মতামত

ভাল নির্বাচনের আশা

আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করতে এবার সব মহলের মতামত গ্রহণ করবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। বিশেষ করে নিবন্ধিত ৪০টি রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি), নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের সাথে পর্যায়ক্রমে সংলাপে বসবে বর্তমান কমিশন। খসড়া রোডম্যাপ অনুযায়ী আগামী জুলাই থেকে সংসদ নির্বাচনের কার্যক্রম শুরু হচ্ছে। 

Advertisement

রাজনীতি বিরোধ বা বিরোধিতার বাস্তবতাকে অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু শুধু দ্বন্দ্বই থাকবে, আর কিছু থাকবে না, জনজীবনের প্রত্যেকটি কর্মকাণ্ডে অহোরাত্র কেবল সংঘাত চলবে, আর কিছু চলবে না— এ কোনো সুস্থতার লক্ষণ নয়।

আগামী নির্বাচন নিয়ে এখনই দেখা যাচ্ছে যে, একটা সংঘাতময় পরিস্থিতির আভাস পাওয়া যাচ্ছে। বিএনপি এর মধ্যেই এই রোডম্যাপ প্রত্যাখ্যান করেছে। কখনো কোন ব্যতিক্রম হয় না। যখনই নির্বাচনের সময় আসে, বিতর্ক হবেই এবং অনেক সময়ই তা সহিংসতায় রূপ নিচ্ছে। এদেশের নাগরিকরা এমনটা দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। রাজনীতি এক নিরন্তর লড়াইয়ে পর্যবসিত হয়েছে। যে কোন ইস্যুতে বিভাজিত থাকার রেওয়াজ কবে চালু হয়েছে কেউ জানেনা, তবে যে বা যারাই কাজটি করেছেন, পরম যত্নে তা বাংলার বুকে লালিত হচ্ছে। 

সাংবিধানিকভাবে নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। কিন্তু আমরা দেখছি, কমিশনের সাথে বিবাদে জড়িয়ে যাচ্ছে বিএনপি। নির্বাচনী কাজে কমিশনই চালকের আসনে থাকবে, সরকার সহায়কের ভূমিকা পালন করবে। সমগ্র আয়োজনটিতে প্রথম হতে শেষ অবধি কমিশনের সাথে সহযোগিতা করা সরকার এবং রাজনৈতিক দল সমূহের দায়িত্ব। কিন্তু বারবারই আমরা দেখছি রাজনৈতিক দলগুলো হয়ে উঠছে কমিশনের প্রতিপক্ষ। 

Advertisement

একজন মানুষ কমিশনের দায়িত্ব নিতে না নিতেই শুরু হয়েছে তাকে আক্রমণ করে বক্তব্য দেয়া। এমন ক্রমাগত আক্রমণের মধ্যে থাকা এসব ব্যক্তিবর্গ শেষ পর্যন্ত কতটা দক্ষতার সাথে কাজ করতে পারবে, সেই ভাবনা কি আছে আমাদের রাজনীতির? 

বিএনপি আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে কি না, সেই প্রশ্নের জবাবই এখন পর্যন্ত পরিষ্কার নয়। বলা হচ্ছে খালেদা জিয়া লন্ডন থেকে ফিরে তাদের আবিষ্কৃত সহায়ক সরকারের রূপরেখা দিবে। ধারণা করা হচ্ছে একটা নির্দলীয় সরকারের ধারণাই থাকবে সেই রূপরেখায়। তবে বিএনপির নিজের অবস্থানও পরিষ্কার নয় বেশ কিছু ইস্যুতে। যেহেতু নির্দলীয়, তত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টি সংবিধান থেকে সরে গেছে, ফলে সেটি আবার কিভাবে ফেরা সম্ভব, তার কোন ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না। সরকার পরিবর্তন, নির্বাচন কমিশন পরিবর্তন নাকি কমিশন রেখেই সহায়ক সরকার খোঁজা, কোনটিই এখন পর্যন্ত নিশ্চিত করেনি দলটি। জোটসঙ্গী জামায়াতের সঙ্গে তাদের বোঝা-পড়াটাই বা কী হবে সে প্রশ্নও উড়ছে রাজনীতির আকাশে।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা ঘোষণা করেছেন, সব দলকে নিয়ে নির্বাচন করাটাই তার লক্ষ্য। কিন্তু এই নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে যে অবস্থান বিএনপি’র এতে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যে একটি জটিল অবস্থায় অনুষ্ঠিত হবে, তার সংকেত পাওয়া যাচ্ছে। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় কার্যত অপ্রাসঙ্গিক হয়ে সড়ক অবরোধ, 'জ্বালাও-পোড়াও' ধরনের জঙ্গি কর্মসূচি নিয়ে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিল বিএনপি। কিন্তু সেখানে সফলতা আসেনি। রাষ্ট্রের সম্পত্তি ধ্বংস, নাশকতা আর মানুষ হত্যা করার মতো কর্মসূচি আবার শুরু হয় কিনা সে আতঙ্কও আছে জনমনে।

এই বাস্তবতাতেই নির্বাচনী রোডম্যাপ দিল কমিশন। রোডম্যাপে উল্লিখিত সাতটি কর্মপরিকল্পনা হল- আইনি কাঠামো পর্যালোচনা ও সংস্কার চলতি জুলাই থেকে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির মধ্যে শেষ করা; নির্বাচন প্রক্রিয়া সহজীকরণ ও যুগোপযোগী করতে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে পরামর্শ ৩১ জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত, সংসদীয় এলাকার নির্বাচনী সীমানা পুনর্নির্ধারণ জুলাই থেকে ডিসেম্বর, নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও সরবরাহ জুলাই থেকে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত, বিধি অনুসারে ভোট কেন্দ্র স্থাপনের কাজ ২০১৮ সালের জুন থেকে তফসিল ঘোষণা পর্যন্ত, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন এবং নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের নিরীক্ষা এ বছরের অক্টোবর থেকে আগামী বছরের মার্চ পর্যন্ত এবং সুষ্ঠু নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট সবার সক্ষমতা বৃদ্ধির কার্যক্রম গ্রহণ ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ভোট গ্রহণের এক সপ্তাহ আগে শেষ করা।

Advertisement

অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কিভাবে তৈরি করা হবে তার ধারণা এখনো স্পষ্ট নয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা বলেছেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করার এখতিয়ার ইসির নেই। নির্বাচনী তফসিলের আগে প্রশাসন কমিশনের অধীনে না আসায় অনেক কিছুই করা যায় না একথা সত্য, কিন্তু নির্বাচন কমিশন অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বাধাগুলো সরকারের কাছে এখন থেকেই তুলে ধরতে শুরু করলে সমস্যা নেই নিশ্চয়ই। 

প্রধান নির্বাচন কমিশনার আশ্বাস দিয়েছিলেন, কমিশন বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলকে আস্থায় আনতে কাজ করবে। এই বক্তব্য আগামী সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করে তোলার বিষয়টির সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। কমিশনের ভাবমূর্তি এবং সাধারণ মানুষের আস্থা ধরে রাখাটা এখন কমিশনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। তবে একথাও মনে রাখতে হবে যে, রাজনৈতিক দলগুলোকেও ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে লাগাতার বক্তব্য দিয়ে, আক্রমণ করে, আঘাত করে একটি ভালো নির্বাচন প্রত্যাশা করা যায় না। একটা ভালো নির্বাচন শুধু নির্বাচন কমিশনের উপর নির্ভর করে না, বহুলাংশে নির্ভর করে রাজনৈতিক সংস্কৃতির উপর।

লেখক : বার্তা পরিচালক, একাত্তর টিভি।

এইচআর/এমএস