সোলেমা বেগমের তিনটি ছেলেমেয়ে। এরমধ্যে দুটি ছেলে, একটি মেয়ে। অল্প বয়সে বিধবা হয়ে তিনটি সন্তান নিয়ে অভাব আর দরিদ্রতার দায় ঘাড়ে নিয়ে দিন কাটিয়েছেন তিনি। বড় ছেলেটি রাজমিস্ত্রির কাজ করে। সেই টাকায় খেয়ে না খেয়ে তাদের দিন চলে। পঁচিশ বছর আগে স্বামীকে হারিয়েছেন। কিন্তু মনোবল হারাননি। দুঃখের সমুদ্র তাকে পাড়ি দিতে হবে যে!
Advertisement
সোলেমা বেগমের ছোট ছেলেটি মেধাবী। দুখিনী মা আশার আলো দেখেন। শত অভাবেও ছেলেটির পড়াশোনা বন্ধ করেন না। ছেলেটিকে পড়াতে পাঠান দূরের শহর ঢাকায়। মুরগি, ছাগল পেলেপুষে তাই বিক্রি করে টাকা জমান। ছেলেটির পড়ার জন্য খরচ পাঠান। এই তো, আর মাত্র কটা দিন। ছেলেটি পাস করে বের হলেই নিশ্চয়ই একটা চাকরি পাবে। মায়ের দুঃখের দিন শেষ হলো বলে!
সোলেমা বেগমের মেধাবী ছেলেটি হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছে। তার দুচোখে কোনো স্বপ্ন নেই, স্বপ্ন নেই সোলেমা বেগমের চোখেও। ছেলেটি তার অন্ধ হওয়ার পথে। আর কোনোদিন চোখে আলো ফুটবে না সিদ্দিকুরের। মায়ের সব আশার আলো নিভে গেছে সিদ্দিকুরের চোখের অনন্ত অন্ধকারে। সিদ্দিকুর আর কোনোদিন হাসবে না। তার চোখের আলো নিভে গেছে, তার মুখের হাসি ফুরিয়ে গেছে। আপনারা নিশ্চয়ই এতক্ষণে সিদ্দিকুরের অপরাধটা জেনে গেছেন! সিদ্দিকুরের অপরাধ ভীষণ গুরুতর! সে তার পরীক্ষা যেন সময়মতো হয়, তার জন্য আন্দোলন করেছিল। সে তার পরীক্ষার রুটিন চেয়েছিল। কতবড় সাহস! হাজার হাজার ছাত্রের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার যে অধিকার কর্তৃপক্ষের, তার বিরোধিতা করেছিল সে!
গরিব মায়ের গরিব ছেলেটির উচিত ছিল চুপচাপ থাকা। বছরের পর বছর শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ও পড়াশোনা নিয়ে যে প্রহসন চলে আসছে এই দেশে, তা নীরবে মেনে নেয়া। বোকা ছেলেটি কেন আন্দোলন করতে গেল! তার দুখিনী মা এখন কী আশায় বাঁচবে! সাতাশ বছরের টগবগে তরুণের চোখের আলো নিভিয়ে দিলো যারা, তাদের কোনো বিচার এদেশে হবে না। কোনোদিন হয়নি।
Advertisement
লিমন তার পা হারিয়েছিল, তনু তার জীবন দিয়েছে, সিদ্দিকুর তার চোখ হারালো। আর এভাবে কতজন যে প্রাণ দিয়েছে, স্বপ্ন হারিয়েছে তার সঠিক হিসাব কেউ জানে না। এদেশে খুনি, ধর্ষক, ঋণখেলাপী, পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসকারীরা সগৌরবে বাঁচে। কিন্তু এদেশে নিজের পরীক্ষা সময়মতো নেয়ার দাবিটা অন্যায়। গুরুতর অপরাধ। সেই অপরাধের ক্ষমা নেই। এদেশে তারকা দম্পতি ডিভোর্স করলে তোলপাড় হয়ে যায়, কিন্তু দরিদ্র আর মেধাবী তরুণেরা অন্ধ হয়ে গেলে আমাদের বিবেকের ছাকনিতে তা আটকা পড়ে না। যেন এটাই স্বাভাবিক। এরকমটাই নিয়ম।
এরকমটাই চলে আসছে অনন্তকাল ধরে। প্রতিবাদ করার কেউ নেই। প্রতিবাদীরা খুন হয়ে যায়, গুম হয়ে যায়, অন্ধ হয়ে যায়। নিজের সাধের প্রাণখানা কে খোয়াতে চায়! সিদ্দিকুরের মা আর কাঁদে না। তার চোখের পানি ফুরিয়ে গিয়ে থাকবে সম্ভবত। তার ছেলেটি যে আর ফোন করে বলবে না, 'ঈদের ছুটিতে বাড়ি আসছি মা, আমার জন্য নতুন আলু দিয়ে মুরগির তরকারি রেঁধে রাখো, কতদিন তোমার মমতামাখা হাতের রান্না খাই না!' সিদ্দিকুর আর কোনোদিন বলবে না, 'টিউশনির টাকায় তোমার জন্য নতুন শাড়ি কিনেছি মাগো, সবুজ রঙ কি তোমার পছন্দ?' সিদ্দিকুর আর কিছুই বলবে না। সে তার চোখ হারাতে বসেছে। দুখিনী মায়ের আঁচলে মিলবে তার শেষ আশ্রয়। কিন্তু যে মা তার সন্তানের মুখে চেয়ে একটু সুখ আর সাচ্ছন্দ্যের আশায় এতগুলো বছর বেঁচে ছিলেন, তিনি কী নিয়ে বাঁচবেন?
অন্ধ ছেলেকে নিয়ে তিনি কোথায় যাবেন? কে দেবে সিদ্দিকুরের ভরণপোষণের খরচ? তরুণ ছেলেটিকে তিনি তিনবেলা খাবার দেবেন কোথা থেকে? সিদ্দিকুরের চিকিৎসা এখনও পর্যন্ত চলছে বন্ধুদের সহায়তায়। কিন্তু কতদিন? হায় মা, দুখিনী মা, কতটা দুঃখ বুকে নিয়ে তোমাকে চলে যেতে হবে! যারা তোমার স্বপ্ন, তোমার আশার আলো নিভিয়ে দিলো, তোমার সন্তানের চোখের আলো কেড়ে নিলো তাদেরকে তুমি ক্ষমা করবে? মায়েরা তো উদার হয়, সমুদ্রের চেয়েও বিশাল তাদের হৃদয়। যদি সম্ভব হয় মাগো, আমাদের তুমি ক্ষমা করে দিয়ো। নইলে তোমার দীর্ঘশ্বাসে আমাদের ধ্বংস যে অনিবার্য!
এইচআর/পিআর
Advertisement