বেশ কয়েকদিন ধরে খবরের পাতায় পাতায়, টিভির বর্ণিল পর্দায় বনানী ধর্ষণ কাণ্ডের রমরমা বর্ণনা। এর চেয়েও কয়েকধাপ এগিয়ে ফেসবুকের পাতায় উছলে পড়া পক্ষ-বিপক্ষের কামড়া-কামড়ি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সোনা নিয়ে একেকজনের অসামাজিক লেখনি গোপনে গোপনে তাকে উত্তেজিত করত। কিন্তু গরম দুধের মতো উথলে ওঠা উত্তেজনাকে প্রশমিত করার মতো সময় হচ্ছিল না তার। এছাড়া দেশজুড়ে ধর্ষণ কাণ্ড নিয়ে যা হচ্ছে, একজন পাবলিক ফিগার হওয়ায় তার মনেও কিছুটা ভয় ঢুকেছে। কিন্তু তা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে সেই ফ্ল্যাটের দিকে ছোটেন মন্ত্রী। পাইক-পেয়াদা নিয়ে গগনবিদারি ভেঁ-ভুঁ শব্দ করে যাওয়ার পথেও কল্পনায় কামকলার নানান চিত্র ফুটিয়ে তোলেন তিনি।
Advertisement
কিন্তু খবরটা শুনে পায়ের নিচের সুদৃশ্য মার্বেলের মেঝে যেন সরে সরে যাচ্ছে মন্ত্রীর। অথচ ক্ষমতার কত রকম স্বাদ ও গন্ধ তার সাক্ষী হয়ে আছে এই মেঝে। সারা শরীর ঘেমেটেমে একাকার। কিন্তু বাইরের দগদগে আগুন ঝরা উত্তাপ দমিয়ে যথারীতি একটু বেশিই শীতল রাখা হয়েছে ফ্ল্যাটটিকে। কারণ শরীরের গরম কত প্রকার এবং তা কীভাবে জাগ্রত করা যায়- তার সব কলাকৌশল জানা আছে নেতার। হাতের কাছে বিদেশি মদ, ইয়াবা, টাকিলা, সিনেগ্রা আরো কত কি!
তাই সেই গরমের পরিণতির কথা শুনেই মাথা ঘুরে পড়ে যাবার উপক্রম তার। ক্রোধটা যত না নিজের উপর তার চেয়ে বেশি হচ্ছে সামনে দাঁড়ানো নারীকে দেখে। কী পরিণতি হতে যাচ্ছে তার! সে কি এই ক্ষমতার চরম শিহরণ থেকে ছিঁটকে পড়বে গহীন অরণ্যের কোনো খাদে? তা কী করে হয়! অক্টোপাসের মতো ঘিরে ধরা এই নারীকে ছুড়ে মারলেই হয়। কিংবা কাড়ি কাড়ি টাকা দিয়ে সব ধামাচাপ দিতে হবে। অথবা ভয়? কী করলে কী হবে, সেই ভাবনাগুলো যেন দানা বাধার আগেই বুকের ধুকধুকানির শব্দে ভেঙে ভেঙে পড়ে।
দৈহিক মিলনের সাক্ষী হিসেবে তখনও এলোমেলো মখমলের বিছানা। ‘ওই পেটের বাচ্চা আমার নয়’- কথাটি মুখে এসেও তাই আটকে যায়। তারপর গলাটাকে যথাসম্ভব শান্ত গম্ভীর আর কঠোর করে নেয়া। তবে ‘তুমি’ না ‘তুই’ সম্বোধন করে শুরু করবে তা ভাবতে একটু সময় নেন। এই মাগিকে কখনও ‘তুই’ সম্বোধন করা হয়নি। কামনার খাতিরে ‘তুমি’ ছাড়িয়ে সোনা-পোনা কত কি-ই তো বলে এসেছে এতদিন। তাছাড়া বল এখন ওর কোর্টে। তাই একটু ভেবেচিন্তেই কাজ করা উচিত।
Advertisement
তাই কৌশল অবলম্বন করে ‘তুমি’ সম্বোধন শুরু করেন, ‘এটা কি আমার কাজ? কে কখন এখানে আসে আর যায়, সেটা তো আমার জানার কথা নয়। এখন বড় নেতার বউ হওয়ার খায়েশ নিয়ে এসব কথা বলছো। ছি ছি। তুমি এরকম মেয়ে আগে ভাবিনি। শেষে কি না আমাকে ব্ল্যাক মেইল করছো?’ নেতার মুখে এ ধরনের কথা শুনে একটু ভড়কে যায় সে।
একজন কর্মচারীর বউকে ভাগিয়ে এনেছে নেতা। বউ ছেড়ে নেতার রক্ষিতা হিসেবে দেয়ার জন্য সেই কর্মচারীকে প্রথমে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তাতে রাজি না হওয়ায় অনেক টাকার প্রলোভন। হায়! যে কিনা হত্যার হুমকি পেয়েও বউ না ছাড়ার গোঁ ধরেছিল, সেই লোকটাই টাকা পেয়ে সব ছেড়েছুড়ে নিশ্চুপ। হয়তো খুন হওয়াটা অনিশ্চিত ছিল। কিন্তু নগদ কড়কড়ে টাকা পেয়ে আরেকটা বিয়ে করে বসল সে। তাই কর্মচারীর সেই বউ সবসময় নেতাকে ‘আপনি’ বলেই সম্বোধন করেছে। আজ সে ‘তুমি’ সম্বোধন করে। কোন যোগসূত্রের খাতিরে কিনা কে জানে, ‘তুমি একটা অমানুষ। নিজের কুকর্ম ঢাকার জন্য সব করতে পারো। ভেবেছো পালিয়ে যাবে না?’
তার দিকে এক পা এগিয়ে গিয়ে নেতা বলেন, ‘তোমার মতলব বুঝি না মনে কর? খানকি কোথাকার। ছিলেনগিরি করার জায়গা পাও না? চার মাস ধরে পেটে এসেছে, এখন বল কেন? আগে খসাতে পারোনি। এখনই হাসপাতালে যাও। এই নাও টাকা। এরপরও যদি শুধু পেটে কিছু থাকে তাহলে খবর আছে।’
পকেট থেকে অনেকগুলো এক হাজার টাকার নোট বের করে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যান নেতা। লিফটে থাকা সময়টুকু তার কাছে নিঃসঙ্গ আর যন্ত্রণার একযুগ মনে হয়। বারো তলা থেকে নয়, সে যেন কোনো এক গহ্বর থেকে অতল গহ্বরে নামছে তো নামছেই।
Advertisement
এরপর দিন যায়, রাত আসে। শত শত লোক নেতাকে ঘিরে রাখে। কিন্তু তলে তলে সে শুধু ঘামতেই থাকে। মহিলাটি বার বার ফোন করলেও ফোন ধরেন না নেতা। আর আশেপাশে সাংবাদিক দেখলেই সে আঁতকে ওঠেন। এই বুঝি সবকিছু জেনে কেউ তার কমেন্টস নিতে এসেছেন। পত্রিকার উপর নজরও রাখে। সবশেষে সাতদিনের মাথায় ফোন ধরে সে।
ওপাশ থেকে মহিলা বলে- ‘না এখনও হাসপাতালে যাওয়া হয়নি। যাবার কোনো ইচ্ছেও নেই। বাবার পরিচয়হীনই মানুষ করবো তাকে।’ এসব কথা শুনে নেতার ধৈর্যচ্যুতির চরম সীমা স্পর্শ করে। কিন্তু আশেপাশে এত এত চামচা যে চিৎকার করে কিছু বলতেও পারে না। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতেই হবে তাকে।
দিন পনেরো পরে একদিন নিজেই সেই ফ্ল্যাটে গিয়ে হাজির। মহিলা একটু রোগাটে হয়ে গেছে। কিন্তু সৌন্দর্যের যেন কোনো কমতি নেই। তবে সেই সৌন্দর্য দেখে আজ কোনো কামনা নয়, বরং হিংস্রতা বাড়ে। মনে হয় এসব তুচ্ছ জিনিস যত তাড়াতাড়ি পিষিয়ে ফেলা যায় ততই ভালো। এরপর কথা কাটাকাটির পর মহিলার ওপর চড়াও হন নেতা। মাটিতে লুটিয়ে পড়ার পরও নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকে নারী। কিন্তু আল্টিমেটাম দিয়ে যান নেতা। ব্যক্তিগত আল্টিমেটাম। পল্টন ময়দানের হাজার হাজার স্রোতা নয়, মাত্র একজনের উদ্দেশ্যে।
এরপর নিজে আর ওই অ্যাপার্টমেন্টে না আসলেও সাবেক স্বামীর আনাগোনা বেড়ে যায়। কর্মচারীটি নেতার আদেশে গদগদ ভাব নিয়ে আসে। মহিলার দিকে করুণার চোখে তাকিয়ে থাকে। পেট খালাস করার কথা বলে। কখনও বা গা ঘেঁষে বসার চেষ্টাও করে। বড় নেতা সৌন্দর্যের নেশায় কর্মচারীর এঁটো খাওয়া শুরু করেছিল। এবার বড় নেতার ব্যবহৃত নারী পাওয়ার বাসনা জাগে কর্মচারীর চোখেমুখে।
প্রাক্তন স্বামী ঘুমিয়ে পড়ার পর পাশের রুমে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে সে। ওর কোনো নাম নেই, কোথাও কোনো অস্তিত্ব নেই। ও শুধুই একটি শরীর। একটি রং। সোনালি। বড় একা। নিঃসঙ্গ। না স্বামী না মন্ত্রী। না সেই ভালোবাসার মানুষ শরিফ আবদুর। কারো কাছেই সে কিছুই পায়নি।
আহা প্রেমিক! তাকে নিয়ে এখনও স্বপ্ন দেখে সে। নারী হৃদয় কতটা বেহায়া। তার প্রেমিক গ্রহণ করেনি বলেই তো নিজের অমতে বিয়ে বসতে হয়েছিল। বিয়ের পর সব ভুলতেও চেয়েছিল। কিন্তু সে স্বামীর কাছে শুধু একটি শরীর ছাড়া কিছু তো ছিল না। কিন্তু প্রেমিকের কাছে? ওর কাছে তো তার কোনো অস্তিত্বই ছিল না। ওই প্রেমিকের কোনো মন ছিল না। পাথর। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া একটি রোবট। বাইরে হাসিখুশি কিন্তু ভেতরটা গম্ভীর। তার চোখ, মুখ, বলিষ্ঠ দেহ সৌষ্ঠব, পুরুষালি ভাবভঙ্গি এখনও তাকে আকৃষ্ট করে রেখেছে। কালো মিচমিচে শরীরের ঘ্রাণ এখনও তাকে ঘুমের ঘোরে ডাকে। কিন্তু প্রেমিক তো আর ডাকে না। তাই পেটে যা এসেছে তা নিয়ে না হয় আজীবন বেঁচে থাকবে।
কয়েক মাস পরের অন্ধকার রাত। রাজধানীর দুজোড়া রেললাইনের ওপর মেঘেরা ঠাঁই করে নেয়ার সুযোগ পেয়েছে কিনা, পায়নি। কয়েকজন লোক লাল-সবুজ পতাকাবাহী গাড়ি থেকে প্রাণহীন কিছু একটা ছুড়ে মেরে পালিয়ে যায়। তা দেখে রেললাইনের পাশে বিদ্যুতের খুঁটিতে বসা কাকগুলো চঞ্চল হয়ে ওঠে। পাখা ঝাপটায়।
পরদিন সকালে মিথ্যা অক্ষর ও শব্দে পত্রিকার এককোণে ঠাঁই পায় আত্মহত্যার খবর। তবে নাম-পরিচয়হীন। কেউ কেউ আবার ‘আত্মহত্যা’ না পরিকল্পিত ‘হত্যা’ তা নিয়েও প্রশ্ন তোলে। তবে বড় মিনমিনে গলায়। এসব গলা কারো কাছে পৌঁছায়ও না। ফেসবুকওয়ালারও কোনো প্রশ্ন তোলেন না। তারা এখন মাথামুণ্ডুহীন অন্য প্রসঙ্গ নিয়ে ব্যস্ত।
খবরটা শরিফ আবদুরও দেখেছেন। মুখ দেখে চিনেছেন। সন্ধ্যায় রাস্তার মোড়ে বন্ধুদের আড্ডায় অন্যান্য নর-নারীর মতো এই প্রসঙ্গটিও আসে। খুব সংক্ষিপ্ত করে মন্তব্য করে শরিফ, ‘আল্লাহ সেইভাবেই তার মরণ লিখছিল, তাই মরছে। কার কী করার আছে?’ হৈ-হল্লার অন্যরা আর কিছু বলার সাহস পায় না। এর প্রতিবাদ করতে গেলে না জানি ঘাপটি মেরে থাকা কোনো জঙ্গি হামলা চালায় আবার।
নারীটি তখন কষ্টে নীল আকাশে শুধুই ঘুরছিল। আর প্রেমিকের কথা মনে পড়ছিল। নিরুপায় হয়ে শরিফের ঘুমের মধ্যে হানা দেয় সে। ‘তুমি তো পাপ হওয়ার ভয়ে আমাকে কোনদিন ছুঁয়েও দেখনি। তোমার হাতটা একটু ধরব বলে, সেই যে তুমি গেলে আর আসোনি। কিন্তু তুমি কি জানো, মৃত্যুর পর মানুষের কী হয়?’ ‘কর্মফল অনুযায়ী প্রাপ্তি হয়’। কান্না আসে নারীর। কিন্তু মৃতদের চোখ দিয়ে জল গড়ায় না। তাই কষ্ট আরো বেড়ে যায়।‘তুমি কি জানো আমি আজও শূন্য। না হয় শুধু বন্ধু হয়েই পাশাপাশি থাকতে তুমি। কিংবা একজন শুভাকাঙ্ক্ষি। বা কল্পলোকে বসবাস করা প্রেমিক। কিন্তু তুমি আমাকে কিছুই দাওনি। আমার সব অধিকার তুমি কেড়ে নিয়েছো। এটা তো আমার প্রাপ্য ছিলো না। আমি শেষবারের মতো তোমাকে একটু ছুঁয়ে দেখব।’আঁৎকে ওঠে শরীফ আবদুর, ‘ছি ছি, এসব তুমি কী বলছ? তুমি তো এখন ভূত!’‘মানুষ মানুষকে ছুঁলে কি পাপ হয়?’‘যাও, তুমি চলে যাও।’
ঘুম থেকে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে সে। দুই মাসের পোয়াতি বউটারও ঘুম ভেঙে যায়। পেট থেকে কোনো কথা বের হয় বলে দাবি করা শরিফ স্বপ্নে আসা সবকিছু বউকে বলে দেয়। বউ ভ্রু কুচকে সবকিছু শোনে। সবই বিশ্বাস হয় বউয়ের। কিন্তু নারীটি যে মরে গেছে তা বিশ্বাস করে না। তাই সারা রাত তার মন পুড়তে থাকে। অথচ অল্প কিছুক্ষণ পরই শিশুর মতো ঘুমোতে থাকে শরিফ।
এসইউ/আরআইপি