বারাক ওবামার সরকারকে অনেকেই বিশেষ করে বাংলাদেশের অনেকেই মনে করেন শান্তিপ্রিয় ও ইতিবাচক একটি সরকার। অথচ ওবামা সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রী থাকাকালে হিলারী ক্লিনটন সিরিয়ায় আসাদ-বিরোধী বিদ্রোহীদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছিলেন এবং কথিত আছে যে, তথাকথিত ইসলামিক স্টেইট বা আইএস আসলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরই সৃষ্টি। বিশ্বকে এক অস্থির অবস্থার মধ্যে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল আইসিস।
Advertisement
প্রতিদিন টেলিভিশনের পর্দায় শিরশ্ছেদ আর নারী নিগ্রহের দৃশ্য প্রত্যক্ষ করার পরও অনেক শান্তিপ্রিয় বিশ্লেষক, নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক হিলারী ক্লিনটনের পক্ষে সাফাই গেয়েছিলেন, ডোনাল্ড ট্র্রাম্প যাতে বিজয়ী হতে না পারেন সে জন্য মার্কিন মিডিয়ার সঙ্গে যোগসাজশ করতেও দ্বিধা করেননি। অথচ আল-ক্বায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা, লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে হত্যাসহ যে নগ্নতা সরাসরি বিশ্বময় প্রচারিত হয়েছে তারপরও কী করে কোনো সুস্থ বিবেক ওবামা প্রশাসন ও হিলারি ক্লিনটনকে ‘শান্তিপ্রিয়’ বলে সার্টিফিকেট দেন, সে প্রশ্ন তোলাই যায়। সবচেয়ে বড় কথা হলো মধ্যপ্রাচ্যে আইসিস নামের নতুন দানবের উত্থানে যে ওবামা প্রশাসনের শক্তিশালী সমর্থন ও সহযোগিতা ছিল সেটাও এখন আর গোপন কোনো বিষয় নয়। এমতাবস্থায় ট্রাম্প প্রশাসন ক্ষমতায় বসার এক বছর পূরণ হওয়ার আগেই যখন আসাদ-বিরোধীদের অস্ত্র ও অর্থ সমর্থন দেওয়া বন্ধ করার নির্দেশ দেন মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-কে তখন ট্রাম্প প্রশাসনকে অন্ততঃ শুকনো একটি ধন্যবাদতো জানাতেই হয়, নাকি?
অপরদিকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন মনে হচ্ছে আমাদের জীবিতকালে পৃথিবীর জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসা এক যুগপুরুষ, যার হাত দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য এক নতুন গতি লাভ করতে যাচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে। হ্যাঁ অনেকেই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী শাসক বলে গালমন্দ করবেন। দেশের অভ্যন্তরে জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নেওয়ার গল্পও শোনা যায় তার বিরুদ্ধে। যদিও রাশিয়ায় গণতান্ত্রিক বাস্তবতা পৃথিবীর অন্য অনেক দেশের তুলনায় সম্পূর্ণই ভিন্ন। কিন্তু তাই বলে পুতিনের যে সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপের কারণে মধ্যপ্রাচ্যে আইসিস নামক দানবের উত্থানকে রুখতে পেরেছে সে জন্য পৃথিবী কি পুতিনের কাছে সামান্য কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করবে না? সোভিয়েত রাশিয়ার কাছে বাংলাদেশের মতো অনেক দেশই কৃতজ্ঞ কারণ সাম্রাজ্যবাদ আর দখলদারিত্বের হাত থেকে এসব দেশগুলিকে কেবল মুক্ত করাই নয় বরং যুদ্ধোত্তর এসব দেশ পুনর্গঠনে সোভিয়েত ইউনিয়ন যদি দরাজ হাতে সাহায্য না করতো তাহলে দেশগুলি শুরুতেই মুখ থুবড়ে পড়তো।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেছে, এমনকি সোভিয়েত কম্যুনিস্ট দর্শনও আজকে কম্যুনিস্টরাই বর্জন করেছে দেশে দেশে। তাদের কাছে এই মুহূর্তে চীনা কম্যুনিস্ট (আসলে ওয়ান পার্টি সিস্টেম বা টোটালিটারিয়ান পদ্ধতি) কায়দাটি সবচেয়ে আরাধ্য পথ। মানুষ যে মূলতঃ লোভ আর ক্ষমতার বশবর্তী এক ভয়ঙ্কর প্রাণি তা আবারও প্রমাণিত হয়েছে সোভিয়েত কম্যুনিজমের পতন আর চীনা কম্যুনিজমের শনৈঃ শনৈঃ অগ্রগতির মধ্য দিয়ে। কিন্তু কথা সেটি নয়, ধরা যাক মধ্যপ্রাচ্যে আইসিস-কে ঠেকাতে রাশিয়া কোনো পক্ষ নেয়নি, তাহলে কী হতো? লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, যতোদিন না রাশিয়া আইসিস-এর বিরুদ্ধে সম্মিলিত যুদ্ধে যোগ দেয়নি ততোদিন পর্যন্ত আইসিস দ্বারা বিতাড়িত হয়ে লক্ষ লক্ষ সিরিয় নাগরিক ইউরোপের দিকে ছুটে গেছে নিরাপদ আশ্রয়ের আশায়। মূলতঃ এই বিশাল শরণার্থীদের ভয়েই ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেন বেরিয়ে যায় রীতিমতো গণভোট-এর আয়োজন করে। যদিও এটাই একমাত্র কারণ নয় ব্রিটেনের ইউনিয়ন ত্যাগ করার, কিন্তু গণভোটে ইউনিয়ন ত্যাগের পক্ষে প্রচারণাকারীরা বার বার একথাটিই সাধারণ ভোটারদের বোঝাতে চেয়েছে যে, ইউরোপে আগত লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর বোঝা ইংল্যান্ডকেও বহন করতে হবে তাই আগেই ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়াই হবে মঙ্গলের।
Advertisement
কিন্তু রাশিয়ার যুদ্ধ বিমান যখন আইসিস যোদ্ধাদের একের পর এক ঘাঁটি উড়িয়ে দিচ্ছিলো তখনও পর্যন্ত মার্কিন ও পশ্চিমা প্রচার মাধ্যম এই প্রচারণা চালিয়েছে যে, রাশিয়ার যুদ্ধ বিমান থেকে সাধারণ নাগরিকের ওপর গোলা বর্ষণ করা হচ্ছে। এমনকি রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগের খবরও প্রচারিত হয়েছে। যদিও মানুষ সেটি বিশ্বাস করেনি। ইরাক আক্রমণ এবং তার পরবর্তীতে মধ্যপ্রাচ্যে ঘটে যাওয়া যুদ্ধগুলির প্রচার-প্রচারণার কারণে পশ্চিমা গণমাধ্যম সাধারণ জনগণের আস্থা সম্পূর্ণই হারিয়েছে। এখন পশ্চিমেও গণমাধ্যমের ওপর সম্পূর্ণ আস্থাশীল মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এমনকি রুশ বিমান আক্রমণে আইসিস ঘাঁটি বিধ্বস্ত হওয়ার অনেক খবরও পশ্চিমা গণমাধ্যম আড়াল করে গেছে। এদিক দিয়ে আল-জাজিরা অনেকটাই এগিয়ে ছিল এবং আছেও।
সর্বশেষ ইরাকের মসুল শহর মুক্ত হওয়ার পর থেকে বিশ্ব এখন নতুন প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছে, প্রশ্নটি হলো, আইসিস নামক দানবের হাত থেকেতো পৃথিবীকে মোটামুটি মুক্ত করা গেলো? এরপর কী হবে? বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের? এসব প্রশ্নের উত্তর এখন নানা ভাবে নানা যুক্তি দিয়ে দিতে শুরু করেছেন মাত্র। তাই সেসব আলোচনায় যাচ্ছিনে। আমরা বরং আইসিস-উত্তর বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলি। আমরা সকলেই জানি যে, বাংলাদেশ থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক তরুণ, তরুণী, মধ্যবয়স্ক পরিবার আইসিস-এ যোগ দিতে মধ্যপ্রাচ্য তথা সিরিয়ায় গিয়েছে। সিরিয়া থেকে ফিরে এসে এদেশে নাশকতা ঘটিয়েছে সেরকম প্রমাণের খবরও আমরা জানি। অপরদিকে আল-ক্বায়েদা ও আইসিস তাদের কার্যক্রম ভারতীয় উপমহাদেশে বিস্তৃত করেছে বলে তারা নিজেরাই আমাদেরকে জানিয়েছে।
প্রশ্ন হলো, মধ্যপ্রাচ্যে না হয় রুশ ও মার্কিন সম্মিলিত প্রতিরোধের মুখে আইসিস ও আল-ক্বায়েদা নামক দানব দমন করা গেছে, ভারত উপমহাদেশ তথা বাংলাদেশে এই দানবের বংশধরদের দমন করা যাবে কী ভাবে? আমরা এও জানি যে, বাংলাদেশে এদেরকে সঙ্গে নিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখা রাজনৈতিক শক্তি রয়েছে। যারা মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালি জাতীয়তাবাদকে ইসলামের বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে দিয়ে রাজনৈতিক ভাবে ইসলামকে ব্যবহার করে এবং জনগণকে উত্তেজিত করতেও তাদের জুড়ি নেই। হয়তো মধ্যপ্রাচ্য থেকে এই বাংলাদেশী আইসিস-গোষ্ঠী কোনো ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা পাবে না (অবশ্য সেটাও নিশ্চিত করে বলা যাবে না) কিন্তু এদেশে তাদেরকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য-সহযোগিতা দেওয়ার মতো রাজনৈতিক দল রয়েছে, রয়েছে সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত একটি রাষ্ট্রও, যারা ভারত উপমহাদেশে বার বার নৃশংস আক্রমণ ঘটাতে সাহায্য করেছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়।
বাংলাদেশে একটি জাতীয় নির্বাচন আসন্ন। রাজনীতিতে চলছে নানাবিধ সমীকরণ। এমনকি সরকারের ভেতরেও বিশেষ করে প্রশাসন, বিভিন্ন বাহিনীতেও দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে রয়েছে বহুবিধ উৎকণ্ঠা। ঠিক এরকম একটি সময়ে সন্দেহাতীত ভাবেই মধ্যপ্রাচ্য-ফেরৎ ও পলাতক আইসিস ও আল-ক্বায়েদা গোষ্ঠী বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার নতুন সুযোগ খুঁজবে এবং যে কোনো সুযোগে এই শ্বাপদ ছোবল হানবে, তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। এবং সে কারণেই বাংলাদেশকে অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় এই ধর্ম-দানবের হাত থেকে মুক্ত রাখার প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশি। কারণ, বাংলাদেশকে আফগানিস্তান বা মধ্যপ্রাচ্য বানানোর স্বপ্ন তাদের বহু পুরোনো। এখনও নিশ্চিত ভাবে জানা যায়নি যে কতো সংখ্যক বাংলাদেশী সিরিয়ায় গিয়ে আইসিস-এ যোগ দিয়েছে। ফলে একটি অজ্ঞাত সংখ্যা নিয়েই আমাদের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তাদের দমনের পরিকল্পনা করতে হবে।
Advertisement
আর গোটা বিশ্বের কী হবে? এখনও অবশ্য নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না যে, আইসিস সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন হয়েছে। আইসিস নেতা বাগদাদী নিহত হয়েছে, তাদের নতুন নেতা নিয়োগ হয়েছে, গণমাধ্যম আমাদের সেকথা জানিয়েছে। সিরিয়ায় বিদ্রোহীরা আসাদ সরকারের সঙ্গে আপোস করতে চাইছে। কিন্তু এতো কিছুর পরও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মধ্যপ্রাচ্যের ইরাক-সিরিয়া সংশ্লিষ্ট এলাকা সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত এবং অর্থনৈতিক ভাবে বিপর্যস্ত। ইয়েমেন ধ্বংসপ্রায়। কাতারকে নিয়ে নতুন রাজনীতি চলছে সেখানে। আর খোদ সৌদি আরবেই চলছে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র। ফলে উগ্র ধর্মীয় আগ্রাসনবাদে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো শক্তি ক্রমশঃ কমে আসছে এবং একথা বলাই বাহুল্য যে, অর্থনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে ধর্মীয় উগ্রবাদ কখনও টিকে থাকতে পারে না, টেকেও না।
অতীত পর্যালোচনায় জানা যায় যে, কেবলমাত্র তখনই বৈশ্বিক মৌলবাদ আগ্রাসী হয়েছে যখন কোনো শক্তিধর রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রসমূহ তার পৃষ্ঠপোষকতা করেছে, একথা কেবল ইসলামের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, খ্রিস্টান কিংবা অন্য যে কোনো ধর্মের ক্ষেত্রেই সত্য। যেমনটি মোদি’র ভারতেও দেখা যাচ্ছে। আশার কথা হলো, সৌদি আরবের মতো ধর্মান্ধ রাষ্ট্রের অর্থশক্তি ক্রমশঃ ম্রিয়মান এবং সে কারণেই যে, আইসিস-এরও পতন হচ্ছে সেকথাও বিশ্লেষকগণ বলতে শুরু করেছেন। দেখা যাক, সৌদি আরবও কতোটা শক্তিহীন হয় আর তার সঙ্গে বৈশ্বিক ধর্মীয় উগ্রবাদের চেহারাটাও কতোটা ম্রিয়মান হয়- যা কিছুই হোক আইসিস-এর পতনোন্মুখ চেহারাটি বিশ্বের অবয়বে একটু হলেও শান্তির প্রলেপ দিতে শুরু করেছে।
ঢাকা, ২৫ জুলাই, মঙ্গলবার ২০১৭লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।masuda.bhatti@gmail.com
এইচআর/পিআর