মতামত

আমানতকারীর মৃত্যু এবং নমিনি প্রসঙ্গ

২০১৪ সালে অফিস সহকারী জনাব আব্দুল মালেক (ছদ্মনাম) পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে অবসরে যান। জিপিএফ থেকে প্রাপ্ত টাকা দিয়ে তিনি সঞ্চয়পত্র কেনেন। চার ছেলেমেয়ের প্রথম তিন ছেলে অনেক আগে থেকেই নিজেদের সংসার নিয়ে আলাদা থাকে। বাবা আব্দুল মালেক, মা কিংবা কলেজে অধ্যয়নরত ছোট বোনের তেমন একটা খোঁজ তারা নেয় না। যে কারণে আব্দুল মালেক সাহেব সঞ্চয়পত্র কেনার সময়, ছোট মেয়েকে নমিনী হিসেবে মনোনয়ন করেন। সঞ্চয়পত্র কেনার সময় ফরমে নমিনির নাম, বিনিয়োগকারীর সঙ্গে সম্পর্ক, স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা এবং মনোনীত ব্যক্তির স্বাক্ষরও দেয়া হয়েছিল। 

Advertisement

টাকার মালিক আব্দুল মালেক মারা গেলে মেয়ে (নমিনি) ১০০ভাগ সঞ্চয়পত্রের টাকা মুনাফাসহ পাবেন, সেটিও ফরমেও উল্লেখ করেছেন। যেহেতু ছেলেরা তেমন একটা খোঁজ খবর নেয় না, তাই সঞ্চয়পত্রের এই টাকা দিয়ে মেয়ের বিয়ে দেবেন বলে ঠিক করে রেখেছেন। ইদানীং আব্দুল মালেক সাহেবের শরীর তেমন একটা ভালো যাচ্ছে না। এদিকে বিভিন্ন ভাবে তিনি শুনতে পেলেন, আমানতকারী মারা গেলে তার টাকা আইনগতভাবে সকল ওয়ারিশগণের মধ্যে ভাগ হয়ে যাবে। যে ছেলেদের মানুষ করার জন্য আয়ের সকল টাকা ব্যয় করেছেন, অথচ বৃদ্ধ বয়সে তারা কেউই দেখাশুনা করছে না। পেনশনের সামান্য টাকা দিয়েই তিন জনের সংসার চলছে। সঞ্চয়পত্রের সামান্য টাকাগুলো যদি সকল ওয়ারিশগণের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়, তবে ছোট মেয়েটার বিয়ে দেবেন কিভাবে?

মৃত্যুর পর আমানতকৃত অর্থ কে পাবেন বিষয়টা নিয়ে অনেকের মধ্যেই দুশ্চিন্তা কাজ করছে। একই সাথে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে বেশ কিছু অভিযোগ এসেছিল যে,  কিছু কিছু তফশিলী ব্যাংক আমানতকারীর মনোনীত নমিনির কাছ থেকে অঙ্গীকারনামা নিচ্ছে- আমানতকারীর মৃত্যুর পর তার নমিনি মৃত ব্যক্তির হিসাবে রাখা আমানত পাওয়ার যোগ্য বিবেচিত নাও হতে পারেন। সাংসারিক জটিলতা অনেক পরিবারেই বিরাজমান। যে কারণে সাধারণ অনেকের মধ্যেই একটা অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল মৃত্যুর পর প্রাপ্য টাকার বিলি বন্টন নিয়ে। 

যেহেতু বিষয়টি নিয়ে জনসাধারণের মনে দ্বিধার সৃষ্টি হয়েছিল, সেই কারণে গত ১২ জুন, ২০১৭ তারিখ বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগ থেকে একটি সার্কুলার জারি করা হয়। সেখানে আমানতকারীর মৃত্যুর পর তাদের মনোনীত নমিনি/নমিনিগণকে আমানতী অর্থ পরিশোধের ক্ষেত্রে সুস্পষ্টভাবে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে-

Advertisement

১। আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের কাছে রক্ষিত কোন আমানত একক ব্যক্তি বা যৌথভাবে একাধিক ব্যক্তির কাছে জমা থাকলে উক্ত একক আমানতকারী বা যৌথ আমানতকারীগণের সকলের মৃত্যুর পর তাদের মনোনীত ব্যক্তি/ব্যক্তিদেরকে আমানতের টাকা প্রদান করা যাবে। তবে আমানতকারীগণ যে কোন সময় মনোনীত ব্যক্তির মনোনয়ন বাতিলপূর্বক অন্য কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে মনোনীত করতে পারবেন।

২। এছাড়া, মনোনীত নমিনি নাবালক থাকা অবস্থায় একক আমানতকারীর বা যৌথ আমানতকারীগণের মৃত্যুর ক্ষেত্রে আমানতের টাকা কে গ্রহণ করবে সে সম্পর্কে একক আমানতকারী বা যৌথ আমানতকারীগণ নির্দিষ্ট করে দিতে পারেন।  

উপরোক্ত দুটি ধারা ব্যাংক কোম্পানি আইনের ১০৩ ধারার ১ ও ২নং উপধারায়ও বিষয়টি উল্লেখ আছে। একই সাথে ব্যাংক কোম্পানি আইনের উক্ত ধারায় উল্লেখ্য,  ‘আপাততঃ বলবৎ অন্য কোন আইনের বা কোন উইলে বা সম্পত্তি বিলি বণ্টনের ব্যবস্থা সম্বলিত অন্য কোন প্রকার দলিলে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, উপ-ধারা (১) এর অধীনে কোন ব্যক্তিকে মনোনীত করা হইলে বা উপ-ধারা (২) এর অধীন কোন ব্যক্তি নির্দিষ্ট হইলে তিনি একক আমানতকারী বা যৌথ আমানতকারীগণের সকলের মৃত্যুর পর, উক্ত আমানতের ব্যাপারে একক আমানতকারীর বা, ক্ষেত্রমত, সকল আমানতকারীর যাবতীয় অধিকার লাভ করিবেন, এবং অন্য যে কোন ব্যক্তি উক্ত অধিকার হইতে বঞ্চিত হইবেন।’

এই ধারার বিধান অনুযায়ী কোন ব্যাংক-কোম্পানি কর্তৃক টাকা পরিশোধিত হলে সংশ্লিষ্ট আমানত সম্পর্কিত  যাবতীয় দায় পরিশোধ হয়েছে বলে গণ্য হবে। তবে শর্ত থাকে যে, যে ব্যক্তিকে এই ধারার অধীনে আমানতের টাকা পরিশোধ করা হয়েছে সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে অন্য কোন ব্যক্তির কোন অধিকার বা দাবি থাকলে তা এই উপ-ধারার বিধান ক্ষুণ্ন করবে না।

Advertisement

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক জারিকৃত সার্কুলার, ব্যাংক কোম্পানি আইনের ১০২ ধারা ছাড়াও পরিবার সঞ্চয়পত্র নীতিমালা, ২০০৯ (সংশোধিত-২০১৫)-এ বলা হয়েছে, ‘বিনিয়োগকারী এক বা একাধিক ব্যক্তিকে মনোনয়ন প্রদান করিতে পারিবেন এবং বিনিয়োগকারীর মৃত্যুর ক্ষেত্রে এইরূপ মনোনয়ন কার্যকর হইবে। বিনিয়োগকৃত অর্থের সম্পূর্ণ বা অংশবিশেষের জন্য মনোনয়ন করা যাইবে। বিনিয়োগকারী ইচ্ছা করলে যে কোন সময় মনোনয়ন বাতিল বা পরিবর্তন করিতে পারিবেন। বিনিয়োগকারীর পূর্বে মনোনীত ব্যক্তি বা ব্যক্তিগণের মৃত্যু হইলে সংশ্লিষ্ট মৃত ব্যক্তির ক্ষেত্রে উক্ত মনোনয়ন বাতিল বলিয়া গণ্য হইবে।  যথাযথ মনোনয়ন ব্যতিরেকে বিনিয়োগকারী মৃত্যুবরণ করিলে তাহার ওয়ারিশ বা ওয়ারিশগণ তাহার প্রতি প্রযোজ্য পার্সোনাল ল’ অনুযায়ী মুনাফাসহ বিনিয়োগকৃত অর্থ পাইবার অধিকারী হইবেন। বিনিয়োগকারীর মৃত্যুর পর নমিনি বা উত্তরাধিকারী ইচ্ছা করিলে বিনিয়োগকারীর মৃত্যুর তারিখ পর্যন্ত প্রাপ্য টাকা গ্রহণ করিয়া প্রকল্প বন্ধ করিতে পারিবেন অথবা সঞ্চয়পত্রের মেয়াদ পর্যন্ত প্রকল্প চালু রাখিয়া নির্ধারিত হারে মুনাফা উত্তোলন করিতে পারিবেন।’ 

লেখার শুরুতেই অবসরপ্রাপ্ত অফিস সহকারী আব্দুল মালেক সাহেবের কথা বলেছিলাম। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সাম্প্রতিক সময়ে জারিকৃত সার্কুলার পাবার পর এখন তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন। অনেকের কাছেই মনোনীত (নমিনি)  ব্যক্তির অর্থ পাওয়ার বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে গেছে, যা অত্যন্ত ইতিবাচক একটা দিক। 

লেখক : উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।riazul.haque02@gmail.com

এইচআর/এমএস