায়ের সংক্ষিপ্তসার ঘোষণা করেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা।

এফএইচ/ওআর/এমএস