রাজনীতি

দুই সহযোগী সংগঠনের কমিটি নিয়ে আ. লীগে সমালোচনা

আওয়ামী লীগের দুই সহযোগী সংগঠন মহিলা লীগ ও যুব মহিলা লীগের সদ্য ঘোষিত কেন্দ্রীয় কমিটি নিয়ে তোলপাড় চলছে। কমিটিতে বিতর্কিত, অপরিচিত ও হাইব্রিডদের স্থান দেয়ার অভিযোগ ওঠায় ব্যাপক সমালোচনা চলছে ক্ষমতাসীন দলে। ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ এবং গণমাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন সংগঠন দুটির ত্যাগী ও জ্যেষ্ঠ নেতাকর্মীরা। আবার পদত্যাগের হুমকিও দিচ্ছেন কেউ কেউ। বিশেষ সুপারিশে অপরিচিত অনেকেই কমিটিতে জায়গা পেয়েছেন বলে অভিযোগ করছেন ত্যাগীরা। বিষয়টি নিয়ে বিপাকে পড়েছেন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠন দুটির শীর্ষ নেতারা।

Advertisement

গত মঙ্গলবার যুব মহিলা লীগের ১২১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়। এতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছাড়াও ২১ জনকে সহ-সভাপতি, ৮ জনকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, ৮ জনকে সাংগঠনিক সম্পাদক, ৩৫ জনকে সম্পাদক এবং ৫২ জনকে সদস্য করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক অনুমোদিত এ কমিটিতে স্থান পাওয়াদের বিরুদ্ধেও নানা ধরনের অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়া পদের ক্ষেত্রে সিনিয়র-জুনিয়র মানা প্রটোকল মানা হয়নি বলে অভিযোগ করছেন নেত্রীরা।

কমিটির ২ নং সহ-সভাপতি শিরিনা নাহার লিপির স্বামী গাজী কামরুল ইসলাম সজল বিএনপি কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির ৫৯ নং সদস্য এবং যুদ্ধাপরাধ মামলায় আসামি পক্ষের একজন আইনজীবী। বিএনপির কেন্দ্রীয় একজন নেতার স্ত্রী ক্ষমতাসীন দলের গুরুত্বপূর্ণ এ পদ পাওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন কমিটির অন্য নেত্রীরা।

১৭ নং সহ-সভাপতি রাশেদা পারভীন মনির স্বামী গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ঝালকাঠির রাজাপুরের মঠবাড়িয়া ইউনিয়নে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর কাছে হেরে যান।

Advertisement

কমিটির ৩ নং যুগ্ম সম্পাদক করা হয়েছে অ্যাডভোকেট শাহানাজ পারভীন ডলিকে। তিনি ঝালকাঠি রাজাপুর উপজেলা শিবিরের সাবেক সেক্রেটারি মোস্তফা কামাল সিকদারের আপন বোন। বনানীর রেইনট্রি হোটেলের মালিক স্থানীয় বিতর্কিত এমপি বি. এইচ হারুণ গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ৬ নং মঠবাড়ি ইউনিয়নে কামাল সিকদারকে আওয়ামী লীগ থেকে দলীয় মনোনয়ন দেন। ডলির ভাইয়ের পরিচিতি তুলে ধরে রাজাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগ থেকে কেন্দ্রে একটি প্রত্যয়ন পত্র দেয়া হয়। উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সাধারণ সম্পাদক মো. জিয়া হায়দার খান লিটন এবং শিক্ষা ও মানব উন্নয়ন সম্পাদক তালুকদার শফিকুর রহমান স্বাক্ষরিত ওই প্রত্যয়ন পত্রে যুব মহিলা লীগ নেত্রী ডলির ভাইয়ের রাজনৈতিক পরিচিতির বিবরণ তুলে ধরা হয়। আর ডলি নিজেকে কখনো ডাক্তার আবার কখনো অ্যাডভোকেট বলে পরিচয় দিলেও তার সঠিক পদবী নিয়ে সংগঠনে নানা গুঞ্জন রয়েছে।

এ ছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্রলীগ করা নেতাকর্মীরা সরাসরি যুব মহিলা লীগে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে যুব মহিলা লীগ করা নেত্রীরা বেশ ক্ষুব্ধ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক নেত্রী বলেন, যুব মহিলা লীগের শুরু থেকে আমরা রাজনীতি করছি। সেই দু:সময়ে মাঠে কেউ ছিল না। নাজমা আক্তার এবং অপু উকিলের নেতৃত্বে আমরা প্রতিটি অলি-গলিতে ঘুরে সংগঠনকে আজ এ পর্যায়ে এনেছি। কিন্তু ছাত্রলীগ থেকে অনেকেই এসে আজ সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে রেডিমেড বসে গেছেন।

সংগঠনের ঢাকা মহানগর উত্তর সভাপতি সংসদ সদস্য সাবিনা আক্তার তুহিন ক্ষোভ প্রকাশ করে নিজের ফেসবুকে লিখেন, যুব মহিলা লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি হলো, আমি যে জায়গায় থাকতে চেয়েছি সেখানেই আছি, স্বাধীন জায়গায়। কমিটিতে যে সব ত্যাগী নেত্রী স্থান পেয়েছেন তাদের দেখে আনন্দিত হয়েছি। তবে সত্য বলতে আমি কখনো ভয় পাই না। কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদে যারা এসেছেন তা আমাকে বিস্মিত করেছে।

Advertisement

তিনি বলেন, ২০ বছর আগে ছাত্রলীগ করেছে, যাদের আমরা যুব মহিলা লীগ কখনো চিনি না, দু:সময়ে যারা রাজনীতি থেকে বিদায় নিয়েছিল আজ সুসময়ে তারাই গুরুত্বপূর্ণ পদে আর রাজপথের মেয়েদের চোখের জল আমাকে ব্যথিত করেছে। আমি ভাবছি এত অভিশাপ কি সইতে পারবো নাকি নিজেই সরে দাঁড়াবো?

যুব মহিলা লীগে বিতর্কিতদের স্থান পাওয়া নিয়ে জানতে চাইলে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপিকা অপু উকিল বলেন, কমিটিতে ত্যাগী নেতাকর্মীদেরই স্থান দেয়া হয়েছে। এটা নিয়ে কারো ক্ষোভ বা হাতাশার কারণ নেই। তবে সিনিয়র-জুনিয়র একটু প্রটোকল সমস্যা হয়েছে তা আমরা কো-আপ করে নেবো।

সংগঠনের সভাপতি নাজমা আক্তার বলেন, সবাই কমিটির প্রশংসা করেছেন, কেউ বঞ্চিত হয়নি। যাদের ব্যাপারে অভিযোগ আনা হচ্ছে তার কোনো ভিত্তি নেই। এ ছাড়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কারণে একই পরিবারে একেকজন একেক দলের সমর্থক থাকতে পারে। কারও ভাই, কারও স্বামী অন্য দলের সমর্থক বা নেতাও হতে পারে। কিন্তু সে কি করেছে, তার ত্যাগ কতটুকু সেটাই আমাদের কাছে মুখ্য বিষয়। আর প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুসারেই ছাত্রলীগের সাবেক নেত্রীদের দলে পদ দেয়া হয়েছে। এখানো কারও ক্ষোভের কারণ নেই। এদিকে গত শনিবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক স্বাক্ষরিত ১৫১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি ঘোষণা করে মহিলা আওয়ামী লীগ। কমিটিতে সভাপতি, সহ-সভাপতি ২১ জন, সাধারণ সম্পাদক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ৮ জন, সাংগঠনিক সম্পাদক ৮ জন, অন্য সম্পাদক ২৩ জন এবং কার্যকরী সদস্য ৮৯ জন রয়েছেন।

তবে কমিটিতে পদ পাওয়াদের নিয়ে বিতর্ক শুরু হলে এদের অনেককেই চেনেন না বলে সাংবাদিকদের কাছে স্বীকার করেছেন সংগঠনটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক।

কমিটিতে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদ পেয়েছেন জান্নাত আরা হেনরী। বহুল আলোচিত হলমার্ক কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। শুধু তা-ই নয়, সে সময় তিনি কোটি কোটি টাকা অবৈধ অর্জনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধানেও ছিলেন।

নতুন কমিটিতে কার্যকরী সদস্য হয়েছেন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা জামায়াত নেতা মুমিনুল হক চৌধুরীর মেয়ে এবং স্থানীয় এমপি আওয়ামী লীগ নেতা আবু রেজা নদভীর স্ত্রী রিজিয়া রেজা নদভী।

এর আগে রিজিয়াকে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের কমিটিতে সাংগঠনিক সম্পাদক করা হলেও পরে তা আবার বাতিল করা হয়। তবে এবার কেন্দ্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে ঠাঁই পেয়েছেন তিনি। বিষয়টি নিয়ে রীতিমতো হৈচৈ পড়ে যায় ক্ষমতাসীন দলে। ফেসবুকসহ নানা যোগযোগ মাধ্যমে কঠোর সমালোচনা করে স্ট্যাটাস দেন ছাত্রলীগ, যুবলীগের সাবেক ও বর্তমান নেতাদের অনেকেই।

জানা গেছে, ১৫১ সদস্যে কমিটির অনেকেই নতুন মুখ। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা শেষ করা ছাত্রলীগ নেত্রীরা কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়েছেন। যাদের অনেককেই চেনেন না সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক।

এ ব্যাপারে মহিলা লীগ সভাপতি সাফিয়া খাতুন বলেন, কারো বাবা জামায়াত করলেও মেয়ের আওয়ামী লীগ করতে দোষ কোথায়? আর ছাত্রলীগের ১০ থেকে ১২জন মহিলা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পেয়েছেন, এদের আমি চিনি না। তবে এরা ত্যাগী ছাত্রলীগ কর্মী ছিলেন।

এইউএ/এআরএস/এমএমজেড/এমএস