বিশেষ প্রতিবেদন

রফতানি বাণিজ্যে গতি আনতে বিশেষ উদ্যোগ

রফতানি আয়ে প্রবৃদ্ধি ক্রমেই কমছে। যদিও ২০২১ সাল নাগাদ শুধু তৈরি পোশাক খাত থেকে রফতানি আয় ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত করার টার্গেট ধরা হয়েছে। কিন্তু বৈশ্বিক মন্দা, প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়া, ট্রেডিশনাল বাজার এবং পণ্য আমদানিতে নির্ভরশীলতা থাকাসহ বিভিন্ন কারণে রফতানি আয়ে গতি আসছে না। 

Advertisement

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে মধ্যম আয়ের দেশ গড়ার যে স্বপ্ন দেখছে সরকার, তা বিলম্বিত হবে। তাই রফতানি আয়ে গতি আনতে ১৬টি বিশেষ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে চায় সরকার। এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা গেলে পণ্য রফতানিতে নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি হবে, পাশাপাশি রফতানি আয়ও বৃদ্ধি পাবে। 

সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ‘রফতানি সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি’র এক সভায় এসব বিষয়ে আলোচনা হয়। রফতানি বাণিজ্য ও টেকসই উন্নয়নে কৌশলগত পরিকল্পনা প্রণয়নের অংশ হিসেবে এ সভার আয়োজন করা হয়। সভার কার্যপত্র থেকে এ তথ্য জানা গেছে।

সরকার রফতানি বাণিজ্য বৃদ্ধিকল্পে বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রমের ওপর জোর দিচ্ছে । এ লক্ষ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, সরকারি ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক, আমদানি ও রফতানি বাণিজ্যের প্রধান নিয়ন্ত্রক সংস্থা, যৌথমূলধনী কোম্পানি ও ফার্মস পরিদফতরে সংস্কার, বন্দর সমন্বয়ে ডিজিটাল সেল প্রতিষ্ঠা, রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো পুনর্গঠন এবং জাতীয় রফতানি হাউজ স্থাপন সংক্রান্ত কার্যক্রম এবং তা বাস্তবায়নে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে চায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

Advertisement

এছাড়া রফতানি বাণিজ্য সম্প্রসারণের প্রয়োজনে বাণিজ্যের বিভিন্ন খাতে দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নে পরিকল্পনা গ্রহণ এবং উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের কারিকুলামে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডাব্লিউটি) ও সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি অন্তর্ভুক্তকরণেরও উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।

কার্যপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, যেসব দেশ রফতানি উন্নয়নে এগিয়ে, যেমন- ভিয়েতনাম, তাইওয়ান, মালয়েশিয়া-কে রোল মডেল হিসেবে দেখিয়ে বিদেশে বাংলাদেশ মিশনসমূহের কমার্শিয়াল উইংসমূহে কর্মরত কাউন্সিলরদের আরও কার্যকর করতে আর্থিক ক্ষমতা প্রদানের বিষয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। 

বিদেশি মিশনসমূহে কর্মরত কমার্শিয়াল কাউন্সিলরদের নিয়ে ঢাকায় প্রতি দুই বছর অন্তর সম্মেলন অনুষ্ঠান এবং বাণিজ্য ও বিনিয়োগ উন্নয়নে ঢাকাস্থ বিদেশি মিশনসমূহে কর্মরত কমার্শিয়াল কাউন্সিলরদের নিয়ে প্রতি বছর সম্মেলন ও মতবিনিময় সভা করারও উদ্যোগ নেয়ার কথা বলা হয়েছে কার্যপত্রে। 

কার্যপত্রে আরও বলা হয়েছে, ডাব্লিউটিও সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে নিবিড়ভাবে কাজ করার জন্য সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনে অবস্থিত ইকোনমিক উইংকে বাণিজ্যিক দফতরে রূপান্তরকরণে তাগাদা দেয়া হয়েছে। এছাড়া কোম্পানি আইন ১৯৯৪ এর যে ধারা ইজি অব ডুয়িং বিজনেস’র ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে তা দ্রুত সংশোধনের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

Advertisement

রফতানি বাড়াতে সব ধরনের পণ্যের মান যাচাই ও সনদ প্রদান এবং রফতানির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দেশের সঙ্গে অ্যাক্রিডিটেশন সম্পন্ন করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ অ্যাক্রেডিটেশন বোর্ড (বিএবি), মান নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (বিএসটিআই), কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ উইং, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষসহ সব সরকারি প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা উন্নয়ন এবং বেসরকারি পর্যায়ে ল্যাব প্রতিষ্ঠায় প্রণোদনা প্রদানসহ পণ্য বহুমুখীকরণে চামড়া খাতসহ অন্যান্য রফতানি সম্ভাবনাময় গুরুত্বপূর্ণ খাতে ধারাবাহিকভাবে সুনির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্রণোদনার ব্যবস্থাসহ চামড়ানীতি বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়েও সভায় আলোচনা হয়।

এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে জানান, স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে অর্থাৎ আগামী ২০২১ সাল নাগাদ রফতানি আয় ৫০-৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার নির্ধারণ করা হয়েছে। এজন্য সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় দেশের রফতানি পণ্যের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং নতুন নতুন রফতানি বাজার সৃষ্টির জন্য সরকার বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে। 

রফতানি বৃদ্ধির জন্য আইটি (তথ্যপ্রযুক্তি), ওষুধ, ফার্নিচার, জাহাজ নির্মাণ ও কৃষিপণ্যের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ। অনেক পণ্য রফতানিতে নগদ আর্থিক সহায়তা দেয়া হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের রফতানি বাড়ছে। তবে নিজেদের সামর্থ বাড়াতে বেশ কয়েকটি জায়গায় সংস্কার করতে হবে। এ সংস্কার মানে সক্ষমতা বাড়ানো। এজন্য বৈঠকে অনেকগুলো কার্যকর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে- জানান ওই কর্মকর্তা। 

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, রাশিয়াতে আমাদের পোশাকপণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিতকরণ এবং ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের লক্ষ্যে রাশিয়া ও মিয়ানমারের সঙ্গে ব্যাংকিং সমস্যা দূরীকরণের প্রতি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। 

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, আমাদের রফতানি আয় পোশাক খাতের ওপর নির্ভরশীল। এ খাতে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে প্রতি বছর গড়ে ১৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধির প্রয়োজন হয়। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে এক ধরনের চাপ আছে। এ কারণে প্রবৃদ্ধির এ উচ্চহার অর্জন সম্ভব নয়। এটি অর্জনের জন্য অন্যান্য খাতের দিকে মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন।

তিনি বলেন, আগামী সাত বছরে শ্রমিকদের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে, মজুরি বাড়বে। মালিকদের উচ্চ ব্যয় ও উচ্চ আয়- এ কাঠামোর মধ্যে প্রবেশ করতে হবে। সে জন্য বর্তমানে কম মূল্যের পণ্যের চেয়ে বেশি মূল্যের পণ্য তৈরি ও রফতানির দিকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের কারখানাগুলোর পর্যাপ্ত প্রস্তুতি আছে কি না- সে বিষয়েও নজর দিতে হবে।

এমএ/এমএআর/পিআর