বিশেষ প্রতিবেদন

শিক্ষা প্রশাসন বিশৃঙ্খল হওয়ায় ফল বিপর্যয়

নজরুল ইসলাম খান, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘরের কিউরেটর এবং সাবেক সচিব। শিক্ষা সচিবের দায়িত্ব পালনকালে শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এবারের এইচএসসি পরীক্ষার ফল বিপর্যয় নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। কথা হয় শিক্ষা, শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও পাঠ্যপুস্তকের মান নিয়েও। দীর্ঘ আলোচনায় তুলে ধরেন শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ মতামত। তিন পর্বের ধারাবাহিকের প্রথমটি আজ প্রকাশিত হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।

Advertisement

জাগো নিউজ : এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলে বিপর্যয় ঘটেছে বলে মনে করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীও এমন ফলাফলের কারণ অনুসন্ধানের কথা বলেছেন। আপনি শিক্ষা সচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন। ফল বিপর্যয়ের বিষয়টি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন? নজরুল ইসলাম খান : যেকোনো কারণেই ফলাফলে বিপর্যয় ঘটতে পারে। শিক্ষার্থীরা পড়ালেখায় অমনোযোগী হলেও এমন হতে পারে। প্রশ্নপত্রের কারণেও এমন হতে পারে। আবার শিক্ষা প্রশাসন কিভাবে চলছে, প্রশাসনের নজরদারি কী, তার জন্য ফ্লাকচুয়েশন (বিপর্যয়) ঘটতে পারে। অন্যদিকে, দেশে রাজনীতিসহ অন্যান্য কারণে অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করলেও শিক্ষায় নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

তবে শিক্ষা প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে এবং প্রশ্নপত্রে ব্যালেন্স করতে পারলে এমন বিপর্যয় রোধ করা সম্ভব। শিক্ষা প্রশাসন বিশৃঙ্খল হওয়ায় এবারের ফল বিপর্যয়।

জাগো নিউজ : প্রশ্নপত্রে ব্যালেন্স বলতে কী বোঝাতে চাইছেন? নজরুল ইসলাম খান : প্রশ্ন সেটিংয়েরও বিষয় থাকে। যেমন : সবচেয়ে কঠিন প্রশ্নপত্র, মাঝারি কঠিন প্রশ্নপত্র এবং সহজ প্রশ্নপত্র করা হয়। এখন এ তিন ধরনের প্রশ্নের মধ্যে যদি সমন্বয় করা না হয়, তাহলে ফলাফলের ভিন্নতা আসতে পারে।

Advertisement

জাগো নিউজ : ফলাফল বিপর্যয়ে কোনো কারণটি আপনার কাছে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে? নজরুল ইসলাম খান : বলা হচ্ছে খাতা দেখায় বা মূল্যায়নে অধিক গুরুত্ব দেয়া বা ন্যায়পরায়নতার জন্যই ফলাফল খারাপ হয়েছে। হতে পারে।

কিন্তু আমি মনে করি, খাতা মূল্যায়নের চেয়ে অধিক গুরুত্ব দেয়া উচিত শেখা এবং শেখানোর ক্ষেত্র তৈরি করা। ফসল ফলানোর পর আর বেশি কিছু করার থাকে না। সার, পানি দিয়ে ফসল পাকানোর পর যেভাবেই কাটেন না কেন, তাতে ফসলের খুব একটা হেরফের হয় বলে মনে হয় না।

খাতায় মনোযোগী হওয়া ভালো, কিন্তু এর আগে এমন জায়গায় মনোযোগ দেয়া উচিত যেখান থেকে ফলাফল ভালো মিলবে।

জাগো নিউজ : শিক্ষামন্ত্রী বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোর চেয়ে এবার আলাদাভাবে খাতা মূল্যায়ন করা হয়েছে। আসলে তিনি এর মধ্য দিয়ে কী বোঝাতে চাইছেন? নজরুল ইসলাম খান : খাতা মূল্যায়ন হবে নিজস্ব মানদণ্ডে। আগের বছর এক রকম, আবার এবার আরেক রকম- এ কথার কোনো ভিত্তি থাকতে পারে না। খাতা মূল্যায়নে শিক্ষকরা শক্তই বা কেন হবেন, আবার নরমই বা কেন হবেন? খাতা মূল্যায়নে ভুলত্রুটি হলে ব্যালেন্স করা যায়, তবে সেটা এ পদ্ধতিতে নয়।

Advertisement

জাগো নিউজ : তাহলে কোন পদ্ধতি হতে পারে? নজরুল ইসলাম খান : একজন শিক্ষক সকল প্রশ্নের মূল্যায়ন করছেন। এটি কোনো সঠিক পদ্ধতি হতে পারে না। উন্নত দেশে সাধারণত একজন শিক্ষক মাত্র একটি প্রশ্নের উত্তর দেখে থাকেন। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর আলাদা আলাদা শিক্ষক দেখেন। এতে খাতা মূল্যায়নে অধিক ন্যায়পরায়নতার সুযোগ থাকে।

আরও ব্যাপার থেকে যায়। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরই প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর স্ক্যান করে শিক্ষকদের কাছে পাঠিয়ে দিতে হবে হল থেকেই।

জাগো নিউজ : এখনও তো প্রশ্নের সম্ভাব্য উত্তর শিক্ষকদের কাছে পাঠানো হয়? নজরুল ইসলাম খান : শিক্ষকদের কাছে একটি মাত্র স্ট্যান্ডার্ড উত্তর পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু প্রশ্ন করা হচ্ছে সৃজনশীল পদ্ধতিতে। সৃজনশীল মানেই তো মতের ভিন্নতা থাকবে। সবাই তো হুবহু একই উত্তর লিখবে না। সবাই একই উত্তর লিখলে তো আর সৃজনশীল হলো না।

মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো উত্তরের সঙ্গে হুবহু মিল রেখে যদি কোনো শিক্ষক খাতা মূল্যায়ন করেন এবং কোনো ছাত্র যদি ওই উত্তরপত্রের চেয়ে ভালো উত্তর দিয়ে থাকেন, তাহলে তো সে নম্বর পাবে না। সৃজনশীল মানেই তো উদ্ভাবনী ক্ষমতার প্রকাশ। এটি শিক্ষকদের মধ্যে কাজ করে কি না- সেটাও দেখতে হবে।

জাগো নিউজ : কিন্তু খাতা মূল্যায়নে যত্নবান হওয়া তো সময়ের দাবি ছিল। নজরুল ইসলাম খান : অবশ্যই। শিক্ষকরা খাতা মূল্যায়নে অধিক যত্নবান হয়েছেন, এটা নিঃসন্দেহে একটি ভালো দিক। বোর্ডের চেয়ারম্যানদের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, তারা আরও সতর্ক হয়েছেন।

কিন্তু শিক্ষা তো সতর্ক হওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। কিভাবে খাতা মূল্যায়ন করতে হবে, তা তো উল্লেখ করলাম। তবে আরেকটি বিষয় হচ্ছে, প্রশ্ন সেটিং করা। কিছু প্রশ্ন কঠিন, কিছু মাঝারি কঠিন এবং কিছু প্রশ্ন সহজ করতে হবে। এতে পাসের হার বাড়বে বটে, কিন্তু ভালো শিক্ষার্থীরাই কেবল ভালো ফলাফল করতে পারবে। আবার যারা একেবারেই বই পড়বে না, তারা যেন পাস করতে না পারে, তারও ব্যবস্থা থাকবে।

সকল একাডেমি সেক্টরেই আমার কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। এমনকি বিসিএস একাডেমিতেও কাজ করেছি। অভিজ্ঞতার আলোকে আমি মনে করি, নোট বই, গাইড বই সম্পূর্ণ তুলে দেয়া উচিত। গাইড বই নিষিদ্ধ না করাও ব্যর্থতা।

জাগো নিউজ : এটি তো অনেক কঠিন কাজ। নোট বই তুলে দেয়ার চেষ্টাও করা হয়েছে।নজরুল ইসলাম খান : মোটেও কঠিন কাজ নয়। প্রশ্ন সেটের সমন্বয় করেই বাজার থেকে নোট বই, গাইড বই তুলে দেয়া যায়। এমনভাবে প্রশ্ন করা উচিত যা কোনো গাইড বইয়ে নেই। এখন এমন প্রশ্ন তো করা হয় না।

জাগো নিউজ : এবারের ফলাফল নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য যদি সঠিক হয়, তাহলে আগের বছরগুলোতে যেভাবে শিক্ষার্থীরা মূল্যায়িত হয়েছে তাতে শিক্ষার মান কী দাঁড়াল? নজরুল ইসলাম খান : শিক্ষা হচ্ছে জাতি গঠনের হাতিয়ার। এমন সিরিয়াস বিষয় নিয়ে সিরিয়াস কথাই বলা উচিত। এ বছর এক কথা বললাম, সামনের বছর আরেক কথা বললাম, তাহলে কথার কোনো মূল্য থাকল না। সুবিধা বুঝে কথা বলার মধ্যে মান থাকে না।

ভিন্নভাবে মূল্যায়ন হতেই পারে। কিন্তু লাভ হয় না। ভাত রান্না করার আগেই সতর্ক হতে হয়। ভাত হওয়ার পর নরম হলো কি শক্ত হলো- তা বুঝে আর লাভ হয় না।

জাগো নিউজ : কী হতে পারে সে সতর্কাবস্থা? নজরুল ইসলাম খান : বিতর্ক উঠছে অধিক সংখ্যক পরীক্ষা নিয়ে। এত পরীক্ষা কেন? এর চেয়ে শ্রেণিকক্ষে বেশি পরিমাণে সময় দেয়া, ক্লাসভিক্তিক মূল্যায়নের ওপর জোর দেয়া উচিত বলে আমি মনে করি। প্রত্যেক দিন শিক্ষার্থীর মান মূল্যায়ন হবে। এতে শিক্ষার্থীরা মনোযোগী হবে। পাসের হারও বাড়বে।

এবার তিন লাখ ৬১ হাজার শিক্ষার্থী ফেল করেছে। অনেক দেশ আছে যাদের জনসংখ্যা তিন লাখও নয়। মালদ্বীপের জনসংখ্যা মাত্র তিন লাখ। তাহলে এত সংখ্যক শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হলো, এটা কি আমাদের জন্য বড় ধাক্কা নয়?

বুঝতে হবে কোথায় নজর দিলে শিক্ষার্থীরা বেশি পাস করতে পারবে। কোথায় হাত দিলে শিক্ষাকে বাস্তব জীবনের অনুষঙ্গ করতে পারবে, সেখানেই হাত দিতে হবে।

দেখুন, মুসলমানের কাছে টুপি পরা সুন্নত। এখন কোনো এক মুসলমানকে এক টুকরো কাপড় দিয়ে একটি দ্বীপে পাঠানো হলো। সে কিন্তু তখন ওই কাপড় দিয়ে আব্রু ঢাকবে। টুপি বানাবে না। এ কারণেই যেখানে অধিক গুরুত্ব দেয়ার কথা, সেখানেই আগে গুরুত্ব দিতে হবে। এএসএস/এমএআর/আরএস/এমএস