ড. শাহদীন মালিক, বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ। ষোড়শ সংশোধনী, তথ্যপ্রযুক্তি আইনসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। যুক্তি তুলে ধরেন ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পক্ষে। ‘বিরোধীপক্ষকে ঘায়েল করতেই তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা’ বলেও মন্তব্য করেন। হতাশা প্রকাশ করেন সামনের জাতীয় নির্বাচন নিয়েও। তিন পর্বের ধারাবাহিকের দ্বিতীয়টি আজ প্রকাশিত হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।
Advertisement
জাগো নিউজ : বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে নানা প্রশ্ন। প্রশ্ন তুলছেন আপনারাও। রাষ্ট্র অযাচিত হস্তক্ষেপ করছে- নিম্ন আদালতে এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে কী বলবেন?
ড. শাহদীন মালিক : সরকার তো নিম্ন আদালতের স্বাধীনতা দিতে চাইছে না। নিম্ন আদালতের বিচারকদের বদলি, পদোন্নতি, শৃঙ্খলার বিষয়টি সরকার নিজের কাছে রেখে হস্তক্ষেপ করতে চাইছে।
সরকার ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরতে চাইছে। ভালো কথা। ১৯৭২ সালের সংবিধানেই বলা ছিল, বিচারকদের পদোন্নতি, বদলি, শৃঙ্খলার বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত থাকবে। চতুর্থ সংশোধনীতে বঙ্গবন্ধু এটিকে রাষ্ট্রপতির হাতে দিয়ে দিলেন। জিয়াউর রহমানের আমলে দ্বৈত ব্যবস্থা চালু করা হলো। অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্ট ও সরকার উভয়ই নিয়ন্ত্রণে রাখল।
Advertisement
জাগো নিউজ : এখন?
ড. শাহদীন মালিক : সেই অবস্থাই বিরাজমান। আইন মন্ত্রণালয় বিচারকদের বদলি, পদোন্নতির ব্যাপারে প্রস্তাব রাখে এবং সুপ্রিম কোর্ট মন্ত্রণালয়ের চাহিদা মোতাবেক সিদ্ধান্ত নিলেই কেবল বাস্তবায়ন হয়।
সরকারি লোকের জামিন না দিলে বিচারকরা বদলির ভয়ে থাকেন- এটি অভিযোগের ভিত্তিতে বলছি। বদলি, পদোন্নতির ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের হাতে চলে আসলে এ ভয় আর থাকবে না। এ কারণে সরকার এই ক্ষমতা ছাড়তে চাইছে না। বারবার সময় নিয়ে ক্ষমতা নিজের হাতে রাখতে চাইছে।
মাজদার হোসেন মামলার রায়ে ১৯৯৯ সালে সরকারকে এ ব্যাপারে নীতিমালা করে দেয়ার কথা বলা হয়েছিল। ২০১৭ সাল যাচ্ছে, সরকার এখনও সময় চাইছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় কিছুটা উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। এখন তা আবারও স্থবির। একই অবস্থা বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রেও। বিচারপতি নিয়োগের আইন নেই। বিচারপতি নিয়োগ সম্পূর্ণ সরকারের ওপর বর্তায়।
Advertisement
প্রধান বিচারপতি অভিযোগ করে বললেন, ‘আট মাস আগে আটজন বিচারপতি নিয়োগের জন্য প্রস্তাব করেছিলাম। কিন্তু সরকার কিছুই করছে না।’
জাগো নিউজ : বিচারপতি নিয়োগের জটিলতা রোধে কী বিধান হতে পারে?
ড. শাহদীন মালিক : একটি কমিটি তৈরির বিধান থাকতে পারে, যে কমিটি বিচারপতি নিয়োগ দেবে। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কমিশন নামে একটি আইনও করা হয়েছিল।
নয়জন ব্যক্তিকে দিয়ে একটি সিলেকশন কমিটি গঠন করা হবে, যে কমিটি বিচারপতিদের সিলেকশন করবেন। আমি অবশ্য এর বিরুদ্ধে মামলা করে আইনটি বাতিল করেছিলাম।
কমিটিতে আইন সচিব রাখার কথা ছিল। ভারতেও এমন কমিটিতে আইনমন্ত্রীকে রাখার কথা বলা হয়েছিল। আদালত বাতিল করে দিয়েছেন। কারণ রাষ্ট্রই হচ্ছে প্রধান মামলাবাজ। সেই রাষ্ট্রের আইন মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্তাব্যক্তি যদি কমিটিতে থাকেন, তাহলে তো নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্চ হতে পারে না।
জাগো নিউজ : তাহলে কী পদ্ধতি হতে পারে?
ড. শাহদীন মালিক : প্রধান বিচারপতিসহ আরও দু’জন বিচারপতি কমিটিতে থাকতে পারেন। অ্যাটর্নি জেনারেল থাকতে পারেন। বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান, আইন বিভাগের কোনো জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকও কমিটিতে থাকতে পারেন। আমি যা বলছি, সেটাই ঠিক তা মনে করি না। কিন্তু ধারণাটি এমন হতে পারে। অন্যান্য দেশেও এমন হয়।
জাগো নিউজ : কিন্তু এমন কমিটিও অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নিয়োগ দিতে পারে?
ড. শাহদীন মালিক : দায়বদ্ধতা না থাকলে যেকোনো প্রক্রিয়াতেই অস্বচ্ছতা থাকতে পারে। তবে আমি মনে করি, কমিটি প্রত্যেক প্রার্থীর সাক্ষাৎকার নেবে রাষ্ট্রপতির কাছে নাম পাঠানোর আগে। ফিলিপাইনে সহকারী বিচারক নিয়োগে প্রকাশ্যে সাক্ষাৎকার নেয়া হয়। অনেক দেশেই এ প্রক্রিয়ায় বিচারক নিয়োগ দেয়া হয়।
জাগো নিউজ : দেশের সার্বিক পরিস্থিতি কিভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন?
ড. শাহদীন মালিক : প্রতিষ্ঠানগুলো সক্ষমতা হারিয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো বা এর প্রধানদের যেভাবে কাজ করার কথা, তা করতে পারছেন না।
একটি পরিবারে সবাইকে কাজ করতে হয়। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে শুধু বড় ভাই মাথার ঘাম পায়ে ফেলবে, আর বাকি চারজন নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকবে, তাহলে ওই পরিবারে সুখ স্থায়ী হতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী একাই চারজনের কাজ করছেন। কিন্তু রাষ্ট্রের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো তো ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা। ২০০৯ সালের পর থেকে প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমান্বয়ে স্থবির হয়ে পড়ছে। একই ব্যক্তি দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান হয়ে রয়েছেন।
এমন দুর্বল প্রতিষ্ঠান দিয়ে জোড়াতালির সমাধান মেলে, কিন্তু স্থায়ী কোনো সমাধান আসে না।
জাগো নিউজ : এ পরিস্থিতির জন্য কোন বিষয়কে দায়ি করবেন?
ড. শাহদীন মালিক : আমি মূলত রাজনীতিকেই দায়ী করব। রাজনীতিতে জবাবদিহিতার প্রসঙ্গ আর নেই। নাগরিকের কাছে তাদের কৈফিয়ত দিতে হয় না।
সরকারগুলো মনে করে পাঁচ বছর পর আবারও ক্ষমতায় আসতে হবে এবং সেভাবেই আখের গোছাতে হবে। নিজ দলের লোকদের ওপর ভরসা করলেই ফের ক্ষমতায় আসা যাবে।
জাগো নিউজ : ইতিহাস তো তা বলে না। জনগণ ভোট দেয়ার সুযোগ পেলেই সরকার বদলে যায়।
ড. শাহদীন মালিক : ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না বলেই সকল ক্ষেত্রে এ রাজনীতিকরণের চেষ্টা। ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালের নির্বাচন ছাড়া প্রতিটি নির্বাচনেই সরকার বদল হয়েছে। জনগণ ভোট দেয়ার সুযোগ পেলেই সরকার পরিবর্তন হয়েছে। তার মানে, পূর্বতন সরকারের রাজনীতিকরণ জনগণ গ্রহণ করেনি। তারা ভালো চোখে নেয়নি।
জাগো নিউজ : কিন্তু দেশ তো এগিয়ে যাচ্ছে। সরকার ব্যাপক উন্নয়নের বাণী শোনাচ্ছে। বড় বড় প্রকল্প নিয়ে উচ্ছ্বাসিত সরকারপক্ষের লোকেরা…
ড. শাহদীন মালিক : এ উন্নয়ন হচ্ছে আইয়ুব খানের মডেল। দুনিয়ার সমস্ত সামরিক সরকারই এমন উন্নয়নের মডেল দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে বা করে।
এর একটি কারণ আছে। আজ থেকে ৩০ বছর আগে বড় প্রকল্প করার ক্ষমতা শুধু সেনাবাহিনীরই ছিল। এত ইঞ্জিনিয়ার বা দক্ষ লোক অন্য সেক্টরে ছিল না। সেনাবাহিনী ক্ষমতায় এসেই মেগা প্রজেক্ট করে জনগণকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছে। এটি সেনাশাসকদের ধারণা।
কিন্তু এ ধারণা দিয়ে তো সেনাশাসকরা টিকতে পারেনি। ভোটে গেলেই সেনাশাসকরা হেরে গেছেন। আফ্রিকাই হোক আর আমাদের দেশেই হোক, সেনাশাসকদের একই হাল লক্ষ্য করা যায়।
জাগো নিউজ : এই সরকার তো নির্বাচিত। এখন কী দেখছেন?
ড. শাহদীন মালিক : সেনাশাসকের আদলেই উন্নয়নের মডেল দাঁড় করিয়েছে সরকার। বুঝে হোক আর না বুঝেই হোক, সেনাবাহিনীর মতোই মেগা প্রজেক্ট দিয়ে জনগণকে প্রভাবিত করতে চাইছে সরকার।
এমন উন্নয়ন এবং জনগণের ক্ষমতায়নের মধ্যে অনেক তফাত আছে। সেনা মডেলের উন্নয়নে জনগণের ভাগ্য ফেরে না। জনগণ সব সময় ন্যয় বিচারের প্রত্যাশা করে। পদ্মা সেতুতে কার ভাগ্য উন্নয়ন হবে, সেটা অনেক পরের হিসাব। এক রিকশাচালক ৩০ টাকা কেজির চাল ৪০ টাকায় কিনছেন- এটিই তার কাছে অনেক বড় হিসাব।
সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো মেগা প্রজেক্ট তো দুনিয়ার আর কোনো রাষ্ট্র করেনি। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেল। আমাদের এখানে এরশাদের আমলেও মেগা প্রজেক্ট করা হয়েছে। কিন্তু এরশাদের বিদায় হয়েছে করুণ পরিণতির মধ্য দিয়ে। সরকারের লোকেরা পদ্মাসেতু নিয়ে অনেক কথা বলছেন। কিন্তু গ্রামের হাসপাতালে ডাক্তার বা স্কুলে শিক্ষক নেই তা নিয়ে কোনো আওয়াজ হয় না। জনগণ ভোট দিতে পারলে এ আওয়াজই বড় করে দেখবে। মেগা প্রজেক্টে আসলে জনগণ আস্থা রাখে না।
জাগো নিউজ : তাহলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কী?
ড. শাহদীন মালিক : মানুষ তার অধিকার বঞ্চিত হচ্ছে। ন্যায্যতার ভিত্তিতে যে সমাজ গঠন করার কথা, তা হচ্ছে না। উন্নয়নের আড়ালে মানুষের অধিকার খর্ব হচ্ছে। আপনি লাখ টাকা দিয়ে একজনকে সাহায্য করে তাকে অন্য কোনোভাবে অধিকার বঞ্চিত করলেন। সে লাখ টাকার সাহায্য মনে রাখবেন না। আর দশ টাকা দিয়ে যদি কোনো মানুষের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে হাসিমুখে কথা বলেন, সে আপনার প্রেমে পড়ে যাবে।
চাপিয়ে দেয়া উন্নয়ন নাগরিকের অধিকার খর্ব করে। ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া তার উদাহরণ। ওই দেশের মানুষের মাথাপিঁছু আয় আমাদের থেকে অনেক বেশি। ব্যাপক উন্নয়ন করেছে সাদ্দাম বা গাদ্দাফির সরকার। এরপরও জনগণ সরকারগুলোর প্রতি আস্থা রাখেনি। বিদেশি হস্তক্ষেপ ছিল বটে। কিন্তু দেশের মানুষও স্বৈরশাসকদের পতন চেয়েছে।
একজন মানুষ রাষ্ট্রের কাছ থেকে মানুষের অধিকারই প্রত্যাশা করে। কথা বলার অধিকার না থাকলে আপনি উন্নয়ন দিয়ে মন জয় করতে পারবেন না। আমি খারাপ এবং এটি বলার অধিকার আপনার থাকতে হবে। কিন্তু কেউ কি সেই অধিকার ভোগ করতে পারছেন?
এএসএস/এমএআর/জেআইএম