শুভ্রার হাতটা অদ্ভুত ধরনের সাদা। মেহেদীর নকশাও হাতের আসল রঙকে আড়াল করতে পারেনি। মুখের রঙের সঙ্গে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যহীন হাত দুটো মনে হয় যেন ওর নিজের নয়। মেকআপের ঝঞ্ঝাটে আজকাল বিয়ের কনের আসল রং বোঝা প্রায় অসম্ভব। ঢাকার পার্লার হলে হাতটাও এমনভাবে সাজিয়ে দিত যে কিছুই বোঝা যেত না। এইসব আধা মফস্বলেও দু’একটা পার্লার আছে কিন্তু তারা যে কেমন তা তো বোঝাই যাচ্ছে।
Advertisement
শুভ্রা খাটের এক কোণে চুপচাপ বসে আছে। গ্রাম্য কায়দায় সাজানো খাটের চেহারা ইমনের খুব একটা ভালো লাগেনি। আসলে গোটা ব্যাপারটাই বিরক্তিকর মনে হচ্ছে ওর কাছে। খুব সেকেলে এবং গেঁয়ো শোনালেও কথাটি আক্ষরিক অর্থেই সত্যি। বিয়ের দিনই প্রথম মেয়েটিকে দেখলো ইমন। ওর মতো আধুনিক ঝকঝকে ছেলেকে যে এমন মধ্যযুগীয় কায়দায় বিয়ে করতে হবে সেটা কিছুদিন আগে হলেও নিজেই বিশ্বাস করতো না। কিন্তু উপায় ছিল না। মাত্র সাত দিনের ছুটি নিয়ে দেশে এসেছে ও। বিয়ে করতেই এসেছে। অথচ এসময় বিয়ের কোন পরিকল্পনাই ছিল না। কথা ছিল সামনের বছর জুন-জুলাইতে দেশে আসবে ঘটা করে বিয়ে হবে স্বাতীর সঙ্গে। প্রায় দশ বছর ধরে এমন একটা স্বপ্নই একটু একটু করে নিজের মধ্যে জমিয়ে তুলেছিল ও। হয়তো স্বাতীর স্বপ্নগুলো ওর চেয়ে খুব বেশি অন্যরকম ছিল না। অন্তত তখন ছিল না যখন ওরা দুজনেই একসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে যৌথ স্বপ্নের নদীতে ভেসে যেত।
সম্পর্কের জটিল বুননে কোথায় কোন সুতোতে টান লেগেছিল কে জানে, স্বাতীর ই-মেইলে তার কোন ইঙ্গিতও ছিল না। ছিল শুধু সংক্ষিপ্ত খবর। তারা আর এক সড়কের যাত্রী নয়। কিন্তু কেন- এ প্রশ্নটা ওর অস্তিত্বকে ওলট পালট করে দিলেও সে কোন ব্যাখ্যা চায়নি। এমনকি মস্তিষ্কে গেঁথে যাওয়া টেলিফোন নম্বরের বোতাম টিপেও আবার থমকে গেছে। সে সময় রীতিমতো জিদ চেপে গিয়েছিল ওর। মাকে শুধু জানিয়ে দিয়েছিল এক মাসের মধ্যে যে কোনভাবে দেশে আসবে এবং বিয়ে করবে। মেয়ে সম্পর্কে শর্ত ছিল একটাই- গায়ের রং হতে হবে শ্যামলা কিংবা কালো। স্বাতীর ফর্সা সুন্দর নির্মম মুখটাকে ভোলার জন্যই তো এত আয়োজন।
আত্মীয়-স্বজন, পরিচিতদের প্রায় সবাই ইমন আর স্বাতীর সম্পর্কে জানে। তাই পরিচিত বলয়ের বাইরে থেকেই ছেলের বউ খুঁজে আনতে চেয়েছিলেন মা। চেয়েছিলেন এমন মেয়ে, যে কোনভাবেই ইমনকে মনে করিয়ে দেবে না স্বাতীর স্মৃতির কোন ভগ্নাবশেষ। দেখতে দেখতে গড়িয়ে যাওয়া এক মাসের মধ্যেই দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের পরিচিত শুভ্রাকে ছেলের বউ হিসেবে মেনে নেয়ার প্রস্তুতি নিলেন রাফিজা রহমান। গ্রামের মেয়ে হলেও শুভ্রা অন্তত ডিগ্রি পাস করেছে এটাই সান্ত্বনা।
Advertisement
শুভ্রার দিকে তাকিয়ে ছিল ইমন। খাটের এক কোণে বেনারসি পরে চুপচাপ বসে থাকা মেয়েটি তার অসম্ভব অচেনা। রাত ক্রমশ গভীর হচ্ছে। বিয়ে বাড়ির হইচই থেমে গেছে বহুক্ষণ। কাল বউ নিয়ে ঢাকায় ফিরতে হবে। একটু ঘুমোতে পারলে ভালো হতো। শুভ্রার সঙ্গে এখনো একটা বাক্যও বিনিময় হয়নি। নতুন বউয়ের সঙ্গে কোন কথা না বলেই ঘুমিয়ে পড়াটা শোভন হবে না। অথচ ইমনের কোন কথাই বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। শুভ্রা নামের তরুণীর প্রতি আগ্রহ, আবেগ, ভালোবাসা কিছুই অনুভব করছে না সে। হঠাৎ ইমনকে চমকে দিয়ে কথা বলে উঠল শুভ্রা। ‘চলেন একটু নদীর পাড় থেকে ঘুরে আসি। যাবেন?’ কথাটা দ্বিতীয়বার শুনে ইমন বুঝলো সে ভুল শোনেনি। রাত দু’টা বাজে। নতুন বউ অন্ধকার রাতে নদীর তীরে বেড়াতে যেতে চাচ্ছে এমন কথা জন্মেও শোনেনি সে। ‘চলেন না। এই তো সামনেই নদী। কেউ জানতে পারবে না।’ ‘তুমি কি পাগল?’ কথাটা না বলে পারলো না ইমন। শুভ্রার সঙ্গে এটাই তার উচ্চারিত প্রথম সংলাপ। শুভ্রা করুণভাবে হাসলো। সেই হাসি খুব জোরে ধাক্কা দেয় বুকের মধ্যে। ইমনের মনে হলো এই মেয়েটি কাল তার জন্মস্থান থেকে চলে যাবে নতুন একটি জায়গায়। যেখানে তার আপনজন কেউ থাকবে না। প্রথমে নতুন একটি বাড়ি। তারপর হয়তো নতুন দেশ। আবার কবে ফিরবে তা জানা নেই। এই মুহূর্তে মেয়েটি যদি তার চিরচেনা নদীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসতে চায়, তাহলে তাকে খুব বেশি দোষ দেয়া যায় কি?
নিঝুম রাত। বিয়ে বাড়ির সারাদিনের খাটুনির পর সবাই ঘুমে বিভোর। উঠোন পেরিয়ে বাড়ির বাইরে আসতেই গা ছমছম করে ওঠে। পূর্ণিমা পার হয়েছে সদ্য। চাঁদের দেহে এখন ভাটার টান। ঝাপসা আলোয় কালো হয়ে ওঠা গাছগুলোও যেন এই জ্যোৎস্নার মতোই রহস্যময়। ইমনের আগে আগে পথ দেখিয়ে হেঁটে যাচ্ছে শুভ্রা। লাল বেনারসি চাঁদের আলোয় অদ্ভুত রং ধরেছে। শুভ্রার সারা দেহে জড়িয়ে থাকা অলংকারগুলো মৃদু শব্দে জানিয়ে দিচ্ছে তাদের অস্তিত্ব। শুভ্রা হাঁটছে। তার পিছু পিছু শাড়ির আঁচল আঁকড়ে ধরে উঁচু নিচু মাটির রাস্তায় অনিশ্চিত পদক্ষেপে হাঁটছে ইমন।
শুভ্রার পেছনে হেঁটে যাচ্ছে ইমন। কত সময় পার হয়ে যাচ্ছে জানা নেই তার। পিছন থেকে শুভ্রাকে অনেকটা স্বাতীর মতো মনে হচ্ছে। দীর্ঘ দশ বছরে যে অসংখ্য প্রতিশ্রুতির ফুলঝুড়ি তারা বিনিময় করেছিল তার অন্যতম ছিল এটিও। কোনো এক জ্যোৎস্না রাতে নদীর তীরে বসে থাকবে তারা সারা রাত। স্বাতীর কি সে সব কথা মনে আছে? কিংবা তার জীবনে এখন নদীর কোনো মূল্যই নেই। শুভ্রা হেঁটে যাচ্ছে অসংখ্য গাছপালা আর বাঁশঝাড়ের মধ্য দিয়ে। একবার পিছন ফিরে ইমনের দিকে তাকিয়ে হাসলো সে। চাঁদের আলোয় তাকে এখন অবিকল স্বাতীর মতোই মনে হচ্ছে। স্বাতী হাসছে। দুধের মতো সাদা হাতে সরাচ্ছে মুখের ওপর উড়ে আসা চুল। মন্ত্রমুগ্ধের মতো ইমন দেখছে সেই ব্যক্তিগত নদীটি, যা দু’জন মিলে দেখার কথা ছিল।
নদীটি বিশাল, রূপালি ঢেউ তোলা। নদীর তীরে বালি ঝকঝক করছে মরা জ্যোৎস্নায়। স্বাতী আর ইমন হাত ধরাধরি করে হাঁটছে জ্যোৎস্নায় ধুয়ে যাওয়া নদীর তীর ধরে। এই নারী স্বাতী না শুভ্রা তা আর বুঝতে পারছে না ইমন। সে শুধু দেখছে ওর অদ্ভুত হাসি, চোখের কাজল, বেনারসি নকশা। ইমন ওকে বলে যাচ্ছে তার দশ বছরের সব স্মৃতি। ইমনের ভেতরে জমে থাকা অভিমানের হিমালয় গলছে একটু একটু করে। স্বাতীর ওপর তার আর কোন ক্ষোভ নেই, অভিমান নেই। চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে নতুন বউয়ের হাতের আংটি। এই আংটিটা কেনা হয়েছিল কয়েক বছর আগে, অনেক মমতায়, স্বাতীর জন্য। এখন শুভ্রার প্রতিও সেই একই তীব্র ভালোবাসা অনুভব করছে ইমন। অথবা এই ভালোবাসা শুভ্রার জন্য নয়। জ্যোৎস্নায় স্নান করা এই নদীকন্যার জন্য।
Advertisement
শেষ রাতের জমাট অন্ধকার। নদীর ভেজা বুক থেকে ইমন যখন ঘরে ফিরল তখন ফজরের আজান ঘোষণা করছে নতুন একটি দিনের সংকেত।
ইমনের নির্ঘুম চোখে ভোরের বাতাস স্নিগ্ধ স্পর্শ বুলিয়ে দিচ্ছে। শুভ্রা ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। ঢাকায় ফেরার তোড়জোড় চলছে বাড়িতে। মাইক্রোতে উঠছে বিয়ের সুটকেস, কাপড় চোপড়ের বাক্স। দিনের আলোয় একবার রাতের নদীর কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার ইচ্ছা করছে ইমনের। মালপত্র গাড়িতে তোলার ফাঁকে মনা মিয়াকে ডেকে ও বললো, ‘চাচা মিয়া একবার নদীর পাড়ে যাওয়া দরকার ছিল। চলেন একটু ঘুরে আসি।’ প্রবীণ লোকটি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে উত্তর দিল, ‘এইহানে নদী পাইবেন কই? আমাগো গেরামে নদী নাই। তিন গেরামে পার হইয়া নদী আছে একটা, তা-ও এই চইত মাসে শুকায়ে গেছে। নদী দেখতে হইলে আপনারে ভাদ্র মাসে আসতে হইব।’
মাইক্রোতে শুভ্রার পাশে বসেছিল ইমন। ওর হাতটা ধরতেই শুভ্রা মৃদুস্বরে বললো, ‘কাল রাতে সেই যে হঠাৎ চলে গেলেন ঘর থেকে, আসলেন ভোরের সময়। আমি কি দোষ করেছি বলেন তো।’
এসইউ/এমএস