বিশেষ প্রতিবেদন

পোশাক শিল্পে দক্ষ শ্রমিকের ঘাটতি ১৫ লাখ ছাড়াবে

২০২৫ সাল নাগাদ রফতানি আয়ের ৮০ শতাংশ জোগানদাতা দেশের তৈরি পোশাক শিল্পে দক্ষ শ্রমিকের ঘাটতি প্রকট থেকে প্রকটতর হবে। তখন এখাতে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা দাঁড়াবে ৫০ লাখ ২৭ হাজার ৪৬৩ জন। আর দক্ষ শ্রমিকের ঘাটতি দাঁড়াবে অন্তত ১৫ লাখ।

Advertisement

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে এ খাতে দক্ষ শ্রমিকের অভাব রয়েছে এক লাখ ১৯ হাজার ৪৭৯ জন। আর আধাদক্ষ শ্রমিকের অভাব রয়েছে ৪৮ হাজার ১৩০ জন। এছাড়া অদক্ষ শ্রমিকের অভাব রয়েছে ৮ হাজার ৫৭৭ জন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২১ সালে তৈরি পোশাকখাত থেকে ৫০ বিলিয়ন ডলার রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্র নির্ধারণ করেছে সরকার। নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ধীর গতিতে হলেও সে পাথেই এগুচ্ছে এ শিল্প। তবে তৈরি পোশাক কারখানায় দক্ষ শ্রমিকের অভাব এ খাতের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বাজেটে জিডিপির যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তা যদি আমাদের অর্জন করতে হয় তাহলে এ পরিমাণ দক্ষ শ্রমিকের ঘাটতি মেটাতে হবে। তা না হলে লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নাও হতে পারে। আগামীতে আরও অধিকহারে এ খাতে দক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন হবে। তাই জনগোষ্ঠীকে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করতে হবে। তা না হলে আমাদের কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হবে না।

Advertisement

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন শিল্পখাতে শ্রমিক ঘাটতি প্রকট হচ্ছে। শিল্প-কারখানায় এখন অসংখ্য পদ খালি। দেশে শিক্ষিত বেকারের অভাব নেই। তবে অভাব রয়েছে দক্ষ শ্রমশক্তির। দক্ষতা বা প্রশিক্ষণের অভাবে চাকরি হচ্ছে না বিশাল বেকার জনগোষ্ঠীর। দক্ষ কাজের লোক পাচ্ছেন না কারখানার মালিকরা। অগণিত কর্মক্ষম মানুষ বেকার থাকার পরও শ্রমিকের অভাবের জন্য দক্ষতার অভাবকে দায়ী করছেন শিল্পমালিকরা। আগামী বছরগুলোতে শিল্পের প্রয়োজন মেটাতে শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তোলার তাগিদ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।

তারা বলছেন, আমাদের জনগোষ্ঠীকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরিত করতে না পারলে কাঙ্ক্ষিত জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হবে না।

এ বিষয়ে বিআইডিএস’র মহাপরিচালক কে এ এস মুর্শীদ জাগো নিউজকে বলেন, বর্তমানে দক্ষ শ্রমিকের অভাব বড় আকার ধারণ করেছে। ভবিষ্যতে এটা আরও প্রকট আকার ধারণ করবে। আগামী ১০ বছরে তৈরি পোশাকখাতে দক্ষ শ্রমিকের অভাব হতে পারে অন্তত ১৫ লাখ। এ প্রকট বাড়তে থাকলে কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হবে না। তাই সরকারকে দক্ষ শ্রমিক তৈরিতে বেশি বেশি গুরুত্ব দেয়ার আহ্বান জানান তিনি।

প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে তৈরি পোশাকখাতে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা বড়বে ১২২ দশমিক ৬ শতাংশ। আর আধাদক্ষ শ্রমিকের চাহিদা বাড়বে ৪৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ। তবে ওই সময়ে অদক্ষ শ্রমিকের চাহিদা কমবে ৩ দশমিক ১৭ শতাংশ।

Advertisement

এতে দেখা গেছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এ খাতে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা ছিল ২২ লাখ ৫৮ হাজার ২৫০ জন। এ সময় চাহিদার তুলনায় দক্ষ শ্রমিক কম ছিল এক লাখ ১৯ হাজার ৪৭৯ জন। আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা দাঁড়াবে ৩৬ লাখ ৬৬ হাজার ৪০৬ জনে। তখন ১৫ লাখ শ্রমিককে নতুন করে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ শ্রমিকে পরিণত করতে হবে।

২০২৫-২৬ অর্থবছরে এ চাহিদ আরও বেড়ে দাঁড়াবে ৫০ লাখ ২৭ হাজার ৪৬৩ জনে। যা বর্তমানের চেয়ে ১২২ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি। ওই সময় আরও ২১ লাখ শ্রমিককে নতুন করে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ শ্রমিক পরিণত করতে হবে।

বর্তমান ধারায় দক্ষতা বাড়াতে থাকলে আলোচিত সময়ে এ খাতে দক্ষ শ্রমিকের ঘাটতি দাঁড়াতে পারে ১৫ লাখে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে পোশাক খাতে আধাদক্ষ শ্রমিক কর্মরত রয়েছেন ১২ লাখ ৩০ হাজার ১৬৪ জন। আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরে আধাদক্ষ শ্রমিকের চাহিদা দাঁড়াবে ১৩ লাখ ৪৫ হাজার ৪৭৭ জন। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এ চাহিদ আরও বেড়ে দাঁড়াবে ১৮ লাখ ২৯ হাজার ৮৭১ জনে। যা বর্তমানের চেয়ে ৪৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ বেশি।

২০১৫-১৬ অর্থবছরে এ খাতে অদক্ষ শ্রমিক কর্মরত রয়েছেন ছয় লাখ ১৮ হাজার ৭০৮ জন। আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা কমে দাঁড়াবে চার লাখ ৪৪ হাজার ৩৪৭ জনে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এ চাহিদা একটু বেড়ে দাঁড়াবে পাঁচ লাখ ৯৯ হাজার ৯১ জনে। যা বর্তমানের চেয়ে ৩ দশমিক ১৭ শতাংশ কম।

তৈরি পোশাক রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ সূত্রে জানা গেছে, তৈরি পোশাক কারখানায় দক্ষ শ্রমিকের অভাবের সুযোগে বর্তমানে ১৮ হাজার বিদেশি শ্রমিক কাজ করছে এ খাতে। প্রতি বছর চার হাজার কোটি টাকা দেশে নিয়ে যাচ্ছে এসব বিদেশি শ্রমিক। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ পড়ছে। উচ্চহারে বেতন ও কাজের ক্ষেত্রে জাতীয়তার ভিত্তিতে বিশেষ সুবিধা নিলেও কারখানাগুলোতে তদারকির নামে খবরদারির অভিযোগ রয়েছে বিদেশি শ্রমিকদের বিরুদ্ধে।

রফতানি আয়ের ৮০ শতাংশ জোগানদাতা দেশের তৈরি পোশাক শিল্পে দক্ষ শ্রমিকের অভাব প্রকট। বিশেষ করে ব্যবস্থাপনার মধ্যম পর্যায়ে রয়েছে ওই অভাব। কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে আমদানি করা যন্ত্রপাতির উৎপাদন ক্ষমতা এজন্য কাজে লাগানো যায় না। দামি এসব যন্ত্রপাতির অন্তত ২৫ শতাংশের উৎপাদন ক্ষমতা অব্যবহৃত থাকে।

বিজিএমইএ’র গবেষণা সেলের সূত্র মতে, ২০ শতাংশ দক্ষ শ্রমিকের ঘাটতি নিয়েই চলছে দেশের পোশাক খাত। এ সুযোগে দেশে চার হাজার তৈরি পোশাক কারখানায় অন্তত ১৮ হাজার বিদেশি শ্রমিক কাজ করছেন। অভিযোগ রয়েছে, কারিগরি ব্যবস্থাপক ও কারিগরি পরিচালক পদে কাজ করতে এসে কেউ কেউ এদেশে পোশাক কারখানার মালিক হয়েছেন। শ্রীলংকা, ফিলিপাইন, ভারত থেকে আসা শ্রমিকরা তৈরি পোশাক কারখানাগুলোতে কাজ করছেন। এছাড়া ইউরোপ ও আমেরিকা থেকেও কিছু শ্রমিক বাংলাদেশে ইন্টার্ন করছে।

সাভারের একটি পোশাক কারখানার প্রোডাকশন ম্যানেজার নাম প্রকাশ না করে জানান, উচ্চ বেতনভোগী এসব বিদেশি শ্রমিকের অনেকের এ দেশে কাজ করার বৈধ কাগজপত্র নেই। কাগজপত্র ছাড়াই তারা এ দেশে বছরের পর কাজ করে যাচ্ছেন।

এমইউএইচ/এমএআর/জেআইএম