মেঘ করে আসছে। কোথাও বৃষ্টিও পড়ছে, ভেজা মাটির গন্ধ। আহ! এই একটা ব্যাপারই আছে বৃষ্টিতে। নাহলে খরতাপা মাঠের কৃষক ছাড়া আর কারো কেন বৃষ্টি ভালো লাগবে রিনির স্বল্প জ্ঞানের পরিধিতেই আসে না। বৃষ্টি এক বালাই মাত্র! বাইরে থাকলে রাস্তাঘাটে তুমুল যন্ত্রণা, ঘরে কাপড় শুকানোর ঝামেলা। ঘরভর্তি কাপড় মেলো, সেই কাপড় গ্যাসের চুলার আগুনে শুকিয়ে ত্যাকত্যাকে একটা ভাব আর গন্ধ- এহ! মেঘটা আসছেও ঝেঁপে দেখো এই সময়েই। স্কুল ছুটির সময়। ধ্যাত্তেরি।চেহারা বাংলার পাঁচ বানায়ে রাখছিস ক্যান?
Advertisement
তুলি এতক্ষণ কি বলছিল সে খেয়াল করেনি। এসময় তার এক প্রবল ঘোর লাগা সময়, স্কুল থেকে দ্রুত পা চালিয়ে ফেরা। যদি মিস হয়ে যায়! তুলি কনুই দিয়ে গোত্তা দিল,আরে হইছে কি?মুখে বিরক্তিসূচক চুকজাতীয় শব্দ করলো রিনি। রিনির এই অভ্যাস বা বদভ্যাস তুলির চেনা। আপাতত চুপ হয়ে গেল ভ্রু কুঁঁচকে। বৃষ্টির ফোঁটা পড়া শুরু করলো। ধ্যাত্তেরি! দুইজনে দুই পথে দৌড় লাগালো।
আজ মিস হয়েই গেল!সারা সন্ধ্যা আজ আর কিছুই ভালো লাগবে না। সন্ধ্যার নাস্তা আর রাতের খাবারে পারিবারিক আড্ডা ভালো লাগবে না, রাতে ধারাবাহিক নাটক- সব ম্যাড়ম্যাড়ে নির্মোহ লাগবে। কিন্তু কেন এমন হবে? রিনির খুব খুব খারাপ লাগে। তার ভালো লাগা মন্দ লাগা কেন অন্য কারোর সাথে জড়িয়ে থাকবে? সেও এমন এক মানুষ যে তাকে চেনেই না। কোনদিন সে রিনিকে কোথাও দেখলেও চিনবে না, কারণ সেই মানুষ তো তাকে দেখেইনি। কেবল রিনিই তাকে দেখে যায়।
কবে কোনদিন মানুষটাকে সে দেখেছিল? নাহ, মনে নেই। শুধু মনে আছে- যেদিন দেখেছিল সেদিন মনে হয়েছিল, এই মানুষকে সৃষ্টিকর্তা নিজ হাতে রিনির স্বপ্ন থেকে বের করে বানিয়েছেন। আহারে মানুষ! কি সুন্দর! কি নিখুঁত একজন মানুষ! এমন ছেলে বইয়ের পাতায় থাকে, বাস্তবের সিনেমাতেও এমন ছেলে নেই। হুট করেই তার বাল্যকালটায় সন্ধ্যা নেমে গিয়েছিল যেন।
Advertisement
স্কুলে আসা যাওয়াটায় বান্ধবী বা কেউ সঙ্গী হবে। ক্লাসে বেঞ্চের ভেতরে দেয়ালে ঘেঁষে বসতে হবে, ‘কেউ’ যেন তাকে ছুঁতে না পারে। মাথার কাপড় যেন না সরে। সে বড় হয়ে গেছে। স্কুল থেকে ফিরে বিকেলবেলাটা এখন আগের মতো উদ্দাম হয় না। অনেক ইচ্ছা আনইনস্টল করে ধাপুর ধুপুর সাইকেল, এক্কাদোক্কা করা যায় না। স্রেফ কলোনির গলি ধরে হাঁটাহাঁটি, সমবয়সী আর পিঠাপিঠি পাড়াতো বোন-বান্ধবীদের সঙ্গে। অনেক মেপে বুঝে চলার বিধিনিষেধ মাথায় চাপা। সংস্কার- পারিবারিক, ধর্মীয়।যখন মানুষ মানতে আর মানাতে শেখে তখন মরুতেও তার জন্য যেন ফুল ফুটে যায়। স্রষ্টা বা প্রকৃতি তার জীবনধারা অবারিত রাখার এই খেলা খেলেই যায়। হাঁটা বাবার মতো অবিরত কলোনির কক্ষপথে ঘোরাফেরার এক বিকেলেই ধুম করে যেন তারা খসে পড়ে যা দেখলে কোনো একটা ইচ্ছার কথা উচ্চারণ করতে হয়, যা পূর্ণ হয়ে যাবে।
কলোনির মসজিদের দিকে দ্রুত পা চালাচ্ছিলেন দিব্যকান্তি এক তরুণ। কি শান্ত সৌম্য দীর্ঘ কাঁচা হলুদ রং, একহারা দীর্ঘ গরণ। মোঘল সম্রাটদের ছবির মতন আঁকা নাক-চোখ, ভ্রু। যেন ইতিহাসের পাতা থেকে নেমে এসেছে। কে সে? রিনির পা আটকে গেল। চোখের পাতা নড়ে না, মুখে রা নেই। সে ভুলেই গেল সে একটা মেয়ে, এমন করে ছেলেরা দেখতে পারে, মেয়েরা না। মেয়েদের চোখ নামিয়ে চলতে হয়। সে ফ্যালফ্যালিয়ে দেখেই গেল। কি দেখিস, আরে?তুলির ধাক্কাতে সম্বিত ফেরে। জোর করে চোখ সরিয়ে, তুলির হাত টেনে ফিসফিস, যেন নিজেই না শুনতে পায় মতন করে জিজ্ঞেস করে- ইনি কে? তুলি প্রথমে ঠিকঠাক না ধরতে পেরে স্বভাবসুলভ উঁচুস্বরে গোঁতগোঁত করে ওঠে- কোনটা কে? কি কেলেঙ্কারি! লোকটা যদি শুনতে পায়! ছি, মাটিতে মিশে যেতে যেতে টেনে হাতখানেক দূরে সরে তুলির কনুই ধরে জোড়ে ঝাঁকুনি দিল- চিৎকার করছিস কেন আহাম্মক? আমি কি এক মাইল দূরে?
তুলির চোখেমুখে বিরক্তি ধরেই গলা নামালো। কার কথা বলছিস?রিনির দৃষ্টিপথ অনুসরণ করে তুলির বিরক্তি বিস্ময়ে রূপান্তর হয়। রিনির দিকে ফিরে কিছুক্ষণ রিনির চেহারা পড়ার চেষ্টা করে। তুলি মেলাতেই পারে না প্রশ্নের সাথে প্রশ্নকর্তাকে। জানা গেল। তরুণটি একজন সদ্য পাস করা ডাক্তার। ছোট এক ভাইও খুব মেধাবী। বাবা যথারীতি সরকারি কর্মকর্তা, যেহেতু এই কলোনিতেই আছেন। তবে শিগগিরই অবসরে যাবেন।
আর হ্যাঁ, নেহাল ভাই সত্যি রূপকথার পাতা থেকে নেমে আসার মতই একটা ছেলে, যেমন ছেলেকে বাবা-মা আঙুল তুলে দেখায়, পা ধোয়া পানি খেয়ে তার মতো হতে হয়। ঢাকা মেডিকেলে ক্লাস থাকুক না থাকুক কোন ওয়াক্তের নামাজ সে ধর্মীয় অনুশাসন মোতাবেক মসজিদ ছাড়া পড়ে না। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব জবাব দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়লো তুলি। কেন জানতে চাচ্ছিস এতকিছু? ভাগ্যিস তুলিটা একটু বোকা, না হলে এত সামান্য বিষয় কেন তার মতই বয়োসন্ধির একটা মেয়ে ধরতে পারবে না! না, এমনি। কোনদিন দেখিনি এমন কেউ মসজিদে আসরের নামাজ পড়তে যাচ্ছেন, তাই! সেদিনের কথার সেখানেই সমাপ্তি, কিন্তু কল্পনার সেখানেই শুরু।
Advertisement
অল্পবয়সের এই ভালো লাগা ঘোর কেটে যাওয়া সময়কাল মাত্র। কিন্তু রিনির কাটে না। সে মানুষটার সামনে দাঁড়াতে পারেনি ১২ বছরের ব্যাবধান আর আকাশসমান দ্বিধা অতিক্রম করে। মানুষটা চলার পথে কোনদিন তার দিকে সেভাবে তাকিয়েও দেখেনি যে সে তার চোখে লেখা নীল পড়তে পারতো। অব্যক্ত কথার এক বর্ষার আষাঢ়-শ্রাবণ যেন তার সারা জীবন বৃষ্টি হয়ে ভিজিয়ে দেবে শপথ নিল।
যেদিন তার বিয়ে ঠিক হলো, সে জানতে চাইলো না কার সাথে বিয়ে হচ্ছে, কেমন সে। তার মানুষ তার জীবনে আসেনি। অবেলার অদম্য ঝড়কে সে আলিঙ্গন করতে পারেনি, কি এসে যায়- কে আসলো আজকে আটপৌরে সময়ের নিয়মে।
এই মানুষটাও ডাক্তার। দেখতে সাধারণ মানের ভালো। মানুষও ভালোই। গৃহী কর্মযোগী মানুষ। স্টেরিও টাইপ। কোন রোমান্স নেই, শিল্প নেই, কোন চমক নেই, মুগ্ধ করে দেবার মত কিছুই নেই। সবচেয়ে হতাশাজনক, ধর্মচর্চা নেই। না, সে নাস্তিক নয়, অনেক বেশিই ঈমানের জোর, ঈশ্বরে আস্থাশীল। কিন্তু নিয়মিত ধর্মীয়চর্চা বা পাঞ্জেগানা ফরজ আদায়ে সে নাই। প্রত্যাশা ছিল না, অপ্রাপ্তির বেদনাও তাই নেই। বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল কি খোঁপার বেলী ফুল- কোনদিন কোন ফুলই নয়, কোন কিছুই স্ত্রীর জন্য সে আনে না, কেন সে কোন বিশেষ দিনও মনে রাখতে পারে না, এসব নিয়ে আর দশটা মেয়ের মত কোন অনুযোগও নেই রিনির। দুজনই পাশাপাশি বাস করে যায়। পাশাপাশি থাকার অভ্যাসের মায়া, অভ্যাসের আবেগ বিনিময়ে সময় নিজস্ব নিয়মে পার হয়ে যায়। দিনে দিনে সংসার জড়িয়ে যায়, ডালপালা ছাড়ানো মহীরূহ। সারাদিনের অবসরে কখনো মনের ভেতরে অপ্রাপ্তিটা উঁকি দেয় কি দেয় না- আয়োজন করে টের পাওয়া হয় না। শখের তানপুরা হাতে নিলে বারকয়েক মনে হয়, আচ্ছা নেহাল ভাই কি তাকে গান করতে দিত? ফুল হয়তো সেও আনতো না। দিন-দিবসও হয়তো মানতোই না, এতো ধার্মিক যেহেতু। কি জানি!
রিনি আজ রাতে ফিরতে পারবো না। রিনির এই একটা বিষয়ে দশ বছরেও অভ্যস্ততা হয়ে ওঠেনি। যত ব্যস্ততা হোক, ঘরের মানুষ ঘরে ফিরতে হবে। না হলে তার ঘুম হয় না। তার ঘুম এমনিই খুব সেনসেটিভ। কেন কেন কি আজকে?মিহির ঠান্ডা মাথার মানুষ। বাজখাই চিৎকারে, ‘আরে বোঝ না, তুমি কি বুঝবা আহাম্মক মেয়ে মানুষ’ বলে চুপ করিয়ে দেওয়া তার ধর্মে নাই। সে অল্পকথায় পরিস্থিতি বোঝানোর চেষ্টা করে, তা সেই মানুষ তার জগৎ সম্পর্কে যতই অজ্ঞ হোক। তুমি আজ খবর দেখোনি? আজকে ঢাকা মেডিকেলে ছাত্র সংগঠনের বার্ষিক সভাতে বোমা হামলা হয়েছে। আহত হয়েছেন বেশ ক’জন, দু’জন ঘটনাস্থলে মারা গেছেন। সেই দু’জনের একজনকে তুমি চেন। রিনির হার্টবিট বেড়ে যায়। সে আজ খবর দেখেনি। ছেলের স্কুলের ফাইনাল এক্সাম, ছেলেকে পড়ানো ছাড়াও সে নিজেও তাদের স্কুল টিচার, তার নিজের ক্লাসের প্রশ্ন তৈরিতে ব্যস্ত ছিল। কে তার চেনা মানুষ মারা গেছেন? আমি রাখছি রিনি, ইমার্জেন্সিতে ছুটতে হবে। সাবধানে থেকো।
মানুষটার নাম জানা হলো না। ছেলে তার ঘরে ঘুমিয়ে গেছে। নিজেদের শোবার ঘরের টিভি অল্প শব্দে ছেড়ে দেয়।সব ক’টা চ্যানেলেই দেখাচ্ছে, স্ক্রলে ফুটেজ যাচ্ছে, উফ কী বীভৎস! মানুষটা রকিব ভাই। মিহিরের কয়েক ব্যাচের সিনিয়র। নিওরো মেডিসিন। নিপাট ভালো মানুষ, সাদাসিধে, ধর্মপ্রাণ। ভাবির চেহারা ভেসে উঠলো, মেয়ে দুটোও। মফস্বলের সাধারণ মেয়ে, একদম ঘরোয়া গৃহিণী। কি করে সামলাবেন এখন এই সমাজে দুই মেয়ে নিয়ে? চোখের সামনে বীভৎসতার ডিটেইল দেখতে দেখতে নিউজ শুনে গেল। ইসলামিক স্টেট ইতোমধ্যে দায় স্বীকার করে নিয়েছে। স্বীকারোক্তি আদায়ের প্রশ্নই নেই। সবচেয়ে সহজতম স্বীকারোক্তি আজকাল এদের। নিজেদের উদ্যোগে, পারলে ঘটনা ঘটার আগেই। কে একজন ঝাড়ছিল একদিন যে, রাস্তায় বেওয়ারিশ কুকুর মারা গেলেও মনে হয় আজকাল তারা দায় নিতে চায়। হিটলারের গ্যাস চেম্বারে কতজন মারা গিয়েছিল তার তালিকা জগতে যত জেনোসাইট হয়েছে তার মধ্যে নির্ভুলতম, কারণ নাজী বাহিনী নিজেদের শৌর্য-বীর্যের প্রমাণ পেশ করতেই তা নথিবদ্ধ করেছিল। নিয়তির হিসেবে তারা পরাজিত হবার পর সেই নথি নষ্ট করতে সময় পায়নি, যা কালের সাক্ষী দিয়ে গেছে আজীবন। এরাও নিজেদের নথি সমৃদ্ধ করে চলছে। কি হবে কালের হিসেবেই দেখা যাবে।
রিনি টিভি বন্ধ করে ঘর-দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ে। রফিক ভাইয়ের বাসায় যেতে হবে সকালে ক্লাস সেরেই। এই শোকের কোন সান্ত্বনা নেই, তবুও যেতে হয়। কেন বিনা অপরাধে রকিব ভাইসহ আরো একজন মারা গেলেন, এতজন আহত হলেন কেউ জানে না, যারা মেরেছে তারাও হয়তো না। তারাও ধরা পড়লে কিছু না জানার, কিছু না বলতে পারার এবং সর্বোপরি মুক্ত হয়ে সমাজের জন্য খাঁচামুক্ত জ্যান্ত বাঘ হওয়ার আশঙ্কায় ক্রসফায়ারে যাবে। চাপাতি আর বোমার দুইপ্রান্তে সবাই খরচযোগ্য প্রাণ, সমাজের আর সিস্টেমের বলি।
এ কয়েকদিনের ধকলে ক্লান্ত বিধ্বস্ত মিহির। যতটা কাজের চাপের আর সহকর্মী হারানোর শোকে তা ছাপিয়েও এক বিশ্রী চাপ। সে প্রাপ্য এবং সম্ভাব্য সবকিছু নিয়ে এই ঘটনার তদন্তে জড়িয়ে গেছে। এটা সবারই নৈতিক দায়িত্ব, কিন্তু মিহির এই দায় এড়িয়ে যাবার মত মানুষ না। সে শুধু মেডিকেল রিপোর্ট না, সিসিটিভি ফুটেজ দেখে সেদিন কে কখন এসেছে, গেছে তাদের পরিচয় নিজের জানার বাইরেও অন্যদের কাছে জেনে দিয়েছে। নিজের সংগঠনের কে কবে কখন কার সাথে এমন কোন গ্রুপের সাথে কোন কনফ্লিক্টে জড়িয়েছে জানাচ্ছে।তিনজন জড়িত সন্দেহে ধরাও পড়েছে এই প্রক্রিয়ায়। সহজ সমীকরণেই সে টার্গেটে এখন। বাসার ফোন, মোবাইলে বিশ্রী হুমকি আসছে। যথারীতি থানায় জিডি করে কিছুই হয়নি। মিহিরের পরিবার, আত্মীয়, বন্ধু সবাই মিহিরকে পুলিশ নিরাপত্তাসহ এই তদন্ত থেকে সরে আসতে বলেই চলছে। কিসের কি? ঠান্ডা মানুষ এমন সময়ে যেন আরো দুর্বোধ্য আর গোয়ার হয়ে উঠেছে।রিনির সারাদিন বুক কাঁপে। মিহিরের কিছু হলে তাদের সংসারে কিছু আটকে থাকবে না, কিন্তু তাই বলে সে কি তার কোন সম্ভাব্য অমঙ্গলে শান্ত থাকতে পারে? সে তার স্বামী, তার সন্তানের বাবা।ঘটে যাওয়া শোক মানুষ নিতে পারে, অজানা আশঙ্কায় বাস করা যায় না। রিনির মনে হয় সারাক্ষণ যদি সে মিহিরকে চোখে চোখে রাখতে পারতো। এতো মায়া কখন জন্ম নিল সে টের পায়নি, কিন্তু আজ মনে হচ্ছে এই মানুষটার কিছু হলে সে থাকবে কি করে। অপ্রেমিক মানুষটার একটা একটা করে মায়া আজকাল তার নজরে আসছে। কি করে সে রিনির মত অবুঝকে আর গোটা সংসারকে আগলে রেখেছে, কতটা মায়া তার পেশার প্রতি, সেবার প্রতি সবকিছুই। এসব কি আর চলে যাবার পূর্বাভাস?
তুমি কয়দিন হাসপাতালে না যাও। ছুটি নিলে হয় না? তুমি তো ছুটি নাওই না, কত ছুটিই তো পাওনা আছে! ঝামেলাটা কেটে যাক। মরিয়া হয়ে রিনি চেপে ধরে।মিহির শান্ত স্মিত হাসে। বড় করুণ দেখায় সেই হাসি। এভাবে ছুটি কাটানোর পেশা তো এটা না রিনি। এটা জেনে-বুঝেই এ পেশায় আমি এসেছি, কেউ জোর তো করেনি। তুমিও জেনেই বিয়ে করেছ। হ্যাঁ, তো সেদিন তো আরো ডাক্তার ছিল, হাসপাতালের সবাই ছিল, রফিক ভাই আর সেই ওয়ার্ডবয়টা তো শুধু তোমার কলিগ ছিল না বা সংগঠনের তুমি কোন নেতাও না যে...মিহির মাঝপথে কথা থামিয়ে দেয়। আমি আমিই, তারা তারাই, তুমি তো এতদিনে এতটুকু জানো। আমার ঈশ্বর আমার পেশা, আমার দায়িত্ব, আমি তাকেই সেবা করি। কাউকে না কাউকে তো লিড নিতে হবে, জানাতে হবে। সবাই ভাববে অন্যরা করবে, এভাবেই শেষে কেউই করে না।রিনি অসহিষ্ণু হয়েও শুনে যায়। এসব কথার কোন জবাবও হয় না, কিন্তু নেয়াও যায় না। মিহির খুব ঘন হয়ে রিনিকে আঁকড়ে ধরে। কানে মুখ রেখে শান্ত, গাঢ় স্বরে আশ্বস্ত করে যায়, আমার কিছু হলে তোমাদের কিছু হবে না। আমি কোন দায়িত্বেই অবহেলা করি না। আমার সব গুছিয়ে আমার ড্রয়ারেই রাখা আছে, সব লিখে রাখা আছে, দেখে নিও। আফসোস একটাই, আমাকে ঘিরে তোমার কোন স্মৃতিই আমি জন্ম দিতে পারিনি, কোন স্মৃতি যা তোমার উদাস মনে ঢেউ তুলতে পারে, কাঁদাতে-হাসাতে পারে। এবারের ধাক্কাটা কেটে গেলে আমরা বেড়াতে যাব, সত্যিই ছুটি নেব, দেখো।
লখীন্দরের কালোরাত কি এতো দীর্ঘ, এতো উদ্বিগ্ন ছিল। বেহুলা কি তার লখীন্দরকে ধরে এভাবে লোহার বাসর আগলে ছিল? তা-ও তো সুতানলি সাপের দংশন থকে বাঁচাতে পারেনি। রিনি কি দিয়ে তার লখীন্দরকে আঁকড়ে রাখে এই চরম অনিশ্চয়তার দেশে!
ছুটির দিন আজ, জুম্মাবার। আজ নিশ্চয়ই কোন অঘটন ঘটবে না। তবুও রিনির বুক কাঁপে কেন? মিহির জুম্মাটা নিয়ম করে পড়ে। কিন্তু আজ এতো দেরি হচ্ছে কেন? ছেলেটার জ্বর বলে আজ বাবার সাথে যেতে পারেনি। দাদির সাথে বসে সিরিয়াল দেখছে। রিনি ভাত বেড়ে মোবাইলে হাত দেয়। ফোন করা দরকার।
একটা টেক্সট। মিহিরের। ঘণ্টাখানেক আগের। জরুরি কল এসেছে, হাসপাতালে যাচ্ছি। তুমি খেয়ে নিও। সরি। বাবুকে বলো আমি ফিরে যত রাতই হোক ওর গেমের সিডি কিনতে নিয়ে যাব। এ প্রমিজ ইজ এ প্রমিজ।
আবার কিসের জরুরি কল এমন অসময়ে? আবার রিনির বুক দুর দুর। আবোল-তাবোল ভাবতে ভাবতে কখন মিহিরের ড্রয়ারের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল নেই। ডায়েরিটাও ঘোরের মধ্যেই হাতে টেনে নিল।
প্রথম পাতায় একটা চিঠি। তাকেই লেখা! কেন?প্রিয় রিনি, আমার মতো সাদাকালো মানুষ কারো জীবন রঙিন করতে পারে না, তোমারটাও পারিনি। গুছিয়ে প্রেমের কথা আমাকে দিয়ে হবে না, হলোও না। তবু তুমি হয়তো টের পাও না, তোমার সবকিছুই আমি অনেক বেশিই ভালোবাসি, তোমার ভালো-মন্দ সব ঘিরেই আমার ভালোবাসা। কোন মন্দবাসা নেই। তোমাকে দেখার আগেও তোমার ছবি যেদিন দেখেছি, সেদিনই মনে হয়েছে শুধু আমার জন্যই এই মেয়েটা জন্ম নিয়েছিল। কি স্পর্ধার কথা, অধিকারবোধের কথা, না? বিয়েতে তুমি রাজি না হলে কি হতো! তোমার রাগ হচ্ছে, জানি। কোনদিন বলা হবে না, আমার খুব প্রিয় একটা কবিতার লাইন, তোমার জন্য-‘কি এসে যায়... হও না তুমি হৃদয়হীনা... আমার প্রেম দুই হৃদয়ের সমান বড় লাস্যহীনে যতই আমায় মাতাল কর... শুধাবো না... সত্যি ভালোবাসো কিনা?’
বাজখাই শব্দে টেলিফোন বাজছে। রিনির মন আটকে আছে ডায়েরিতে। উফ! ফোনটা কেউ ধরছে না কেন? কেটে গেল। আবারো বাজছে। কেন মানুষ বোঝে না ফোন ধরছে না মানে সবাই ব্যস্ত অথবা এই মুহূর্তে এই কলটা কাঙ্ক্ষিত না। হ্যালো...বিক্ষিপ্ত কণ্ঠে রিনি শেষ মুহূর্তে ফোনটা ধরলো। ভাবি, আমি হাসপাতাল থেকে। মিহির স্যারের একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, আপনি প্লিজ সঙ্গে স্যারের বাবা আর যারা আছেন কাউকে নিয়ে আসুন। রিনি কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলো না। কি অ্যাক্সিডেন্ট? সাথে কাউকে আনতে হবে কেন?ভাবি, প্লিজ দ্রুত আসুন, ইনজুুরিটা সিভিয়ার। প্লিজ... ওকে কি অ্যাটাক করেছিল? ও কি... ও কি বেঁচে আছে? মুখ ফসকেই যেন কথাটা বের হয়ে গেল। কি করে সে এই কথা উচ্চারণ করতে পারলো, জানে না।
বোধশূন্যের মতো কখন ইমার্জেন্সির গেটে চলে এলো, পথের সময়টা একদম মনে নেই তার। সহকর্মী, পত্রিকাওয়ালা, পুলিশসহ আরো অনেকের কি জটলা। একজন মুখের সামনে মাইক্রোফোনের মতো কিছু একটা এগিয়ে আনলো- এক্সকিউজ মি ম্যাম, আপনি কি প্রয়াত ডাক্তার মিহিরের স্ত্রী? মিহিরের বাবা আর্তনাদ করে পেছনে পড়ে গেলেন সম্ভবত। কেউ তাকে ধরলো কি না জানে না, রিনির মাথা ঘুরে পড়তে পড়তে কেউ তাকে সামলালো। সাংবাদিকদের বকাঝকা করে সরিয়ে তাদের স্ট্র্রেচারের সামনে দাঁড় করালো।
নিথর দেহটা পড়ে আছে।গলা অবধি চাদরে ঢাকা। নিচে ঘাড়ের ব্যান্ডেজটা উঁকি না দিলে কি নিশ্চিন্ত ঘুমে আচ্ছন্ন এক অমলিন চেহারা! ক্লিন সেভ, সবুজ পাঞ্জাবি। চুলটা কেন এলোমেলো হলো না! কোন ধস্তাধস্তি হয়নি?ছুটির দিন, তাও হাসপাতালে তো এতো লোক, এর মাঝেও কি করে যে টার্গেট করলো। আঘাতটা ওর রুমেই হয়েছে, সিসি টিভি বন্ধ ছিল। মিহির কিছুই বোধহয় টের পায়নি আঘাতের আগ মুহূর্তেও। ওকে কে কল দিয়ে এনেছে তা-ও বোঝা গেল না। হাসপাতালের ভেতরের কেউই হয়তো হবে। তবে একজন সিনিয়র ডাক্তারের নাম এসেছে, তিনি বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। স্ত্রী-কন্যারা পালাতে পারেনি। থানায় কাস্টডিতে নেওয়া হচ্ছে। এর নাম মিহিরই বের করে ফেলেছিল। সঙ্গে আরো স্যাংগাত থাকবেই, তাই তো স্বাভাবিক, এতো দিন সেই ডাক্তার এখানে আছেন।
রিনির কান্না পাচ্ছে না কেন? এতো অবসন্ন আর দুর্বল লাগছে কেন? আশঙ্কা যা ছিলো ঘটেই গেছে, তাই?ডাক্তার কে? আমি চিনি?মিহিরের হাত শক্ত করে ধরে প্রাণহীন ধাতব কণ্ঠে প্রশ্ন করল। কাকে প্রশ্ন করছে কি করছে তা রিনির মাথায় আসছে না।ভাবি আপনি চেনেন কি না... মেডিসিনের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর... ডা. নেহাল বিন কাসেম। ওই যে টিভি ফুটেজে ছবি দেখাচ্ছে। রিনি ঘাড় তুলে তাকালো।প্রায় বিশ বছর, হ্যাঁ, তা হবে। কিছুটা বুড়িয়ে গেছেন, কাঁচা-পাকা চুল, অবিন্যাস্ত জঙ্গুলে দাঁড়ি। বয়স কত এখন? ৪৫ হবে? মিহির ৪০ এ অনেক তরুণ ছিল সেই তুলনায়। তবুও সেই চেহারা কি ভোলা যায়? নেহাল ভাই!তার স্বপ্নের রাজকুমার। স্বপ্নে তার কত রাত ছিল আনাগোনা, কতগুলো বছর! আদর্শ মহাপুরুষ। কলোনির সব বাবা-মা যাকে আঙুল তুলে দেখাতো। বিদ্যান ধার্মিক চরিত্রবান তরুণ।
তার স্বামীর ধর্ম ছিল মানব ধর্ম। কে কার ধর্মকে আজ হারিয়ে দিলো? আজো কি তার মনে নেহাল ভাই ছিল? নাকি অনেক আগেই সেই স্থান মিহির দখল নিয়েছিল?বউটাকে দেখাচ্ছে, বাচ্চা দুটো মেয়ে, বোরখায় ঢাকা। বউও কি তাকে আদর্শ মানে? হয়তো!ভাই, একবারের জন্য কি আমি ওকে শেষ কথা বলার সুযোগ পাব? এই ভদ্রলোক যে কে রিনির মাথায় কাজ করছে না। চেনে নিশ্চয়ই। অবাক হয়ে তিনি তাকিয়ে আছেন। ভাবি, মিহির তো আর নেই!জাস্ট একবার, আমি বেশি সময় নেব না। আমি জানি, ও অনেক ব্যস্ত, ওর সময় নেই, ও আমাদের নিয়ে বেড়াতে যাবে এবার বলেছিল, আজ ফিরেও ছেলেকে সিডির দোকানে নিয়ে যাবে প্রমিজ করেছিল, এই যে এই- দেখেন মোবাইলে...ভাবি, প্লিজ একটু শক্ত হোন। না না দেখেন না, আমি ঠিক আছি তো! ও লিখেছিল, এই যে মেসেজটা পড়েন। ও কোনদিন মিথ্যা বলেনি, মিথ্যা প্রমিজ ও করতেই পারে না, বিশ্বাস করেন।
সবাই রিনিকে সরিয়ে নিলো। রিনি বলতে চাইলো সে প্রলাপ বকছে না, বার বার সে একটা মুহূর্ত চেয়েই গেল। শুধু একবার এক সেকেন্ডের জন্য মিহির ফিরে আসুক। সে কানে কানে বলবে, ‘ভালোবাসি। ভালোবাসি, ভালোবাসি।’ ব্যস, আর সব দাবি ছেড়ে দেবে।কেন তার শেষ কথা কেউ তাকে বলতে দিচ্ছে না?উফ! এতো মানুষ, এতো কথা, শুধু তার কানে কেন বেজে যাচ্ছে মিহিরের না বলা কথা, শুধু ডায়েরির পাতাতেই যা লেখা ছিল। রিনি দু’হাতে সজোরে কান চেপে চিৎকার করে প্রণতি জানাচ্ছে সবাইকে, ‘এক সেকেন্ড... শুধু একবার...’
মিহির যদি মরেই গিয়ে থাকবে, তবে সব ছাপিয়ে কেন কেবল মিহির বলেই যাচ্ছে, ‘শুধাবো না, সত্যি ভালোবাসো কিনা?’
এসইউ/জেআইএম