কবি নির্মলেন্দু গুণের বহুল পঠিত একটি কবিতা ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’। জনপ্রিয় এই কবিতাকে ঘিরে রয়েছে একটি বাস্তব চিত্র। সেই চিত্রকে দর্শকের সামনে তুলে ধরেছেন তরুণ কবি ও চলচ্চিত্র নির্মাতা মাসুদ পথিক। কবিতাটি পড়তে পড়তে পাঠক যেমন তন্ময় হয়ে যান; ঠিক তেমনি সিনেমাটি দেখতে দেখতে দর্শকও নিশ্চয়ই তন্ময় হয়ে যাবেন। চলচ্চিত্রটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভের গৌরব অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। ফলে কবি নির্মলেন্দু গুণ এবং পরিচালক মাসুদ পথিক নতুন ইতিহাসের পাতায় যুক্ত হলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে ইসলাম ধর্ম, হিন্দু পুরাণ, রাজা-বাদশাহর ইতিহাস, গল্প ও উপন্যাস অবলম্বনে অনেক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। তবে কবিতা থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণ এবং চলচ্চিত্রে জাতীয় স্বীকৃতি লাভ- এই বোধহয় প্রথম।
Advertisement
এক ঘণ্টা বায়ান্ন মিনিট পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ডের সিনেমাটি দর্শককে নিয়ে যাবে নেকাব্বরের যাপিত জীবনের আদি এবং অন্তে। নেকাব্বর নামের এক ব্যক্তির মহাপ্রয়াণের ইতিহাস জানাবে আগ্রহী পাঠককে। কবিতা পড়ে যারা বিভিন্নভাবে কল্পনা করেছেন, এর চিত্ররূপ দেখে তারা হঠাৎ করে হোচট খেতেই পারেন। এখানে শুধু নেকাব্বর আর ফাতেমার প্রেম কাহিনিই উপজীব্য হয়ে ওঠেনি। উচ্চকিত হয়েছে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরব গাথা এবং একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার জীবনযুদ্ধে হেরে যাওয়ার দৃশ্য।
আনন্দের ব্যাপার হচ্ছে- এই চলচ্চিত্রে কবি নির্মলেন্দু গুণও অভিনয় করেছেন। তিনি এই চলচ্চিত্রের একটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র হিসেবে শুরুতেই আবির্ভূত হয়েছেন। আমরা দেখলাম- রেল স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছেন মাসুদ পথিক। একটু পরেই ট্রেন থেকে নেমে এলেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। তার হাতেই আবিষ্কৃত হন নেকাব্বর। নেকাব্বরের মৃতদেহ পড়ে আছে স্টেশনের পাশেই। মৃতদেহ ঘিরে উৎসুক জনতা, সাংবাদিক। কবি কলম হাতে লিখতে শুরু করেন ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’। কবির নস্টালজিয়ার মধ্যদিয়েই চলচ্চিত্রটির ঘটনা আবর্তিত হয়। চলচ্চিত্রের শুরু এবং শেষ তাকে দিয়ে। চলচ্চিত্রে তার অভিনয় অবশ্যই প্রশংসাযোগ্য।
নেকাব্বর গ্রামের খেটে খাওয়া একজন বঞ্চিত মানুষ। সংসারে তার আপন বলতে কেউ নেই। তবে নেকাব্বর ছাড়াও তার পরিবারের সদস্য দুটি গরু, ইঁদুর, সাপ, পিঁপড়া এবং ব্যাঙ। প্রকৃতির প্রতি তার সীমাহিন টান। জীব-জন্তুকে মোটেই কষ্ট দিতে রাজি নন। গাছে গাছে চড়া, গ্রামীণ খেলাধুলা, বর্গা জমি চাষ তার নিত্যদিনের কর্মকাণ্ড। তার ভালোবাসার একমাত্র মানুষ ফাতেমা। যাকে সে আদর করে ‘ফাতু’ বলে ডাকেন।
Advertisement
ফাতেমাকে ঘিরেই এগিয়ে যেতে থাকে তার স্বপ্ন। ফাতেমার ওপর দৃষ্টি পড়ে তালুকদারের। ফাতেমার বাবার কাছে ছেলের ড্রাইভারের জন্য বিয়ের প্রস্তাব দিলেও অবশেষে নিজেই বিয়ে করার ইচ্ছা পোষণ করেন। এদিকে বিদ্রোহী মনোভাবাপন্ন নেকাব্বর জড়িয়ে পড়েন কৃষকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে। গ্রামের ছেলে নির্মলেন্দু গুণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। নির্মলের সঙ্গে তার বিভিন্ন বিষয়ে কথা হয়। কৃষকদের মুক্তির পথ খোঁজেন তারা। ছুটি শেষে নির্মল ঢাকা চলে যান।
শ্রেণিবৈষম্য দূর করতে তালুকদারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান নেকাব্বর। এলাকার বাম নেতার নেতৃত্বে তালুকদারের বাড়িতে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে। সেই ঘটনাই তার জীবনে কাল হয়ে দাঁড়ায়। হুলিয়া জারি হওয়ার পর এক রাতে গ্রামের বন্ধু নির্মলের সঙ্গে ঢাকায় গিয়ে আশ্রয় নেন। ঢাকার বিউটি বোর্ডিংয়ে সাক্ষাৎ হয় তৎকালীন কবি এবং বিপ্লবীদের সঙ্গে। দেশে তখন স্বাধীনতা যুদ্ধের ঝংকার শুরু হয়। রাতে এক দুঃস্বপ্ন দেখে ফাতেমাকে একনজর দেখার জন্য গোপনে গ্রামে আসে নেকাব্বর। কিন্তু এসেই যুদ্ধের বেড়াজালে পড়ে যান। ফলে অংশগ্রহণ করেন সম্মুখ সমরে। একপর্যায়ে পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকেন।
যুদ্ধের সময় নেকাব্বর অন্যায়ভাবে তাঁর সম্পদ হারান। মুনসি এবং তালুকদারের লালসার কারণে হারান প্রিয়তমা ফাতেমাকে। চিরতরে হারান একটি পা। অচেতন অবস্থার পর উদ্ধারকৃত নেকাব্বর স্থান পান পাগলা গারদে। পাগলা গারদ থেকে বেরিয়ে অনাহারে থাকতে হয়। পেতে থাকেন সমাজের বঞ্চনা আর লাঞ্ছনা। গ্রামে ফিরে এসে ফাতেমাকেও খুঁজে পান না। জানতে পারেন- নদীর পেটে চলে গেছে তার ভিটা এবং ফাতেমার কবর। নেকাব্বরকে শুনতে হয়- প্রথমে মুনসি দ্বারা ধর্ষিতা ফাতেমা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানিদের ভোগের বস্তুতে পরিণত হন। শারীরিক নির্যাতনের ফলে সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়েন ফাতেমা। পরে সন্তান প্রসব করে ফাতিমা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। ভূমিষ্ট সন্তানটিও হয়ে ওঠে মানসিক প্রতিবন্ধি।
এভাবেই একের পর এক লাঞ্ছনা, বঞ্চনা, হারানোর বেদনা সহ্য করতে করতে একসময় মৃত্যুবরণ করেন নেকাব্বর। তার মৃতদেহ সনাক্ত করেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। সিনেমার শেষ দিকে আমরা নেকাব্বরের রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন হওয়ার সুসংবাদটি পাই। বিউগলে করুণ সুর আমাদের জানান দেয়, নেকাব্বর বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি আমাদের গর্ব এবং অহংকার। অথচ জীবদ্দশায় কী নিদারুণ যন্ত্রণা তাকে ভোগ করতে হয়েছে। চিরবঞ্চিত এক নেকাব্বরের জন্য শুধু এটুকুই কি যথেষ্ট? এ প্রশ্নের উত্তর হয়তো জাতির বিবেকের কাছে।
Advertisement
কবি তাঁর কবিতায় বলেছিলেন—‘নেকাব্বর জানে তাঁর সম্পত্তির হিসাব চাইতে আসবে না কেউ কোনোদিন। এই জন্মে শুধু একবার চেয়েছিল একজন, ‘কী কইরা পালবা আমারে, তোমার কী আছে কিছু তেনা?’ সিনেমায় নেকাব্বরের সম্পত্তির হিসেব কেউ কোনদিন চাইতে আসেনি। আর হয়তো আসবেও না। কারণ এ জগতে তার রক্তের কোনো উত্তরসুরি নেই। তার জীবদ্দশায় শুধু একজনই চেয়েছিল। সে ফাতেমা। সেই ফাতেমাও ক্রমান্বয়ে নিস্তেজ হয়ে গেছে জীবনের গল্প থেকে। অথচ সন্ধ্যায় নদীর ঘাটে ফাতেমাকে জড়িয়ে দু’হাতে বুকে পিষে নেকাব্বর বলেছিল— ‘আছে, আছে, লোহার চাক্কার মতো দুটা হাত, গতরে আত্তীর বল- আর কীডা চাস মাগী।’তবে নেকাব্বরের শরীরের সব শক্তি হয়তো কৃষক এবং দেশকে মুক্তি দিয়েছে। কিন্তু নেকাব্বরকে মুক্তি দিতে পারেনি।
গ্রামের মানুষ যাকে বিপ্লবী নেকাব্বর বলে জানে। যার নিজস্ব কিছু দর্শন আমাদের চোখে ধরা পরে। সেই মানুষটিই জীবনের শেষ লগ্নে এসে পরাজিত হন। কবিতায় ত্রিশ বছর পরের কথা বলা হলেও চলচ্চিত্রের স্বার্থে বিয়াল্লিশ বছর দেখানো হয়েছে। বিয়াল্লিশ বছর পর দেশ মুক্তির বিনিময়ে প্রাপ্ত ব্যাধি, জরা, দুর্বলতা, ক্ষয়কাশ তার নিত্যসঙ্গী। গ্রামের দুর্দান্ত যুবক নেকাব্বরের এমন পরিণতি কেউ হয়তো মেনে নিতে পারবেন না। যেটা কবিও পারেননি। তাই তো তার কলমে উঠে এসেছে এমন মর্মান্তিক প্রয়াণের দৃশ্য।
নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ সিনেমাকে ২০১৪ সালের বাংলাদেশি নাট্য চলচ্চিত্র হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’ কবিতা অবলম্বনে এর চিত্রনাট্য লিখেছেন মাসুদ পথিক। সংলাপ লিখেছেন রাজিব আহসান ও মাসুদ পথিক। সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত সিনেমাটি প্রযোজনা ও পরিবেশনা করেছে ব্রাত্য চলচ্চিত্র। এতে নেকাব্বর চরিত্রে অভিনয় করেছেন জুয়েল জহুর এবং ফাতেমা চরিত্রে অভিনয় করেছেন শিমলা। পাশাপাশি কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চরিত্রে মামুনুর রশীদ, প্রবীর মিত্র, রানী সরকার, বাদল শহীদ, রেহানা জলি অভিনয় করেছেন। এতে নির্মলেন্দু গুণ ছাড়াও আরো পনেরো জন কবি অভিনয় করেছেন।
সিনেমাটিতে কাহিনির পাশাপাশি তথ্যচিত্রের আবহকে ধারণ করা হয়েছে। একইসঙ্গে প্রেম, প্রকৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের গাথা নিয়ে আবহমান বাংলার নিবিড় সংস্কৃতি, জীবনের অন্তর্গত দর্শন তথা জীবনবোধকে তুলে ধরা হয়েছে। এককথায় বলতে গেলে নির্মাণে যথেষ্ট পরিচ্ছন্নতার পরিচয় দিয়েছেন মাসুদ পথিক। তবে প্রথম দিকে খণ্ড খণ্ড চিত্রের মাধ্যমে নেকাব্বরের জীবনচিত্রসহ তৎকালীন পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক অবস্থার সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরেছেন। কখনো কখনো দর্শকের কাছে একে ছন্দপতন মনে হতে পারে। কারণ দীর্ঘ সময়কে মাত্র দুই ঘণ্টার ফিতায় বন্দি করতে চাইলে এর বেশি করা হয়তো সম্ভবও নয়।
এছাড়া নেকাব্বর-ফাতেমার প্রেম দেখাতে গিয়ে অতিরিক্ত যৌনদৃশ্যের অবতারণা করেছেন। প্রতীকীভাবে একবার দেখানোই উপযুক্ত হতো বলে মনে হয়। গ্রামীণ প্রেমকে পরিচালক অনেকাংশে অবাধ যৌনাচারের দিকে ধাবিত করেছেন কিনা- এমন প্রশ্ন উঠতে পারে। তবে এসব দৃশ্য নির্মাণে অনেক কৌশল অবলম্বন করে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন মাসুদ পথিক। বলে রাখা ভালো- সিনেমার একটি জায়গায় তিন মিনিট হতাশ হতে পারেন। কেননা কপিরাইট ইস্যুর জন্য এক ঘণ্টা তেইশ মিনিট ষোলো সেকেন্ড থেকে এক ঘণ্টা ছাব্বিশ মিনিট পনেরো সেকেন্ড পর্যন্ত নিঃশব্দ রাখা হয়েছে।
সব ছাপিয়ে আশার কথা হচ্ছে- চলচ্চিত্রটি ২০১৪ সালে প্রাথমিকভাবে ৫টি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। পরে ‘বৃহন্নলা’ চলচ্চিত্রের বিরুদ্ধে গল্প চুরির অভিযোগ উঠলে ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’ শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র বিভাগেও পুরস্কৃত হয়। পুরস্কারপ্রাপ্ত বিভাগগুলো হলো- শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র, শ্রেষ্ঠ গীতিকার, শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক, শ্রেষ্ঠ সুরকার, শ্রেষ্ঠ নারী কণ্ঠশিল্পী এবং শ্রেষ্ঠ রূপসজ্জাকার। এছাড়া কলকাতা থেকে মাসুদ পথিক ‘টেলি-সিনে অ্যাওয়ার্ডে’ বিশেষ পুরস্কার লাভ করেছেন।
আমি বলতে পারি, সাহিত্য নির্ভর চলচ্চিত্র হিসেবে এটি নান্দনিক উপস্থাপনা। এর দৃশ্য ধারণ, চরিত্র নির্মাণ অনবদ্য। সব মিলিয়ে হৃদয়গ্রাহী এই চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা ও শব্দ সম্পাদনা করেছেন সাইম রানা। সুর করেছেন বেলাল খান, মুশফিক লিটু, প্রিন্স মাহমুদ, সাইম রানা ও সেলিম মাহমুদ। গীত রচনা করেছেন মাসুদ পথিক, নির্মলেন্দু গুণ, অসীম সাহা, সাইম রানা, অতনু তিয়াস। গানে কণ্ঠ দিয়েছেন মমতাজ বেগম, বারী সিদ্দিকী, বেলাল খান, সাবরিনা পড়শী এবং বাদল শহীদ।
নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ চলচ্চিত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আন্তরিক অভিনন্দন। সঙ্গে সঙ্গে বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য শুভকামনা রইলো। এ ধারাবাহিকতা বজায় থাকুক। নতুন নতুন গল্প নিয়ে হাজির হোক বাংলা চলচ্চিত্র। দেশীয় চলচ্চিত্রের এমন সংকটকালে এ ধরনের চলচ্চিত্র নতুন আশা জাগিয়ে তুলুক দর্শকের মনে। আমি এর বহুল প্রচার ও প্রসার কামনা করছি।
এসইউ/জেআইএম