এক বছর ধরে সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ, চার বছর ধরে লাভের মুখ দেখেনি, প্রতিনিয়ত বাড়ছে দায়ের পরিমাণ, সম্পদ মূল্য ঋণাত্মক, বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশ দিতে না পারায় স্থান হয়েছে পঁচা কোম্পানির তালিকায় (জেড গ্রুপে)- এমনই অবস্থা জুট স্পিনার্সের।
Advertisement
আর্থিক অবস্থা এতো নেতিবাচক হওয়ার পরও প্রতিনিয়ত প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার দামে উল্লম্ফন ঘটছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) থেকে একাধিকবার সতর্ক করা হলেও থামছে না জুট স্পিনার্সের শেয়ারের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি।
অবশ্য প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার দাম প্রায় দেড় মাস ধরে বাড়ার পর ডিএসই থেকে বিনিয়োগকারীদের সতর্ক করা হয়েছে। শুধু তাই না এক বছর ধরে সকল কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও প্রথমে ডিএসই থেকে বিনিয়োগকারীদের এ তথ্য জানানো হয়নি।
প্রথমে দু’বার (২০ জুলাই ও ২৩ জুলাই) ডিএসই থেকে বিনিয়োগকারীদের সতর্ক করা হয় বলে ‘জুট স্পিনার্সের শেয়ারের অস্বাভাবিক দাম বাড়ার পেছনে কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই।’ এরপর ২৪ জুলাই কোম্পানির বরাত দিয়ে ডিএসই জানায়, ২০১৬ সালের জুলাই থেকে প্রতিষ্ঠানটির সকল কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
Advertisement
ডিএসইর এমন আচরণে অভিযোগ উঠেছে স্টক এক্সচেঞ্জটির দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের ছত্রছায়ায় কারসাজি চক্র শেয়ারবাজারে পঁচা কোম্পানির বা ‘জেড’ গ্রুপের শেয়ার নিয়ে কারসাজিতে লিপ্ত। যে কারণে দীর্ঘদিন টানা দাম বাড়ার পর এবং কারসাজি চক্র ফায়দা লুটে নেয়ার পর ডিএসই থেকে বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশ্যে সতর্কতা জারি করা হয়।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, জুন থেকে ২৪ জুলই পর্যন্ত ৩৩ প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। এর মধ্যে ১৮ প্রতিষ্ঠানই জেড গ্রুপের। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেই ডিএসই থেকে সতর্কতা জারি করা হয়েছে ওই কোম্পানির শেয়ারের দাম টানা এক থেকে দেড় মাস বাড়ার পর।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অস্বাভাবিক দাম বাড়ার বিষয়ে যদি স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে দেরিতে সতর্ক করা হয় এবং কোনো তথ্য গোপন করা হয়, তাহলে এর পেছনে স্টক এক্সচেঞ্জের কর্মকর্তাদের অসৎ উদ্দেশ্য থাকলেও থাকতে পারে। এমন ঘটনা ঘটে থাকলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি) তা খতিয়ে দেখা উচিত।
তাদের মতে, জেড গ্রুপের কোম্পানি মানেই পঁচা কোম্পানি। এ ধরনের কোনো কোম্পানির শেয়ারের দাম টানা পাঁচ থেকে সাতদিন বাড়লেই স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে কোম্পানি কর্তৃপক্ষের কাছে কারণ জানতে চাওয়া উচিত। সেখানে টানা এক থেকে দেড় মাস পর কারণ জানতে চাওয়া কিছুতেই যুক্তিযুক্ত হতে পারে না। এতো দেরিতে কারণ জানতে চাইলে কারসাজি চক্র ফায়দা লুটে নেয়ার সুযোগ পাবে।
Advertisement
তারা বলছেন, বিনিয়োগকারীদের সতর্ক করার বিষয়ে স্টক এক্সচেঞ্জের যেমন দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি নিজের বিনিয়োগ নিরাপদ করারও দায়িত্ব বিনিয়োগকারীদের। জেড গ্রুপের প্রতিষ্ঠানের শেয়ারে বিনিয়োগ করা ঝুঁকিপূর্ণ। এ কোম্পানির বিনিয়োগকারীদের কিছু দিতে পারছে না এটি বোঝাতেই জেড গ্রুপে আন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরপরও যদি কেউ জেড গ্রুপে বিনিয়োগ করে লোকসন করেন তার দায় অবশ্যই বিনিয়োগকারীকে নিতে হবে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, পাঁচ থেকে সাতদিন দাম বাড়ার পরই স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে সতর্কতা জারি করা উচিত। সতর্কতা জারির ক্ষেত্রে এক থেকে দেড় মাস সময় নেয়া কিছুতেই উচিত না। এছাড়া বিনিয়োগকারীদেরও বোঝা উচিত জেড গ্রুপে থাকা কোম্পানি খারাপ।
তিনি বলেন, স্টক এক্সচেঞ্জের কর্মকর্তাদের সহায়তায় বাজারে কারসাজির ঘটনা ঘটতে পারে। জুট স্পিনার্সের উৎপাদন বন্ধের ঘোষণা প্রথম দুই ধাপে জরি করা সতর্কতায় কেন উল্লেখ করা হয়নি, তা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির খতিয়ে দেখা উচিত। যদি কোম্পানি থেকে তথ্য গোপন করা হয় তাহলে এর বিরুদ্ধে এবং স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে তথ্য গোপন করা হলে স্টক এক্সচেঞ্জের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত।
বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী জাগো নিউজকে বলেন, জেড গ্রুপের শেয়ারের দাম বৃদ্ধি নিয়ে শুধু স্টক এক্সচেঞ্জকে দোষ দিলে হবে না। বিনিয়োগকারীরা কেন এমন শেয়ারে বিনিয়োগ করবে? যদি কোনো বিনিয়োগকারী অতিলোভের আশায় জেড গ্রুপের শেয়ারে বিনিয়োগ করেন এবং লোকসান করেন তার দায় অবশ্যই ওই বিনিয়োগকারীকে নিতে হবে। এক্ষেত্রে স্টক এক্সচেঞ্জ সতর্ক করুক বা না করুক।
ডিএসই’র পরিচালক রকিবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, জেড গ্রুপের শেয়ারের কোনো ফান্ডামেন্টাল নেই। এমন শেয়ারের দাম বাড়লে নিজের কাছেও খারাপ লাগে। বিনিয়োগকারীরা কেন সেই শেয়ার কেনে?
তিনি বলেন, একটি কোম্পানিকে জেড গ্রুপে নেয়ার মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের বোঝানো হয় এতে বিনিয়োগ করো না। একটি ভালো কোম্পানির শেয়ার ২০ টাকা দিয়ে না কিনে কেন জেড গ্রুপের শেয়ার ১০০ টাকা দিয়ে বিনিয়োগকারীরা কেনন- এর পেছনে কী যুক্তি আছে বুঝি না। আমার মনে হয় এসব শেয়ার টানা-হেঁচড়া করলে দাম বাড়ে, সে কারণে বিনিয়োগকারীরা এর মধ্যে প্রবেশ করে। তবে আমি মনে করি কোনো বিনিয়োগকারীর জন্য এ বিনিয়োগ ভালো না।
তিনি আরও বলেন, জেড গ্রুপের কোনো কোম্পানির শেয়ারের দাম ৩০ টাকা হলেই বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশ্যে সতর্কতা জারি করা উচিত। সতর্কতা জারির ক্ষেত্রে এক থেকে দেড় মাস অপেক্ষা না করে ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যেই তা করা উচিত। তবে এতো সতর্ক করার পরও কেন বিনিয়োগকারীরা জেড গ্রুপের শেয়ার কেনা-বেচা করবে? এখানে যদি কোনো মেনুপুলেট (কারসাজি) হয় তবে সার্ভিলেন্স টিমকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, সর্বশেষ প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী চলতি বছরের মার্চ শেষে ৭৭ লাখ টাকা লোকসানে রয়েছে রহিমা ফুডস। অথচ ৩০ মে থেকে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের দাম ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। ৩০ মে প্রতিষ্ঠানটির প্রতিটি শেয়ারের দাম ছিল ১০৬ টাকা ২০ পয়সা, যা ১৮ জুলাই বেড়ে দাঁড়ায় ১৮১ টাকায়। এরপরই প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে বলে সতর্কতা জারি করে ডিএসই।
শুধু চলতি বছর নয়, ২০১৬ সালেও বড় ধরনের লোকসানে ছিল এ প্রতিষ্ঠানটি এবং দিনের পর দিন এ লোকসানের পরিমাণ বেড়েছে। অবশ্য মাসের পর মাস প্রতিষ্ঠানটির লোকসানের পরিমাণ যেমন বেড়েছে, শেয়ারের দামও এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। গত ১৬ অক্টোবর রহিমা ফুডের প্রতিটি শেয়ারের দাম ছিল ৫৯ টাকা ৮০ পয়সা। সেখান থেকেই ধাপে ধাপে বেড়ে ১৮ জুলাই প্রতিটি শেয়ারের দাম ২০০ শতাংশের ওপরে বেড়ে ১৮১ টাকায় দাঁড়ায়।
বড় ধরনের লোকসানে থাকা আর এক প্রতিষ্ঠান দুলামিয়া কটন। সর্বশেষ প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ শেষে এক কোটি ৯৯ লাখ টাকা লোকসানে রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। অথচ জুনের ৫ তারিখ থেকে ১৬ জুলাই পর্যন্ত প্রতিষ্ঠনটির শেয়ারের দাম টানা বাড়ে। একটানা দাম বৃদ্ধির পর যখন প্রতিষ্ঠানটির প্রতিটি শেয়ারের দাম ৪০ শতাংশের ওপরে বেড়ে যায়, সেই সময় ১৭ জুলাই অর্থাৎ দেড় মাস পর ডিএসই থেকে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক বাড়ার বিষয়ে সতর্কতা জারি করা হয়।
এভাবে অস্বাভাবিক দাম বাড়ার বিষয়ে ডিএসই জুন থেকে যেসব কোম্পানির বিষয়ে সতর্কতা জারি করেছে তার মধ্যে রয়েছে- হাক্কানী পাম্প, সিমটেক্স, ইমাম বাটন, পিপলস লিজিং, ইউনাইটেড পাওয়ার জেনারেশন, সায়হাম কটন, বিডি অটোকার, তুং হাই নিটিং, কেয়া কসমেটিক, পেনিসুলার চিটাগাং, রংপুর ডেইরি, বঙ্গজ, ফু-ওয়াং ফুড, স্ট্যান্ডার্ড সিরামিক, ফাইন ফুড, ন্যাশনাল হাউজিং ফাইন্যান্স, এইচ আর টেক্সটাইল, সি অ্যান্ড এ টেক্সটাইল, কে অ্যান্ড কিউ, মেঘনা কনডেন্সড মিল্ক, মেঘনা পেট, লিগ্যাসি ফুট ওয়্যার, রূপালী ব্যাংক, সমতা লেদার, রিজেন্ট টেক্সটাইল, কেপিপিএল, আজিজ পাইপ, বিডি ওয়াল্ডিং, সাভার রিফ্র্যাক্টরিজ, সিনো বাংলা, শাইন পুকুর সিরামিক ও বিচ হ্যাচারি।
এমএএস/এএইচ/এমএআর/পিআর