মতামত

বুদ্ধিমান হন, সুরক্ষিত থাকুন

যে কোন দুর্যোগে বিপদ কতটুকু হতে পারে, তার আনুমানিক হিসাব বা আন্দাজ করার চেষ্টা কেবল বুদ্ধিমানরাই করেন। দুর্যোগ কত বেশি বা কম হবে, তা নির্ভর করে যার উপর দুর্যোগ ঘটবে, তিনি দুর্যোগ সহ্য করতে কতখানি সক্ষম। দুর্বলের বিপদ বেশি। দুর্বলকে তাই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার অভিধানে ‘ভালনারেবল’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। কেউ তখনি সবল, যখন তার ‘ভালনারেবল’ হওয়ার ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে কম। কেউ তখনি সুরক্ষিত, যিনি দুর্যোগ ঠেকাতে কম ভালনারেবল। তুমুল বৃষ্টিতে পাহাড় ধসে গেল, যে মানুষগুলো বেশি ভালনারেবল ছিলেন, তারাই মারা পড়লেন। ব্যাপক বন্যার পুর্বাভাস পাচ্ছি। সাত তলার বাসিন্দার ভালনারেবিলিটি বা দুর্বলতার মাত্রা কম, যদিও নদীর পাড়ে কাঁচা মাটির ঘরের বাসিন্দা বন্যার কারণে সুরক্ষিত কম বলে বেশি ভালনারেবল। আবার সাত তলার বাসিন্দা ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে ঐ কাঁচা ঘরের বাসিন্দার চেয়ে বেশি ভালনারেবল, কেননা ভূমিকম্পে ভূগর্ভে কাঁপুনি শুরু হলে উঁচু ভবনেরই ধসে পড়ার আশঙ্কা বেশি।

Advertisement

কাজেই, বুদ্ধিমান হন, নিজের দুর্বলতা যাচাই করুন। পারিপার্শ্বিকভাবে আপনি কতটা সুরক্ষিত, হিসাব করুন। যে ভবনটিতে বাস করছেন, তা কি আপনার জীবনের নিরাপত্তা দিতে সক্ষম? দুর্যোগ মোকাবেলা তো মুখের কথা নয়, ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পনা প্রয়োজন। আর তাই জাঁকজমকভাবে প্রাসাদে বাস করলেই নিজেকে সুরক্ষিত ভাবা সব সময় সম্ভব নাও হতে পারে, প্রাসাদটি কোথায় বানিয়েছেন সেটাও তো হিসাবের বিষয়। ভবনের ‘দুর্বলতার মাত্রা’ যাচাই করতে হলে ভবনের নির্মাণগত গুণমানের সাথে এর অবস্থান কোথায়, দেখতে হবে। দুর্যোগের শিকার হলে ভবনে আনুমানিক কতখানি ধ্বংস লীলা ঘটতে পারে, তা আসলে এর মেরামতের খরচকে ভবনটি স্থানান্তরের খরচ দিয়ে ভাগ করলে ০ থেকে ১ মাত্রার ভেতর প্রকাশ করা সম্ভব। আর এটাই আসলে বিপদের তীব্রতার গাণিতিক ফাংশন, যাকে বিপদের গুরুত্ব বা প্রাবল্য হিসেবেও চিহ্নিত করা যেতে পারে, কে কিভাবে ভাববে তা নির্ভর করবে নানান বিষয়ের উপর।

আপনার নিরাপত্তা নির্ভর করে আপনার ভবনে ব্যবহৃত মালমশলার উপর, মানতে না চাইলেও এটা কিন্তু সত্যি। ভেবে দেখুন, আপনার ভবনের কোন্ কোন্ উপাদান বিপদের ঝুঁকিতে আছে। পরিকল্পনার এই অবস্থানে এসে পণ্ডিতেরা বলেন, সব ভবন নিয়ে কথা বলে লাভ নেই। শিক্ষা মানুষকে দুর্বল থেকে সবলে পরিণত করে। কাজেই, যার শিক্ষা নেই, সে যেরকম বাড়ি বানাচ্ছে, ভাবতে হবে সে বাড়ি নিয়ে, কেননা শিক্ষাহীন দুর্বলের বাড়িও দুর্বল। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তাই দুর্যোগ-প্রবণ বাড়িঘর খুঁজতে গেলে মাইক্রোস্কোপের কাঁচ কম খরচের বাড়িঘর, গ্রামের বাড়িঘর বা এলোমেলো পরিকল্পনাহীন বাড়িঘরের খোঁজ বের করে ফেলে। এর ফলে পাথরের বাড়ি, কাঠের বাড়ি, মাটির বাড়ি, ইটের বাড়ি, রেইনফোর্সড কংক্রিটের বাড়ি, হাল্কা-পাতলা কাঠামো (প্যানেল বা ফ্রেম) নিয়ে তর্ক শুরু হয়।

ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান খুঁজতে গিয়ে তাই তিনটি বিষয়ে উপর জোর দেওয়া দরকার হয়ে পড়ে। প্রথমত, লক্ষ্যণীয়ভাবে বিদ্যমান নির্মাণসমূহের তালিকা করতে হবে, যেমন- কোন্ অংশ ভর বহন করছে বা লোড বিয়ারিং, কোথায় কোথায় রেইনফোর্সড কংক্রিট বা ইস্পাত আছে। দ্বিতীয়ত, হাসপাতাল, স্কুলের মতো বিশেষ নকশা সংবলিত ভবনের উপাদানসমূহের তালিকা এবং ঘরবাড়ির মতো দৃশ্যমান নির্মাণের উপাদানসমূহের তালিকা করতে হবে। তৃতীয়ত, লক্ষ্যণীয় ভবনসমূহের তালিকাও দরকার, কেননা এইসব ভবনে ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান হিসেবে ঝুঁকিপূর্ণ নির্মাণ সামগ্রী যেমন আছে, তেমনি আছে কাঠামাগত আনুপাতিক দুর্বলতা, প্ল্যান-সেকশন-এলিভেশনে ভারসাম্যহীনতা, ছাদের অবস্থানে দুর্বলতা এবং সর্বোপরি দুর্বল তদারকি।

Advertisement

ব্যাপক বন্যায় বাড়িঘরের মতো নির্মাণের চেয়ে অবকাঠামোর ক্ষতির সম্ভাবনা অনেক বেশি। অবকাঠামো বলতে যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ-জ্বালানি বিতরণ ব্যবস্থা এবং টেলিফোন-ইন্টারনেট সংযোগকে বোঝানো হয়। ভূমিকম্প-প্রবণ এলাকায় সুপেয় পানির ব্যবস্থা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়ে। কেননা, তখন ভূমিধস, পাথর ধস ঘটার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। ভূগর্ভস্থ পাইপলাইন, পাম্পিং স্টেশন, পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং পানি শোধনাগার প্ল্যান্টগুলো ঝুঁকির মাঝে থাকে। বেশির ভাগ কেন, আসলে সব দুর্যোগেই সুপেয় পানির ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার করার কাজটিই হওয়া উচিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। খাবার প্রস্তুত করা, গোসল, শারীরিক জখম পরিষ্কার করা এবং হঠাৎ ধরে যাওয়া আগুন নেভাতে পানি প্রয়োজন।

নদীমাতৃক বাংলাদেশে বন্যার ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারে থমকে পড়ে না, নৌকা তো অন্তত থাকে। তবে দুর্যোগের সময়সীমা যদি বেশি হয়, তবে পানিবন্দী মানুষের অবস্থা কতখানি বেহাল হয়ে পড়ে, তা বলার প্রয়োজন পড়ে না। এর সাথে টেলিফোন সংযোগের দুরবস্থাও যোগ হয়। ভূগর্ভস্থ টেলিফোনের তার অন্তরক পদার্থের সাহায্যে সুরক্ষিত থাকলেও টেলিফোন এক্সচেঞ্জগুলো বন্যার ফলে পুরোপুরি কার্যক্ষম থাকতে পারে না। বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থাও পড়ে যায় ঝুঁকির মুখে, যেখানে জেনারেটর-ট্রান্সফরমার, উচ্চ বৈদ্যুতিক মাত্রার বিদ্যুতের তার আর কম বৈদ্যুতিক মাত্রার সংযোগ-সুইচের ভেতর যেগুলো মাটিতে বসানো থাকে, তার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। ঝড়ো হাওয়ায় বৈদ্যুতিক তার ছিঁড়ে গিয়ে বৈদ্যুতিক প্রবাহ নিরবচ্ছিন্ন কি থাকছে?

ভবনের পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা যদি ভাল না হয়, ধারণক্ষমতা পর্যাপ্ত না থাকে, তবে গৃহস্থ মলমূত্র বন্যার পানির সাথে মিশে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটানোর সম্ভাবনা থাকে। ভূমিকম্পের সময় উন্মুক্ত ড্রেনগুলোর বিপদ কম হলেও নমনীয় সংযোগ ব্যবহারের কারণে ভূগর্ভের সিস্টেমে গণ্ডগোল ঘটে যেতে পারে। বাড়ি যেখানে বানানো হচ্ছে, সেই সাইটের বিস্তারিত হিসাব বাড়ি বানানোর আগেই করা উচিত। আমাদের দেশে সেই হিসাব কতটুকু হচ্ছে?

তাই, আপনাকেই বলছি। বুদ্ধিমান হন, নিজের ভবনের দুর্বলতা যাচাই করুন। সুরক্ষিত থাকুন।

Advertisement

লেখক : কথাসাহিত্যক।

এইচআর/জেআইএম