সুপ্রিম কোর্টের রায়ে অযোগ্য ঘোষিত হওয়ার পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের পদত্যাগে বাংলাদেশের অনেকেই দেখি বেশ উল্লসিত। অবশ্য উ্ল্লসিত হওয়ার মতই ঘটনা। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে গদি উল্টে যায় জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর! এমন স্বাধীন বিচার বিভাগই তো চাই। কিন্তু আপনারা লোক ভালো, সাদা মনে, সাদা চোখে পাকিস্তানের বিচার বিভাগকে যত স্বাধীন মনে করছেন; আমি লোক খারাপ, আমি ততটা উল্লসিত হতে পারছি না। আমি বিচার বিভাগের আড়ালে অন্য কারো কালো ছায়া দেখে উল্লসিত নই, শঙ্কিত হই। প্রায় ব্যর্থ রাষ্ট্র পাকিস্তানের তিনটি অঙ্গ। নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ ও সেনা বিভাগ। এই সেনা বিভাগ মাঝে মাঝে বিচার বিভাগের কাঁধে বন্দুক রেখে নির্বাহী বিভাগকে ঘায়েল করে। সেখানে কোনো বিভাগই স্বাধীন নয়, সেনা বিভাগ ছাড়া।
Advertisement
পাকিস্তানে দুটি বিভাগের প্রধান সময়মত যেতে পারেন না। নির্বাহী বিভাগের প্রধান মানে প্রধানমন্ত্রীকে যেতে হয় মেয়াদপূর্তির আগে। আর সেনা বিভাগের প্রধান মানে সেনাপ্রধান মেয়াদপূর্তির পর প্রায়শই এক্সটেনশন নেন বা পান। পাকিস্তানের ৭০ বছরের ইতিহাসে ১৮ জন প্রধানমন্ত্রীর কেউই মেয়াদপূর্তি করতে পারেননি। এরমধ্যে নওয়াজ শরীফ তো রীতিমত বিশ্ব রেকর্ড গড়েছেন। দান দান তিন দান তাকে মেয়াদ শেষ করার আগেই বিদায় নিতে হলো। ১৯৪৭ সালে স্বাধীন হওয়ার পর থেকে গত ৭০ বছরেই আসলে পাকিস্তান সেনা নিয়ন্ত্রিত, কখনো প্রত্যক্ষভাবে কখনো পরোক্ষ। যখনই কেউ মাথা উঁচু করার চেষ্টা করেছেন, সেনাবাহিনী তাকে দমন করেছে নিষ্ঠুরভাবে। কখনো সরাসরি, কখনো বিচার বিভাগের ঘাড়ে বন্দুক রেখে।
পচা শামুকে পা কাটা বলতে যা বোঝায়, নওয়াজ শরীফের তাই হয়েছে। গতবছর পানামা পেপারস কেলেঙ্কারিতে বিশ্বজুড়ে ঝড় বয়ে গেলেও তা মিলিয়েও গিয়েছিল বুদবুদের মত। পাকিস্তানেই শুধু সেটি আলাদা করে রাখা হয়েছিল, যৌথ তদন্ত দল তদন্ত করেছে, সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছে নওয়াজ শরীফ ‘সৎ’ নন। পাকিস্তানের সংশোধিত সংবিধানের ৬২ অনুচ্ছেদে প্রধানমন্ত্রী, এমপি হওয়ার যোগ্যতা-অযোগ্যতার বর্ণনা আছে। আরো অনেক শর্তের সাথে এও আছে, কেউ ‘সৎ’ না হলে, তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না, এমপি হতে পারবেন না, নির্বাচন করতে পারবেন না। নওয়াজ শরীফকে ঘায়েল করার জন্য যৌথ তদন্ত দল মাত্র ৬০ দিনে কয়েক শত পৃষ্ঠার নথি পর্যালোচনা করেছে, তদন্ত করেছে। সেই তদন্তে সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়ে দিয়েছে নওয়াজ শরীফ সৎ নন।
মজাটা হলো তদন্ত শেষ হয়েছে, এখনও কিন্তু বিচার শুরু হয়নি। বিচার শুরু হবে কোত্থেকে, এখনও তো মামলাই শুরু হয়নি। সুপ্রিম কোর্ট অবশ্য নওয়াজ শরীফ ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা শুরুর নির্দেশ দিয়েছে। মামলার পর বিচারে নওয়াজ শরীফ দোষীও হতে পারেন, নাও পারেন। কিন্তু বিচারের আগেই তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় রায় দেয়া হয়ে গেছে। পাকিস্তানের সংবিধানের ‘৬২’ অনুচ্ছেদে ‘সততা’র কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। এরকম ঢালাও অনুচ্ছেদ দিয়ে শুধু নওয়াজ শরীফ নন, পাকিস্তানের ৯৯ ভাগ মানুষকে অসৎ বলা যাবে। সৎ বাছতে গা উজার হয়ে যাবে। শুধু পাকিস্তান কেন, এই উপমহাদেশের অধিকাংশ রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধেই জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। কালেভদ্রে প্রমাণিত হয়, বেশিরভাগই প্রমাণিত হয় না। নওয়াজ শরীফ প্রমাণিত হওয়ার আগেই চাকরি হারালেন। বেচারা।
Advertisement
আপনারা কেউ ভাববেন না সেনাবাহিনীকে দায়ী করতে গিয়ে আমি নওয়াজ শরীফকে ধোয়া তুলসি পাতা মনে করছি। নওয়াজ শরীফ পাক-পবিত্র নন। পাকিস্তানের আর সব রাজনীতিবিদের মত তার বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ ছিল, আছে, থাকবে। তবুও তিনিই ছিলেন দেশের জনগণের ভোটে নির্বাচিত এবং সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী। শুধু পাকিস্তান কেন, সব দেশেই পানামা পেপার্সে যাদের নাম এসেছে, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত হোক, মামলা হোক, ব্যবস্থা নেয়া হোক; দুর্নীতিবাজদের রাজনীতি থেকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখা হোক। কিন্তু যখন সেনাবাহিনী আর আইএসআই’এর প্রতিনিধিদের দিয়ে যৌথ তদন্ত দল গঠিত হয়, তখন আর কারো বুঝতে বাকি থাকে না; কেন এই তদন্ত, টার্গেট কী? বুঝতে অসুবিধা হয় না ইমরান খান কাদের প্রশ্রয়ে, কাদের স্নেহে নওয়াজের পেছনে লেগে থাকেন। নওয়াজ শরীফ জানেন আগেই রায় ঠিক করা এই মহা তদন্তের পেছনে কাদের হাত। তাই সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর সুরসুর করে তিনি পদত্যাগ করে বসেন। জানেন, নইলে হয়তো পদত্যাগ করারও সুযোগ পাবেন না বা আবারও হয়তো নির্বাসনে যেতে হবে। নিজে পদত্যাগ করলেও, তার দল মুসলিম লীগ ক্ষমতায় আছে, প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন তার ভাই শাহবাজ শরীফ। আচ্ছা ‘সৎ’ নন এমন একজন ব্যক্তির ভাই প্রধানমন্ত্রী হলে কেমন লাগবে পাকিস্তানীদের?
আপনারা হয়তো আবারও বলতে পারেন, আপনি যে এত সন্দেহের কথা বলছেন, কই নওয়াজ শরীফকে হটিয়ে তো সেনাবাহিনী ক্ষমতা নেয়নি। খুব শিগগিরই নেবে, এমন কোনো ইঙ্গিতও তো দেখা যাচ্ছে না। আরে ভাই, সরাসরি ক্ষমতায় না এসেও যদি সর্বময় ক্ষমতা ভোগ করা যায়, তাহলে কোন বোকা সেনা শাসনের বদনাম ঘাড়ে নেয়? পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রশ্নহীন আনুগত্য চায়। সেখানে নওয়াজ শরীফ একটু মোচরামুচরি করছিলেন। নওয়াজ শরীফের হাজারটা অপরাধ থাকতে পারে। কিন্তু তিনি পাকিস্তানের অন্যদের চেয়ে শান্তিকামী। তিনি তালেবানদের কম প্রশ্রয় দেন। তিনি ভারতের সাথে শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন, অন্তত আলোচনার পথ খোলা রাখেন। এখানেই নওয়াজ সেনাবাহিনীর পথের কাটা হয়ে যান।
তালেবানদের নিয়ে খেলতে না পারলে সেনাবাহিনীর আর দাম থাকে কি? আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সকল ক্ষমতার উৎস তো অন্ধ ভারত বিরোধিতা। এই জিহাদী জোশ জিইয়ে না রাখতে পারলে সেনাবাহিনীকে সে দেশের মানুষ ভালোবাসবে কেন? নওয়াজ শরীফ আসল জায়গায় হাত দিয়েছিলেন। তিনি সফল হলে পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর প্রভাব দীর্ঘস্থায়ীভাবে কমে যেতে পারতো, টেকসই হওয়ার পথে যাত্রা শুরু করতে পারতো সে দেশের গণতন্ত্র। নওয়াজের এত বড় ‘ষড়যন্ত্র’ কিভাবে সইবে সেনাবাহিনী। তাই তো পাকিস্তানের বিচার বিভাগের এমন হঠাৎ বিপ্লবী হয়ে ওঠা। বলতে পারেন, পাকিস্তানের বিচার বিভাগ তো আগেও বিপ্লবী হয়েছে, ইউসুফ রাজা গিলানীকেও্তো বিদায় নিতে হয়েছে বিচার বিভাগের নির্দেশে। ঠিক ঠিক। পাকিস্তানের বিচার বিভাগ সবসময় নিরীহ নির্বাহী বিভাগের প্রতি বিপ্লবী, প্রবল সেনা বিভাগের প্রতি সদয়। জন্মের পর থেকে পাকিস্তানে বারবার ক্যু হয়েছে। আগে হতো সামরিক ক্যু, এবার হলো বিচারিক ক্যু। সময় বদলেছে, কৌশলও বদলেছে।
২৯ জুলাই, ২০১৭probhash2000@gmail.com
Advertisement
এইচআর/পিআর