অর্থনীতি

বিনিয়োগমুখী নমনীয় মুদ্রানীতি চান অর্থনীতিবিদরা

চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতিতে ব্যাংকের তারল্য ব্যবহার নিশ্চিত করতে বিনিয়োগের বিষয়ে সুনির্দিষ্টি দিক-নির্দেশনা থাকা উচিত। একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণেও কার্যকর পদক্ষেপ দরকার। তাই আসন্ন মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বিনিয়োগমুখী নমনীয় মুদ্রানীতি গ্রহণ করা উচিত বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

Advertisement

চলতি (২০১৭-১৮) অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতি আগামীকাল বুধবার (২৬ জুলাই) ঘোষণা করবেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। আসছে মুদ্রানীত কেমন হওয়া উচিত- জাগো নিউজের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদদের মতামত জানতে চাওয়া হয়।

ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম

আসন্ন মুদ্রানীতি সম্পর্কে অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, মুদ্রানীতিতে সাধারণত বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ ও সুদহার বিষয়ে নির্দেশনা থাকে। বর্তমানে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ ভালো অবস্থায় নেই। সুদহার কম হলেও আন্তর্জাতিক মানে এখনও আসেনি।

Advertisement

তিনি বলেন, সব সময় ব্যাংলাদেশ ব্যাংক বাজেটের প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরে মুদ্রানীতি ঘোষণা করে থাকে। এবারও ঋণের প্রবাহ আগের নেয়া ১৬ শতাংশ থেকে সাড়ে ১৬ শতাংশ ধরবে। তবে মুদ্রানীতিতে বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে। এ তারল্য কিভাবে ব্যবহার করা যায় তার সুনির্দিষ্ট দিক-নির্দেশনা থাকতে হবে। রেমিট্যান্স প্রবাহ কিভাবে বাড়ানো যায়- এ বিষয়ে মুদ্রানীতিতে নির্দেশনা থাকা প্রয়োজন বলেও মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ।

তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ ব্যাংকিং খাতের বড় সমস্যা। তাই আগামীতে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কিভাবে কমিয়ে আনবে এ বিষয়ে জোর দেয়া প্রয়োজন। একই সঙ্গে বেসরকারি খাতের ব্যাংক ঋণ উৎপাদনশীল খাতে যেন যায় সেই বিষয়েও সুনির্দিষ্ট দিক-নির্দেশনা দিতে হবে।

ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, সামনে যে মুদ্রানীতি আসবে তা বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জের হবে। কারণ বর্তমানে রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় নেতিবাচক ধারায় রয়েছে।

Advertisement

প্রথমার্ধের মুদ্রানীতিতে বিনিয়োগের ওপর বেশি জোর দিতে হবে। বিশেষ করে বেসরকারি খাতে। কারণ বাজেটে ঘোষিত প্রবৃদ্ধি অর্জনে অনেক বিনিয়োগ প্রয়োজন। পাশাপাশি দেশি-বিদেশি নানা কারণে মূল্যস্ফীতির চাপ রয়েছে। এটি নিরসনের উদ্যোগও থাকতেহবে।

এছাড়া যে হারে বাজারে লোক আসছে সেই হারে কর্মসংস্থান হচ্ছে না। তাই কর্মসংস্থান বাড়ানোর ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।

সাবেক এ গভর্নর বলেন, রেমিট্যান্স ও রফতানির এক বিশেষ কারণ এক্সচেঞ্জ রেট খুবই শক্তশালী। এ বিষয়ে চিন্তা করতে হবে। অর্থাৎ এক্সচেঞ্জ রেট সহনীয় পর্যায়ে আনতে হবে। খেলাপি ঋণ কমানোর বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। এছাড়া সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমানোর বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজর দেয়ারও পরামর্শ দেন তিনি।

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ জাগো নিউজকে বলেন, যে মুদ্রানীতি আসছে তা বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জ হবে। কারণ বাজেটে বেশকিছু বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই। নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন স্থগিত হয়েছে। বাজেটের খরচ বাড়ছে। কিন্তু আয়ের খাত কমে গেছে। তবে প্রকল্প কিছু কাটছাট করলে আয়-ব্যয়ে তেমন সমস্যা হবে না।

তিনি বলেন, সরকার বাজেটের ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীণ খাত হিসেবে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়ে থাকে। এখন বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ বাড়ানো দরকার। এ অবস্থায় ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হবে। আর বিদেশ থেকে ঋণ আনলে বাজারে টাকার প্রবাহ বেড়ে যাবে। এতে মূল্যস্ফীতি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রায় রাখা সম্ভব হবে না। তাই মুদ্রানীতি নমনীয় (ফ্ল্যাক্সিবল) হওয়া উচিত। অর্থাৎ কোনো বিষয় সমস্যা হলে তাৎক্ষণিক সরে এসে সমাধান করতে হবে।

ড. বিরূপাক্ষ পাল

নতুন মুদ্রানীতির বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. বিরূপাক্ষ পাল জাগো নিউজকে বলেন, বিনিয়োগবান্ধব, প্রবৃদ্ধিসহায়ক মুদ্রানীতি প্রয়োজন। নতুন মুদ্রানীতিতে বিনিয়োগের ওপর জোর দিতে হবে। কারণ সরকারি খাতে বিনিয়োগ হলেও বেসরকারি খাতেবিনিয়োগ অনেকটা স্থবির আছে। এটা বাড়াতে হবে। এছাড়া ব্যাংকিং খাতে যে তারল্য রয়েছে, বিনিয়োগ পরিস্থিতি যদি চাঙা করা না যায় তাহলে তা অলস পড়ে থাকবে।

সুদহার সমন্বয়ের ওপর জোর দেয়া উচিত। কারণ সঞ্চয়পত্রের সুদহার ও বাজারের সুদহারের পার্থক্য অনেক। তা কমানো প্রয়োজন। এ বিষয়ে সরকারকে ম্যাসেজ দেয়া, একই সঙ্গে এক্সচেঞ্জ রেটের বিষয়েও মুদ্রানীতিতে নির্দেশনা থাকা দরকার।

সরকারের নির্ধারিত জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনকে সামনে রেখে মুদ্রানীতিতে বিভিন্ন প্রাক্কলন করা হয়। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ৪ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হয়েছে।

গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ ঋণপ্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হয়। আর ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত গড় বার্ষিক ভোক্তা মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বসীমা ধরা হয়েছিল ৫ দশমিক ৮ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের এপ্রিলের শেষে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ছয় লাখ ৪৪ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা। আগের বছরের একই সময় শেষে এটি ছিল পাঁচ লাখ ৫৭ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা। এ হিসাবে এক বছরে ঋণ বেড়েছে ৮৬ হাজার ৯৫৮ কোটি টাকা বা ১৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ।

প্রসঙ্গত, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জনের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতি বছর দু’বার মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও প্রকাশ করে। ছয় মাস অন্তর এ মুদ্রানীতি একটি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে অর্থাৎ জুলাইয়ে এবং অন্যটি জানুয়ারিতে।

দেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় মুদ্রানীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে পরবর্তী ছয় মাসে অভ্যন্তরীণ ঋণ, মুদ্রা সরবরাহ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ, বৈদেশিক সম্পদ কতটুকু বাড়বে বা কমবে এর একটি পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়।

এসআই/এমএআর/জেআইএম