শরীরটা বাইম মাছের মতো দেখতে হলেও মুখটা সাপের মতো। অনেকে সাপ মনে করে ভয়ও পান। নিরীহ এ প্রাণিটির নাম কুচা। অবশ্য অনেক অঞ্চলে এটি কুচা মাছ নামে পরিচিত। কুচা মাছ মূলত অঞ্চল ভেদে কুঁচে, কুঁইচ্চা বা কুঁচে বাইম নামে পরিচিত। আকৃতি বাইম মাছের মতো দেখতে হলেও আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষই ঘৃণা বা ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞার জন্য এ মাছ থেকে দূরে থাকেন।এক শ্রেণি-পেশার মানুষ এ কুচা মাছ শিকার, মজুদ ও তা বিদেশে রফতানি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। এ মাছ শিকার থেকে রফতানি পর্যন্ত তিনটি পর্যায়ে অর্থাৎ শিকারি, মধ্যস্বত্বভোগী ও আড়ৎদাররা এ ব্যবসার মাধ্যমে তাদের জীবিকা নির্বাহ করছেন।খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিলেট, বরিশাল, পাবনাসহ প্রায় ১০-১২টি জেলা থেকে প্রচুর পরিমাণে কুচা মাছ বিদেশে রফতানি করা হয়। ফলে দেশের অর্থনীতিতে কুচা মাছ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। রক্তশূন্যতা ও বাতব্যথা দূর করে এ মাছ- এমন বিশ্বাস রয়েছে অনেকের মনে।দীর্ঘ প্রায় ৪০-৪৫ বছর ধরে সফলতার সঙ্গে মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে এ মাছ নিয়ে ব্যবসা করে আসছেন রাজবাড়ী জেলা সদরের দক্ষিণ ভবানীপুরের ড্রাই-আইস ফ্যাক্টরি এলাকার বাগধীপাড়ার অধিবাসী কার্তিক সরকার ও তার পরিবার।সরেজমিন দেখা যায়, আদিবাসী বাগধীদের কাছ থেকে তারা এ মাছ কেনেন ও তা ঢাকার আড়তে বিক্রি করেন। পরে আড়ৎদাররা তা বিদেশে রফতানি করেন।কার্তিক সরকার জানান, বাগধীদের কাছ থেকে প্রতি কেজি ৮০-১৫০ টাকা দরে ক্রয় করা হয়। তারপর তা চৌবাচ্চায় সংরক্ষণ করে প্রতি সপ্তাহে ৫-১০ মন মাছ ঢাকায় আড়ৎদারদের কাছে কেজি প্রতি খরচ-খরচা বাদ দিয়ে ৫-১০ টাকা লাভে বিক্রি করেন।মূলত চায়নিজ ও মঙ্গোলিয়ানদের কাছে এ মাছ অত্যন্ত জনপ্রিয় বলে তিনি জানান।বিদেশে রফতানি ছাড়াও দেশের অনেকে তাদের বিভিন্ন রোগের ওষুধ হিসেবে কুচা মাছ খেয়ে থাকেন। প্রতিদিন একজন শিকারি গড়ে দুই-তিন কেজি করে কুচা মাছ ধরতে পারেন।তিনি আরও বলেন, বর্ষার মৌসুমে আমাদের এই অঞ্চলে কুচা মাছ কম ধরা পড়ে। তবে সিলেট অঞ্চলে বেশি ধরা পড়ে।কুচা মাছ শিকারি কমল বাগধী বলেন, এ মাছ ধইরাই আমাগো সংসার চলে।তিনি আরও জানান, পুকুর অথবা বিলের পাশের ছোট ছোট গর্ত চিহ্নিত করে বড়শির সঙ্গে কেঁচো অথবা ছোট মাছ গেঁথে এ কুচা মাছ শিকার করা হয়।জানা গেছে, এ মাছ রফতানিতে ঢাকার উত্তরার ১২নং খালপাড়ে গড়ে উঠেছে প্রায় ৪০/৫০টি কুচা আড়ত কোম্পানি। রাজবাড়ীসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রতি সপ্তাহে ঢাকায় প্রায় ৩০/৪০ টন কুচা মাছ আসে। পরে তা চীন, হংকং, তাইওয়ান, মালোশিয়া, জাপান, থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের প্রায় সাত-আটটি দেশে রফতানি করা হয়।রাজবাড়ী সরকারি আদর্শ মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. নূরুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, এ মাছের দেহ লম্বা ও নলাকার। লেজ খাড়াখাড়িভাবে চাপা, ক্রমশ সরু। ত্বক স্যাঁতসেঁতে ও পিচ্ছিল। দেহ গাঢ় বাদামি রঙের, এ মাছের উদর হালকা লাল। লম্বায় এরা ৬০ থেকে ৭০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। বাংলাদেশের প্রায় সব স্বাদুপানির জলাশয়েই (খাল, বিল, হাওর, বাঁওড় ও পুকুরপাড়ে মাটির গর্তে) কুচা দেখা যায়। পানির অগভীর ও তীরবর্তী অংশ এবং খালপাড়ে মাটির গর্তে এ মাছের উপস্থিতি বেশি লক্ষ্য করা যায়। এ ছাড়া প্লাবিত বোরো ধানক্ষেতেও এদের উপস্থিতি লক্ষণীয়। রাক্ষুসে স্বভাবের এ মাছের প্রধান খাদ্য বিভিন্ন প্রজাতির ছোট মাছ, জলজ পোকা ও প্রাণী। এরা মূলত অদ্ভুতভাবে মুখ দিয়ে বাচ্চা জন্ম দেয়। একটি মা কুচা মাছের একসঙ্গে সহস্রাধিক বাচ্চা দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। বছরের নভেম্বর থেকে জুন মাস পর্যন্ত কুচা মাছ ধরার মৌসুম। তবে এপ্রিল মাসে বেশি পরিমাণে এ মাছ পাওয়া যায়।কুচা মাছ অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হলেও এদেশে এ মাছের বাণিজ্যিক চাষাবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য এখনও তেমন কোনো পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায়নি।অর্থনীতিবিদদের মতে, সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বাণিজ্যিকভাবে এ মাছ চাষে উদ্বুদ্ধকরণ ও সচেতন করা হলে এ মাছ চাষ করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।এমএএস/পিআর
Advertisement