মতামত

দরকার মানুষ হিসেবে জিপিএ ফাইভ পাওয়া

প্রতিবছর এইচএসসি ও এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর একই চিত্র। একদল ছেলেমেয়ের চোখেমুখে আনন্দ। তারা ভি-চিহ্ন দেখাচ্ছে। এই ছবি আজকের নয়। বহুপুরনো। আশৈশব এমন ছবি দেখছি পত্রিকায়। আমি নিজে যখন স্কুল কলেজের শিক্ষার্থী তখন বোর্ডে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় স্থান অধিকারীদের ছবি দেখা যেত পত্রিকায়। সঙ্গে তাদের বাবা-মা। সেসময় একেকজন ছাত্রছাত্রীর আট দশজন করে প্রাইভেট টিউটর লাগতো। বলতে গেলে প্রতি সাবজেক্টে একজন করে টিচার না হলে ভালো ফলাফল সম্ভব হতো না। তখন একটু একটু করে কোচিং পদ্ধতি শুরু হয়েছে। এখন লাগে লাগাতার কোচিং। এখন প্রতি বিষয়ে কোচিং না করলে ভি-চিহ্ন দেখানেওয়ালাদের দলে স্থান পাওয়া যায় না। তবে অদম্য মেধাবী কয়েকজন তখনও ছিল এখনও আছে। দিনমজুরের, কৃষকের বা গরীব বিধবার সন্তান বোর্ডে স্থান পেয়ে কিংবা এখন গোল্ডেন জিপিএ ফাইভ পেয়ে চমকে দেয় বা দিয়েছে।

Advertisement

এর বিপরীতে অন্যচিত্রও রয়েছে। আমার শিক্ষার্থী জীবনে তার মানে আশি ও নব্বইয়ের দশকে ফেলের হার এখনকার চেয়ে অনেক বেশি ছিল। এখন ফেলের হার সে তুলনায় কম। তবু তো অনেকে ফেল করে। আবার অনেকে ফেল নয় কিন্তু হয়তো প্রত্যাশিত ভালো রেজাল্টটি করতে পারেনি। সে পরিবারে নেমে আসে রীতিমতো শোকের ছায়া। আক্ষরিক অর্থে শোকের ছায়াও নেমে আসে কোন কোন পরিবারে। কারণ অকৃতকার্য ছেলেমেয়েদের আত্মহত্যাও বিরল ঘটনা নয়। মনে পড়ে একটি ঘটনা। আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। আমার সঙ্গে একই স্যারের কাছে ইংরেজি পড়তো একটি মেয়ে। সে ছিল ক্লাস টেন-এ। ছোটখাটো ফর্সা মেয়েটি। হাসিখুশি। তার নামও শান্তা। সে পড়তো ভিকারুননেসা স্কুলে। ভালো ছাত্রী। প্রথমবিভাগ তো বটেই, তার স্টার পাওয়ার কথা। কিন্তু সে এসএসসিতে দ্বিতীয় বিভাগ পায়। বাড়িতে বাবা-মা তাকে বেশ বকাঝকা দেয়। এরপরের দিন সন্ধ্যায়, বাড়িতে তখন বৃদ্ধ দাদী আর শান্তা ছাড়া আর কেউ নেই। অভিমানে মেয়েটি বাড়িতে রাখা ইঁদুরমারা বিষ খেয়ে ফেলে। তারপর তার যে কি বাঁচার আকুতি। দাদীকে বারবার বলে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে। সেটা মোবাইলের যুগ নয়। বৃদ্ধা অনেক কষ্টে বাইরে থাকা ছেলেবউকে ফোনে খবর দেন। মেয়েটিকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। তবু বাঁচানো যায়নি সেই অভিমানী কিশোরীকে।  আজও যখন আমি পত্রিকায় দেখি খারাপ ফলাফলের কারণে কোন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে তখন সেই মেয়েটির চেহারা ভেসে ওঠে মনে। আজ সে বেঁচে থাকতে পারতো। হয়তো সমাজে উল্লেখযোগ্য অবদানও রাখতো।

আরেকটি কিশোরের কথাও ভুলতে পারি না। গত দুয়েক বছরের ঘটনা। এসএসসি বা এইচএসসি এমনি কোন একটি পরীক্ষায় সে জিপিএ ফোর পায়। বাবা-মা তাকে এত তিরস্কার করে যে ছেলেটি আত্মহত্যা করে। একজন মানুষের জীবনের বিপুল সম্ভাবনার তুলনায় পরীক্ষার রেজাল্ট একটি তুচ্ছ বিষয়। অথচ এই তুচ্ছ বিষয়টির জন্য অকারণ অভিমানে ঝরে যায় কত সম্ভাবনাময় জীবন। এজন্য দায়ী আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। একটি মাত্র পরীক্ষায় পাশ-ফেল তো কত কারণেই হতে পারে। ঠিক পরীক্ষার সময়টাতে অসুস্থও থাকতে পারে কত পরীক্ষার্থী। স্কুল ও কলেজের সারা সময়ের লেখাপড়া যদি শুধু এই একটি পরীক্ষার উপর নির্ভর করে তাহলে সেটা ছেলেমেয়েদের প্রতি অবিচার বৈকি।

আজকাল সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতি চলছে। কিন্তু অনেক শিক্ষক আছেন যারা নিজেরাই এই পদ্ধতি বোঝেন না। তারা তাদের ছাত্র-ছাত্রীদের বোঝাতেও পারেন না। অনেক বাবা-মায়ের সামর্থ থাকে না প্রতি বিষয়ে কোচিং করানোর। এসব কারণেও ফলাফলের তারতম্য হয়ে যায়। অনেক শিক্ষক ইচ্ছা করেই শ্রেণিকক্ষে বিষয়টি না বুঝিয়ে অপেক্ষায় থাকেন কোচিংয়ের। না বুঝে মুখস্ত করা ছেলেমেয়ের সংখ্যাও কম নয়। এসব অনেক কারণেই পরীক্ষায় ভালো ফলাফল এবং গোটা পরীক্ষাপদ্ধতিটাই আমার কাছে মনে হয় অর্থহীন এক প্রহসন সত্যিকারের শিক্ষা থেকে বহুদূরে যার অবস্থান। পত্রিকার পাতায় তাই হাসিমুখের ছেলেমেয়ের ছবি দেখা মাত্র আমার মনের চোখে ভেসে ওঠে সেইসব ছেলেমেয়ের ছবি যারা আশানুরূপ ফলাফল না করে মুখ বিষণ্ণ করে বসে থাকে ঘরের কোণে। আমার আজকের লেখাটা ওদের জন্যই। ওদেরকে আমি বলতে চাই, জীবনে ছোটখাটো এসব ঘটনা কিছুই নয়। এসব কারণে মন খারাপ করে বসে থাকা চলবে না। এবার ভালো হয়নি, আগামীবার অবশ্যই ভালো হবে। তোমরা যেন জীবনের পরীক্ষায় ভি-চিহ্ন দেখাতে পারো সেই প্রার্থনা করি। ফুলের মতো সুন্দর ছেলেমেয়েরা মন খারাপ করে আছে, তাদের তিরস্কার করছে বাবা-মা এই দৃশ্যটি যতবার কল্পনা করছি আমার বুকে পাষাণভার জমে উঠছে। এসো আমরা আজ পরীক্ষা নয়, ফলাফল নয় অন্যকিছুর গল্প করি। অন্য কথা ভাবি। আমরা আজ সাহিত্যে, বিজ্ঞানে, খেলাধূলায়, সংগীতে, শিল্পে ভালো করার কথা ভাবি। আজ আমরা মঙ্গলগ্রহ জয় করার স্বপ্ন দেখতে চাই, মহাসাগরের অতলান্ত রহস্যভেদের স্বপ্ন দেখতে চাই। সে স্বপ্ন হয়তো সফল করবে তোমরাই, যারা জিপিএ ফাইভ পাওনি, অথবা পেয়েছ।

Advertisement

বাবা-মাকেও বলি ছেলেমেয়েদের শুধু সফলতার নয়, বিফলতারও শিক্ষা দিন। সকলে জিপিএ ফাইভ পাবে না। পাওয়ার দরকারও নেই। তাদের এজন্য বকাঝকা করবেন না। বরং এই মনখারাপের সময়টায় তাদের পাশে থাকুন। তাদের অনুপ্রেরণা দিন আগামীর জন্য। জিপিএ ফাইভ পাওয়া মানেই জীবনের মোক্ষ অর্জন নয়। জীবন অনেক বড় এবং সম্ভাবনায় পরিপূর্ণ। বিফলতা মেনে নিয়ে তা থেকে শিক্ষা নিতে হবে আগামীতে এগিয়ে যাবার। তীর ছুঁড়তে হলে প্রথমে টেনে পিছনে নিতে হয়। আজ যারা বিফল হয়েছে তারা যেন আগামীতে লক্ষ্যভেদ করতে পারে সাফল্যের সঙ্গে। আর জীবনের সফলতার হিসেবও তো সবসময় একরকম নয়। মানবিকতায় জিপিএ ফাইভ পাওয়াটাই হওয়া উচিত লক্ষ্য। মানুষ হিসেবে বড় হওয়ার পরীক্ষাই জীবনের চরম ও প্রধান পরীক্ষা।  

লেখক : কবি, সাংবাদিক।

এইচআর/জেআইএম

Advertisement