বিশেষ প্রতিবেদন

বদলে গেল মানসিক ভারসাম্যহীন রাণী

দীর্ঘ তিন বছর ধরে হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার আউশকান্দি বাজারের মানসিক ভারসাম্যহীন নারী রাণীকে (৪০) জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সেখানে তিনি ৩০৮ নম্বর রুমের ৩ নম্বর বেডে চিকিৎসাধীন।

Advertisement

শনিবার দুপুরে তাকে ওই হাসপাতালে ভর্তি করেন যমুনা ব্যাংকের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ বাংলাদেশের একমাত্র মানসিক ভারসাম্যহীন রোগীদের ব্যক্তি উদ্যোগে চিকিৎসা সেবা দিয়ে সুস্থ করে তোলা মানবসেবী শামীম আহমেদ। এসব কাজে তাকে প্রতিনিয়ত সহযোগিতা করেন সহকর্মী আলি সাব্বির ও শফিকুল ইসলাম।

এর আগে শুক্রবার দুপুরে রাণীকে নবীগঞ্জ উপজেলার আউশকান্দি বাজারে এক আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হয়। এসময় সেখানে হবিগঞ্জ-১ (নবীগঞ্জ-বাহুবল) আসনের এমপি মুনিম চৌধুরী বাবু ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তানজিলা সারওয়ারসহ স্থানীয় গণমান্য ব্যক্তিবর্গ ও উপজেলার বিভিন্ন গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন।

রাণীকে আনতে বৃহস্পতিবার রাতেই শামীম আহমেদসহ ৫ সদস্যের একটি দল নবীগঞ্জ উপজেলার আউশকান্দি বাজারে অবস্থান নেয়। পরদিন সকালে স্থানীয় রাখা দি লার্নিং পয়েন্ট ক্যাডেট স্কুলের প্রধান শিক্ষক কায়সার আহমেদের সার্বিক সহযোগিতায় রাণীকে হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরু হয়।

Advertisement

কে এই রাণী : কখনও নিজের নাম শামীমা মিতু, কখনও আবার সানজিদা সাথী বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন মানসিক ভারসাম্যহীন নারী রাণী (নতুন নাম)। হাসপাতালের ভর্তি স্লিপে তার নাম রাণী রাখা হয়েছে। তাকে ঢাকায় নিয়ে আসা টিমের সর্বসম্মতিক্রমেই এই নাম রাখা হয়েছে।

বাড়ি কোথায় জানতে চাইলে কখনও টাঙ্গাইল, কখনও আব্দুল্লাহপুর ও উত্তরার কথা বলেন রাণী। তবে মানসিক ভারসাম্যহীন এই নারী যে একজন শিক্ষিত এবং সম্ভ্রান্ত পরিবারের সদস্য সেটি বোঝা যায় তার কথা শুনেই। কারও সঙ্গে কথা বলার পর ধন্যবাদ দিতেও ভুলেন না তিনি। আবারও কারও সঙ্গে দেখা হলে শুদ্ধ উচ্চারণে সালাম বিনিময়ের মাধ্যমে লাঞ্চ অথবা ডিনার করেছেন কীনা জানতে চান রাণী। কারও কথা ভালো লাগলে হাততালি দেয়ার পাশাপাশি বলেন থ্যাঙ্ক ইউ। একটু বয়স্ক যারা তাদের আব্বু ও যুবকদের ভাইয়া সম্বোধন করেন তিনি। নিজে কিছু খাওয়ার সময় অন্যের দিকেও বাড়িয়ে দেন তার হাতে থাকা খাবারটি। এসব কারণে রাণী ওই বাজারের সবচেয়ে ভদ্র মানসিক ভারসাম্যহীন নারী হিসেবে পরিচিত।

রাণীকে নিয়মিত খাবার দেয়া ও খোঁজখবর রাখা শিক্ষক কায়সার আহমেদের জানান, রাণী সম্ভবত বদ্ধ পাগল নয়। তার মধ্যে এখনও মানবতা কাজ করে। বাজারের কারও সঙ্গে পাগলামি পর্যন্ত করেন নি তিনি। ক্ষুধা লাগলে যারই কাছে খাবার চেয়েছেন সবাই তাকে ভালোভাবেই দিয়েছেন।

তিনি বলেন, রাণীর ভালোভাবে যত্ন নিলে চিকিৎসা বাদেও তিনি অনেকটা সুস্থ হয়ে যাবেন। কায়সার আহমেদের সেই কথার প্রমাণ পাওয়া গেল নবীগঞ্জ থানা চত্ত্বরে এক নারীর সহযোগিতায় রাণীকে গোসল করানোর পর।

Advertisement

সেখানে রাণী ওই নারীকে বলেছেন, তিন বছর পর তিনি ভালোভাবে গোসল করলেন। গাড়িতে উঠার পর তিনি (রাণী) সবার উদ্দেশ্যে বললেন, দীর্ঘদিন পর আজ আমাকে খুব ফ্রেস লাগছে। মনে হচ্ছে শরীরটা হালকা হয়ে গেছে।

গাড়ি হবিগঞ্জ পার হওয়ার পর এই প্রতিবেদক তার মোবাইলের মাধ্যমে গাড়ির লাউডস্পিকারে আমি যাচ্ছি বাবা, আমি যাচ্ছি গানটি বাজালে, রাণী সাউন্ড বাড়িয়ে দিতে বলেন। সম্পূর্ণ গানটি শোনার পরপরই রাণীর দু'চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি বের হয়ে আসে। আরেকবার গানটি বাজানো যাবে এমন অনুরোধ করে রাণী বললেন, দীর্ঘদিন পর চোখ দিয়ে পানি বের হলো আজ। সেই গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েন রাণী। বিকেল সাড়ে ৫টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত গাড়িতে একটানা ঘুমিয়েছেন তিনি।

রাণীর চিকিৎসার দায়িত্ব নেয়া ব্যাংকার শামীম আহমেদ বলেন, এর আগেও ৪ নারীকে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে তুলেছি। তাদের সুস্থ করতে প্রায় ৩ মাস হাসপাতালে ভর্তি রাখতে হয়েছে। কেন জানি মনে হচ্ছে রাণী তাদের চেয়ে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবে।

শামীম আহমেদ আউশকান্দি বাজারে অনুষ্ঠিত হস্তান্তর অনুষ্ঠানে তার বক্তব্যে বলেন, মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষগুলো ও আমরা একই গ্রহের মানুষ। অথচ কারও স্থান সুন্দর বাড়িতে, আবার কারও স্থান রাস্তায়। আমরা সমাজের প্রতিটি মানুষ যদি একটু উদ্যোগ নেই তাহলে কোনো মানুষকে আর রাস্তায় বা কারও দোকানের সামনে ঘুমাতে হবে না।

তিনি বলেন, আমাদের সমাজে পথশিশু, হিজরা, প্রতিবন্ধী ও বয়স্ক নারী-পুরুষদের নিয়ে অনেকেই কাজ করছেন। অথচ এসব মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষদেকে নিয়ে কেউ কাজ করছেন না। সব কিছু সরকার করবে এমনটাও ভাবা ঠিক না। তাহলে এই সমাজে আমাদের কি কোনো দায়িত্ব নেই, এমন প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে তিনি বলেন, আসুন সবাই মিলে এসব ভারসাম্যহীন মানুষের পাশে দাঁড়াই। তাদের সুস্থ করে স্বজনদের মাঝে ফিরিয়ে দেই।

এমএএস/আরআইপি