মতামত

কার বিচ্ছেদ, কার ভাবনা!

দেশের অন্যতম জনপ্রিয় দম্পতি বিচ্ছেদের মাধ্যমে একক ব্যক্তিজীবনে ফিরে গেলেন। যাদের বিয়েতে আম জনতা ঘ্টকালী করে দেননি, ভাঙ্গানিতেও তারা সুখের ঘরে দুঃখের আগুন দেননি, কিন্তু উল্লাসের সীমা অশিষ্ট এই জাতীর অসুন্দর চেহারার আরেক পরত অন্ধকার উন্মোচন করছে।  কার্যকারণ উদঘাটনের আদি- জৈব রসায়নেই থেমে নেই, অভিনেত্রী মিথিলার এমব্লেম (প্রতীক ছবি দিয়ে অ্যাপস) বানিয়ে ডিভোর্সের কার্যকারণ হিসেবে নিজেকে দেখিয়ে লোকে প্রোফাইল ছবি দিচ্ছে।  এমনকি “ ডিভোর্স মানিনা “ ইভেন্ট খোলা হচ্ছে!  এই অধিকার আমাদের কি করে হলো? 

Advertisement

আমরা কি ব্যক্তিগত ইস্যু নিয়ে নাক গলানোর রেকর্ড রেসে আছি?  বিয়ের আগে কি “বিয়ে হতেই হবে” জাতীয় ইভেন্ট কি হয়েছিল?  অথচ সদ্য এই ফেসবুকেই জঙ্গিবাদবিরোধী প্রচারণা নিয়ে একটি বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশগ্রহণকারী একটি দল!  তবু সমাজবদ্ধ , পরিবারবদ্ধ আমাদের দেশে বিয়েটা যেমন সামাজিক, সুসভ্য; বিচ্ছেদটা কিন্ত সেই মাত্রার অসামাজিক অসভ্যভাবে প্রদর্শিত।  বলবেন তারকাদের ডিভোর্স হয় বেশি। কেন হয়, কার্যকারণ চুলচেরা আবারো বিশ্লেষণ করবেন। আমি তো দেখি এখন ডিভোর্স ঘরে ঘরেই অনেক বেশি। এর ভালও আছে, মন্দও আছে। 

বিচ্ছেদ প্রসঙ্গে তাই অভিনেতা তাহসানের যে উক্তিটি খুব ভাল লেগেছে তা হলো , “ সমাজ কী বলবে—এই ভয়ে অভিনয় করে সারা জীবন কাটিয়ে দিতে হবে, আমরা দুজন এ ব্যাপারে একমত নই।” “সমাজ কি বলবে!” এ যে কত বড় সোশ্যাল ট্যাবু- তা আমাদের পরিবারেই দেখেছিলাম, দেখছি। একজন যখন স্বামীর অত্যাচারে ২ যুগ কাটিয়ে অতিষ্ট হয়ে নিজের পরিবারের ফিরে আসতে চাইছেন তখন তার অন্য ভাই বোনেরা আতঁকে উঠছেন এই বলে যে তারা তাদের শ্বশুরবাড়িতে মুখ দেখাবেন কি করে‼ What  a mockery‼ “মুখ দেখানোর” ভয়ে আমার সেই আত্মিয়া আজীবন আলাদা আছেন, নিজে একা যুদ্ধ করে নিজেকে এবং ছেলে মেয়েকে মানুষ করেছেন- কিন্তু বিচ্ছেদ করে আইনি অধিকার আদায়ে যেতে পারেননি। সারাজীবন এই ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত থেকেছেন।

আরেক ঝাণ্ডা- সন্তানেরা। অসুস্থ সম্পর্কের ভেতরে অসুস্থ সন্তান আর পরিবারের চেয়ে বিচ্ছিন্ন একক অভিভাবক  বা নতুন সুস্থ সম্পর্ক অবশ্যই ভাল। ভগ্ন পরিবারের শিশুর পরিণতি কেমন হয় জানতে চাইলে প্রশ্ন থাকবে ঐশী কি কোন ভগ্ন পরিবারের সন্তান ছিল, না আজকের জঙ্গিবাদে জড়িয়ে যাওয়া একটা ছেলেও ছিল?   দমিয়ে রাখা বাসনা ইচ্ছা থেকে দেশে আরো উন্মুক্ত সম্পর্ক হচ্ছে। তাই অন্যদিকে ধর্ম নিয়ে ব্যবসা আর ধর্মীয় লেবাসে আচ্ছাদনও বাড়ছে। এর কার্যকারণ না ভেবে মোটা বুদ্ধির পরিচয় দিয়ে বস্তাপচা গড়পড়তা সমালোচনা করা হচ্ছে। একটু প্রাপ্তমনস্ক হোন। ফোর্স আসলেই এন্টি ফোর্স আসে।  আগে মোটা দাগে দেগে আপনি আস্তিক কি নাস্তিক কেউ এই প্রশ্নের সামনে দাঁড় করাতোনা ; উদাহরণস্বরূপ যেমন ৩৩ বছর বয়সে আশৈশব ধার্মিক আমাকে করা হয়েছে ভিনদেশে, যেই দ্বিধায় দাঁড়িয়ে আমিও নিজেকে ধর্মীয়ে লেবাসে আচ্ছাদিত করেছি। বিশ্বায়ন বেড়েছে, উন্মুক্ত বিশ্বের সবকিছু ফাঁক ফোকড় দিয়ে যখন ঢুকবে তখন অনুন্নত এক দেশে এর অপব্যবহার হবে- বলাই বাহুল্য। 

Advertisement

যে খাবার গ্রহণে আপনার শরীর এখনো প্রস্তুত না, সেই খাবার শরীর রিজেক্ট করবেই, যদিনা আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুব উঁচু লেভেলের হয়।  অত্যন্ত দুঃখজনক যে আমাদের দেশে তারকা / সেলেব্রেটি বলতে আসলে কেউ নাই। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ ১ নম্বর নায়ক সাকিব খানের ৯ বছরের দাম্পত্যজীবন কাক-পক্ষিও টের না পাওয়া !!! তাঁরা আমাদের কোন আগ্রহের বিষয়ই  না, স্রেফ ট্রলের অবজেক্ট।  তাই এগুলি বাইরে এলে আলোচনায় স্রেফ অশ্রদ্ধার ভাগার উপচে পড়ে।  অথচ পাশের দেশে তারকা ঋত্তিক রোশন বা হলিউডের অ্যাঞ্জেলিনা - ব্র্যাড পিটের তুমুল আলোচিত বিবাহ বিচ্ছেদে আমাদের কষ্ট পাওয়া , বেদনা আর্তি ছিল খুবই জেনুইন।  তাদের আলাদা থাকার সিদ্ধান্তের পরদিন থেকেই গোটা বিশ্ব জেনে যায়, আইনী বিচ্ছেদ তো বহু পরের পক্রিয়া। 

আমাদের দেশে কারো প্রতি কারো শ্রদ্ধার বিষয়টাই নেই বলে তারকারা এর সবচেয়ে নগ্ন রূপটা দেখেন।  বলার আছে মিথিলার কথায় যে , “একটা ইস্যু নিয়ে তো এতো বড় সিদ্ধান্ত হয় না।”  হ্যা, হাস্যকর যুক্তিতে ডিভোর্স উন্নত বিশ্বে চালু হলেও আমাদের মতন দেশে এখনো সর্বোচ্চ চেষ্টাই করেন সবাই।  তাই বিচ্ছেদের হার বাড়াকে আমি বলতে চাই মানুষ কোয়ালিটি জীবনে আগ্রহী হচ্ছে। সাহসী হচ্ছে নিজেকে ভালোবাসতে, একটাই জীবন- সেটাতে ভালো থাকার কথা ভাবতে। আর প্রেমের বিয়েরও এই পরিণতি নিয়ে যখন কেউ জিজ্ঞেস করে, তখন জানাই, বিয়ে হলো জীবনের সবচেয়ে বড় স্ট্রাটেজিক এডজাস্টমেন্ট। প্রেম করতে শুধু রোম্যান্টিক হলেই চলে, বিয়ে হলো সফ্টওয়ার এগ্রিমেন্টের ৫ পাতা ব্যাপী প্রশ্ন উত্তর বক্সে টিক দেবার মত। যখন বিয়ের মন্ত্র পড়ানো হয়- তখন সবাই চোখ বন্ধ করেই সব টিক মেরে সিগনেচার করে দেন। 

যাপিত জীবন শুরু হলে একটা একটা বক্স সামনে এসে দাঁড়ায়। মানুষ তখন ট্রেড করে। এই সম্পর্কে থেকে কি লাভ , না থাকলে কি ক্ষতি। সন্তান হয়ে গেলে আরো জটিল হিসাব। হিসাবের পাল্লা যেদিক ভারী সেদিক ঝুঁকে যায়। অপশন যাদের বেশি থাকে, তাদের সিদ্ধান্ত নেয়াটা সহজ হয় বলেই তারকা বা অবস্থাপন্নদের এই সিদ্ধান্ত দ্রূত হয়। আর একেবারে নিম্নবিত্ত অবস্থাহীনদের কেউ এই এগ্রিমেন্ট চোখেও দেখেনা- মানা মানির বালাইও নেই।  তবু চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের আগে সবাই স্বাভাবিক নিয়মেই পারিবারিক বা প্রফেশনাল পরামর্শে যান। তাই, ঘটে যাবার পর আমার আপনার  “আহা, এইটা কেন করলো, ঐটা কেন করলো না!” খুবই-খুবই অপ্রাপ্তমনস্কতা।

লন্ডনের এক নামকরা হাসপাতালে চাকুরিরতা ভারতীয় তরুণী ডাক্তার রোজ রাতে কোটিপতি মাতাল স্বামীর মার খেয়েও ঘর করেন কারণ তার নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে এমন বিলাসী আরামের জীবন কোনদিন স্বপ্নেও দেখেনি। এটাই ট্রেড। সংসারে ঠোকাঠুকি লেগে আর্তনাদ যখন শ্রুতিসীমা লংঘন করে তখন মানুষ ভাবতে বসে। কিন্তু তখন মধ্যবয়সে আবার সেই ৫ পাতা ব্যাপী ট্রেড নতুন করে কারো সাথে করার এনার্জি আদৌ আছে কিনা সেই প্রশ্নতেই সবাই দমে যায়। পুরান মানুষটার ভাল-মন্দের সাথে সে খাপ খাইয়ে গেছে। নতুন কারোটা জানার, মানার এখন এই বয়সে এনার্জি কই? তেল জলের ঝাকাঝাকি মাঝবয়সে কি হয়?  তবুও যারা সাহস করেন, অবশ্যই আগের অভিজ্ঞতা মাথায় রেখেই এক্সপেকটেশনের মাত্রা কমিয়ে রেখেই এগোন।  

Advertisement

পার্সোনাল স্পেস প্রতিটা মানুষের অধিকার। সেই স্পেসটার প্রতি শ্রদ্ধা শুধু স্বামী স্ত্রীর নিজেদের ভেতর না- অন্য সবার প্রতিই থাকা উচিত। নাহলে সম্পর্কে শ্বাস নেবার জায়গা থাকেনা, দমবন্ধ হয়ে মরে যায়।  বিনা সম্মতিতে বা হুমকির মুখে স্বামী-স্ত্রীর একে অন্যের মোবাইল চেক, ফেসবুক/ ইমেইল এক্সেস নিজের হীনম্মন্যতাই প্রকাশ করে, কারণ এ করে কেউ বহুগামিতা ঠেকাতে পারে না কোনদিন। নিজেকে ভালোবাসতে, শ্রদ্ধা করতে নিজের এবং নিজের ভাললাগার পরিচর্চা করুন। যে সম্পর্ক দম বন্ধ করে দিচ্ছে, ঘরে যে মানুষটা ফিরলে আনন্দের বদলে মুখের হাসি মিলিয়ে যাচ্ছে, যার সাথে সময় কাটাতে পেঁয়াজ কাটার মতন চোখের পানি ঝরাতে হচ্ছে, নিজের মানসিক-শারীরিক ভালোলাগাকে অবদমন করতে হচ্ছে তার ব্যাপারে নতুন করে ভাবুন।  তাহসান মিথিলা দম্পতি এমনই ভেবেছেন। সুখ-শান্তিতে থাকতে চাওয়া একজনের মানবিক অধিকার। মানুষের মন অনেক বিচিত্র। আমরা আদতে পশু, যার মধ্যে অনেকখানি বুদ্ধিমত্তা দিয়ে সেরা পশু হিসেবে পাঠানো হয়েছে। আমাদের কোন প্রবৃত্তি আমাদের ডোমিনেট করবে সেটা যার যার উন্নত মস্তিষ্কের হিসাব। এই উন্নত মস্তিষ্কপ্রাপ্তির আশীর্বাদটাকে যত্ন নিন। কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেবেন না। আপনার ব্যক্তি জীবনের অন্যের অধিকার নাই, অন্যের ব্যক্তি জীবনেও আপনার নাই; যতক্ষণ না ফরহাদ মাজহারের মতন ব্যক্তিগত সমস্যায় রাষ্ট্রীয় জান,মাল, সময় অপচয় করছেন।   

লেখক : কলামিস্ট; প্রাক্তন রিসার্চ ফেলো, কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়; বিভাগীয় প্রধান, বিজনেস প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্ট, স্মার্ট সার্ভিস টেকনোলজিস কো. লিমিটেড, ফুকুওকা, জাপান।

neeta2806@yahoo.com

এইচআর/পিআর