মতামত

ক্রসফায়ারের গল্প তাহলে সত্যিই মিথ্যা!

সাভারের সরকার দলীয় সাংসদ ডা. এনামুর রহমানকে ধন্যবাদ। তিনি নিশ্চয়ই দৈনিক মানবজমিনকে সাক্ষাৎকার দেয়ার আগে ফ্রুটিকা খেয়েছিলেন। তাই তো তিনি অকপটে সত্যি কথাটা বলে দিয়েছেন। আমরা শুরু থেকেই বলে আসছিলাম ক্রসফায়ারের নামে যা হয়, তা নিছক ঠাণ্ডা মাথার খুন। ক্রসফায়ারের পর র্যা ব বা পুলিশ যে প্রেস রিলিজ পাঠায়, তা অবিশ্বাস্য এক মিথ্যা। তার মানে বছরের পর বছর র‌্যাব-পুলিশ একসঙ্গে দুটি অপরাধ করে আসছে, তালিকা ধরে ধরে ঠাণ্ডা মাথায় খুন এবং সেটা ঢাকতে মিথ্যা প্রেস রিলিজ রচনা। এতদিন কেউই আনুষ্ঠানিকভাবে এই খুন ও মিথ্যার দায় স্বীকার করেননি। এই প্রথম একজন আইন প্রণেতা সত্যটা

Advertisement

স্বীকার করে নিলেন। এতদিন যা ছিল ওপেন সিক্রেট, এখন থেকে তা ওপেন হয়ে গেল।

চলুন দেখে আসি কী বলেছেন সাভারের বর্তমান এমপি ডা. এনামুর রহমান, ‘সাভারে অনেক ক্যাডার আর মাস্তান ছিল। এখন সব পানি হয়ে গেছে। কারও টুঁ শব্দ করার সাহস নেই। ৫ জনকে ক্রসফায়ারে দিয়েছি, আরো ১৪ জনের লিস্ট করেছি। সব ঠাণ্ডা। লিস্ট করার পর যে দু’একজন ছিল তারা আমার পা ধরে বলেছে, আমাকে

জানে মাইরেন না আমরা ভালো হয়ে যাবো।’ 

Advertisement

এনামুর রহমান অবশ্য ভুল কিছু বলেননি। বরং সন্ত্রাস দমনের জন্য অব্যর্থ টোটকাটাই বেছে নিয়েছেন। গত ১৩

বছর ধরে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নে ‘ক্রসফায়ার’এর চেয়ে ভালো কোনো উপায় কেউ বের করতে পারেনি। সাধারণত বাংলাদেশে বিএনপি যা করে, আওয়ামী লীগ তার উল্টোটা করে। কিন্তু ‘ক্রসফায়ার’এর ক্ষেত্রে দুদলে দারুণ ঐকমত্য। র‌্যাব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিএনপি যে টোটকা আবিষ্কার করেছে, আওয়ামী লীগ

তাকে এগিয়ে নিয়েছে দারুণ দক্ষতায়। অবশ্য ওপর মহলের ঝাড়ি খেয়ে এনামুর রহমান পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে তার বক্তব্য প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। 

খেয়াল করে দেখুন, মাননীয় সংসদ সদস্য কিন্তু বক্তব্য অস্বীকার করেননি, প্রত্যাহার করেছেন। তার মানে তিনি যা বলেছেন ঠিকই বলেছেন, হয়তো এভাবে বলাটা ঠিক হয়নি। এনামুর রহমান দোষ স্বীকার করে জাতির কাছে ক্ষমাও চেয়েছেন। কিন্তু তার দোষটা কোথায় আর ক্ষমাই বা চাইছেন কেন, বুঝতে পারছি না। সত্য বলাটা তো দোষের নয়। বরং দিনের পর দিন ক্রসফায়ারে মানুষ খুন করে মিথ্যা গল্প চাপিয়ে দেয়াটা অন্যায়। র‌্যাব-পুলিশ যদি দোষ স্বীকার করে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতো, তাহলে সেটাকে আমরা স্বাগত জানাতাম। 

Advertisement

এনামুর রহমান লোক ভালো। তিনি পেশাদার রাজনীতিবিদ নন। তিনি মূলত চিকিৎসক। সাভারে গড়ে তুলেছেন একটি মানসম্পন্ন হাসপাতাল। জনগণের সেবা করেই কাটছিল তার দিন। ২০১৩ সালে সাভারের রানা প্লাজা ধসের পর এনাম মেডিকেল দারুণ ভূমিকা পালন করে। তখনই আলোচনায় আসেন ডাক্তার এনামুর রহমান। সেই মানবসেবার পথ ধরে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি নির্বাচিত হন তিনি। ক্যারিয়ার পলিটিশিয়ান হলে নিশ্চয়ই এমন অকপটে ক্রসফায়ারের কথা স্বীকার করতেন না তিনি। তবে এনামুর রহমানের বক্তব্যের পর সাভারে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকেই খোঁজখবর নিচ্ছে, এমপির তালিকায় তার নাম আছে কিনা। থাকলে সে নাম কাটানোর উপায় কী? অনেকে এলাকা ছেড়েছেন। তবে পালিয়ে যাবেন কোথায়? শুধু সাভার নয়, গোটা বাংলাদেশেই ক্রসফায়ার এক নির্মম বাস্তবতা। খুব বেশি আলোচনা-সমালোচনা হলে ক্রসফায়ার কমে যায়, কিন্তু তখন আবার বেড়ে যায় গুম। ক্রসফায়ার করলে তবু মিথ্যা হলেও একটা প্রেস রিলিজ দিতে হয়। গুম করলে তাও দিতে হয় না, খালি অস্বীকার করলেই হয়।

শুধু সাভার নয়, এনামুর রহমান যা বলেছেন, তা সারা বাংলাদেশের জন্যই সত্যি। এটাও সত্যি সন্ত্রাস দমনে ক্রসফায়ারের চেয়ে ভালো কোনো উপায় নেই। যত বড় সন্ত্রাসীই হোক। জানের মায়া সবারই আছে। ক্রসফায়ারের পক্ষে হাজারটা যুক্তি আছে। সন্ত্রাসীদের ধরা হলে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করা যায় না। কেউ ভয়ে

তাদের বিপক্ষে সাক্ষি দিতে চায় না। আর আইনের ফাঁক গলে সন্ত্রাসীরা জামিন পেয়ে যায় বা কিছুদিন কারাভোগ করে এসে আবার দ্বিগুণ উদ্যমে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড শুরু করে। আর একবার কারাভোগ করে এলে সেই সন্ত্রাসীর চাঁদার হার বেড়ে যায়। আর মানবাধিকার নিয়ে যারা কথা বলেন, তাদের মুখ বন্ধ করতে বলা হয়, সন্ত্রাসীদের কোনো মানবাধিকার থাকতে নেই।

যত যুক্তিই দেয়া হোক, ক্রসফায়ার কখনোই সমাধান নয়। সব মানুষেরই মানবাধিকার আছে, তিনি সন্ত্রাসী হোন আর ভালো মানুষ। সবারই আইনের সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার আছে। যে দেশে বঙ্গবন্ধুর খুনি, যুদ্ধাপরাধীরা আইনের সর্বোচ্চ সুবিধা পান, সে দেশে ক্রসফায়ার চলতে পারে না। ক্রসফায়ারে খুন হয়ে যাওয়া সাভারের সেই পাতি সন্ত্রাসী নিশ্চয়ই গোলাম আযম বা সাঈদীর চেয়ে খারাপ নয়। গোলাম আযমেরও স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে, সাঈদী এখনও কারাগারে।

ক্রসফায়ার হলো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সূচক। এমনিতে ক্রসফায়ার বাড়লে সব এলাকা সাভারের মত ‘পানির মত ঠান্ডা’ হয়ে যায়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ক্রসফায়ার যত বেশি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তত খারাপ। আইনের শাসন না থাকলেই, ক্রসফায়ারের প্রাদুর্ভাব বাড়ে। হাজার যুক্তিতেও আপনি ক্রসফায়ার জায়েজ করতে পারবেন না। কারণ মানুষের জীবনের চেয়ে মূল্যবান কিছু নেই। বিজ্ঞান অনেক কিছু আবিস্কার করেছে।

কিন্তু মানুষের জীবন দিতে পারে না। তাই যা আপনি দিতে পারবেন না, তা নিতেও পারবেন না। আর এ কারণেই ফাসিঁর আসামী আইনে আপিল, রিভিউ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা- সব ধাপে সুযোগ পায়। যাতে কোনোভাবেই কোনো নির্দোষ লোকের জীবন না যায়। সেই একই দেশে এমপি, পুলিশ, র‌্যাবের তালিকা করে ধরে নিয়ে মেরে ফেলা চলতে পারে না।

আওয়ামী লীগ যখন বিরোধী দলে ছিল, তখন তারা ক্রসফায়ারের বিপক্ষে ছিল। এখন বিএনপি দারুণ মানবাধিকারবাদী, ক্রসফায়ারের ঘোরতর সমালোচক। এনামুর রহমানের বক্তব্যের পর বিএনপির ব্রিফিং বিশেষজ্ঞ রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বলেছেন, এই বক্তব্য প্রমাণ করে সব বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুম-খুনের সঙ্গে সরকতার প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। তিনি যা বলেছেন, ঠিকই বলেছেন। কিন্তু যত ঠিকই বলুন, ক্রসফায়ারের সমালোচনা করার নৈতিক অধিকার বিএনপির নেই। কারণ ক্রসফায়ার শুরু হয়েছিল বিএনপির হাত ধরেই।

ক্রসফায়ারের গল্পটা বাংলাদেশের শিশুরও মুখস্থ। ক্রসফায়ারের তালিকায় থাকা কোনো সন্ত্রাসীকে ধরার পর গভীর রাতে পুলিশ বা র‌্যাব তাকে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধারে যায়। তখন সহযোগীরা তাকে ছিনিয়ে নিতে র‌্যাব-পুলিশের ওপর হামলা চালায়। দুইপক্ষের গুলি বিনিময়ে শুধু পুলিশের হাতে থাকা লোকটি মারা যায়। এই গল্পটি যে আষাঢ়ে এনামুর রহমানের বক্তব্যে তা প্রমাণিত। ধন্যবাদ এনামুর রহমানকে ১৩ বছর পর এই প্রথম ক্রসফায়ারের গল্পটিকে সত্যি সত্যি মিথ্যা প্রমাণ করার জন্য।

২৩ জুলাই ২০১৭

probhash2000@gmail.com

এইচআর/পিআর