সাহিত্য

হুমায়ূন আহমেদ আমাদের অনুপ্রেরণা

স্কুলজীবন থেকেই খুব আগ্রহ নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের লেখা পড়তে শুরু করি। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, প্রথম লেখাতেই তাঁকে ভালো লাগতে শুরু করে। তাঁর লেখায় ব্যতিক্রমী কতগুলো মানুষ বা চরিত্র তির্যক বাকভঙ্গিতে আঘাত হানে যাবতীয় কুসংস্কারে। সাহিত্যে এটাও একটা বিপ্লব। এ বিপ্লবের সফল অধিনায়ক নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ।

Advertisement

হুমায়ূন আহমেদকে প্রথম পাই ছোটফুফা হারিজ উদ্দিনের বদৌলতে। ফুফা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তখন আমাদের বাড়ি থাকতেন। তবে রসবোধ চমৎকার। সময় পেলেই বই পড়তেন। তার দেখাদেখি বই পড়ার প্রতি আমারও আগ্রহ বাড়তে থাকে। ফুফার কাছ থেকে ‘ময়ূরাক্ষী’ নিয়ে পড়ি। ময়ূরাক্ষী একটি কল্পিত নদী। চমৎকার অনুভূতি। এই উপন্যাসেই আমরা প্রথম ‘হিমু’ চরিত্রটি পাই। এরপর আরো কতো চরিত্র আমাকে আলোড়িত করেছে।

হুমায়ূন আহমেদের লেখালেখির শুরু থেকে একে একে ‘হিমুর হাতে সাতটি নীল পদ্ম’, ‘আজ হিমুর বিয়ে’, ‘হলুদ হিমু কালো র‌্যাব’, ‘ফার্স্ট বয় সেকেন্ড বয়’, ‘বৃহন্নলা’সহ বেশ কয়েকটি বই পড়েছি। যতবার পড়েছি ততবার বিমোহিত হয়েছি। কী এক দুর্নিবার আকর্ষণে ছুটে গেছি বারবার। একজন মানুষ জীবনকে কত গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারে হুমায়ূন আহমেদকে না পড়লে তা বোঝা মুশকিল। মৃত্যুর আগে তার সর্বশেষ চলচ্চিত্র ‘ঘেঁটুপুত্র কমলা’য় চমৎকার কাজ করেছেন। একটা অজানা ইতিহাস ও বিলুপ্ত সংস্কৃতির উপহার দিয়েছেন দর্শককে। হারানো ইতিহাসের বুক থেকে গ্রামীণ সংস্কৃতি তুলে এনে নান্দনিকতার সঙ্গে নাট্যরূপ দিয়ে চমকে দিয়েছেন আমাদের। শৌখিন মানুষের ভোগবিলাস ও ঘেঁটুপুত্রের প্রতি তাদের আসক্তি টেনে নিয়ে গেছে কাহিনির শেষ প্রান্তে।

হুমায়ূন আহমেদ বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির আকাশে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। শেষ নিশ্বাস অবধি যিনি রেখে গেছেন সফলতার স্বাক্ষর। সাহিত্য, নাটক, সংগীত ও চলচ্চিত্রে যার অসামান্য অবদান। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দুই হাতে অর্থ উপার্জন করেছেন। চল্লিশ একর জমি নিয়ে গড়ে তুলেছেন স্বপ্নের ‘নুহাশপল্লী’। রুচিবোধ আর রসাল মানসিকতার অপূর্ব সমন্বয়। তিনি হয়ে উঠেছেন আমাদের অনুকরণীয় আদর্শ। পাঠক সমাজের এমন কেউ নেই; যিনি হুমায়ূন আহমেদের লেখা পড়েননি।

Advertisement

ব্যক্তি হুমায়ূন আহমেদ একসময়ের অভাবকে জয় করেছেন দৃঢ়তা ও নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে। ছাত্রজীবনেই ‘নিষিদ্ধ নরকে’র ভেতর থেকে তুলে এনেছেন স্বর্গের অপরিমেয় সুখ। সবশেষে চলচ্চিত্র ‘ঘেঁটুপুত্র কমলা’র সফলতার মধ্যদিয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন আমাদের ধ্যান-জ্ঞান ও চিন্তা-চেতনায়। রাজনৈতিক উপন্যাস ‘দেয়াল’ রচনার মধ্যদিয়ে হয়তো সাহিত্যের মাঝখানে সমাপ্তির দেয়াল তুলে রেখে গেছেন। কারা এ দেয়াল ভাঙতে পারবে আমার জানা নেই। এমন আলোকিত সূর্য বাংলার সাহিত্য আকাশে আর উদিত হবে কিনা— তা এখন প্রশ্নের বিষয়।

হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন দুই হাতে। প্রতিবছর বইমেলা এলে উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা যেত তার বইয়ের প্রচ্ছদের ওপর। জনপ্রিয়তার শীর্ষে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার পেশাটাকেও ছেড়ে দিয়েছিলেন লেখালেখি, নাটক আর চলচ্চিত্র নির্মাণে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কাজ যতগুলোই করেছেন অভাবনীয় সফলতা এসেছে। উপন্যাসে হয়ে উঠলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। চলচ্চিত্র নির্মাণে নিয়ে এলেন ভিন্ন স্বাদ ও আমেজ। টিভি নাটকের বাঁক পরিবর্তন করে দর্শকদের মুখ ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন অন্য জগতে। ‘বাকের ভাই’র জন্য দর্শকদের রাস্তায় নেমে মিছিল করার ব্যাপারটা কেবল তার নাটকের কারণেই সম্ভব হয়ে উঠেছিল। দর্শক ভুলেই গিয়েছিল যে বাকের ভাই নাটকের একটি চরিত্রমাত্র। তারা ধরে নিয়েছিল বাকের ভাই এ সমাজেরই একজন জীবন্ত প্রতিনিধি। নাটকের চরিত্রকে কীভাবে প্রাণবন্ত করতে হয়, তা দেখিয়েছেন নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদ। তার উপন্যাসের মিসির আলি ও হিমু পাঠকের অন্তরে দাগ কেটে যায় আজীবন।

‘যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো এক বরষায়’ কিংবা ‘একটা ছিল সোনার কন্যা মেঘবরণ কেশ’- এর মতো হৃদয়কাড়া সুললিত সুর কেবল হুমায়ূন আহমেদের কারণেই সম্ভব হয়েছে। সুরের মূর্ছনায় যেমন মাতিয়েছেন; তেমন তির্যক ধারালো ফলা হাতেও আবির্ভূত হয়েছেন বাংলা সাহিত্যে। হাস্যরসাত্মক ভঙ্গিতে আঘাত হেনেছেন অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে। ‘আগুনের পরশমণি’ দিয়ে শুদ্ধ করেছেন জাতির অন্তর। ‘শ্রাবণ মেঘের দিনে’ ঘুরে এসেছেন ‘দারুচিনি দ্বীপ’। কিংবা উদাত্ত কণ্ঠে জানিয়েছেন ‘আমার আছে জল’।

মূলত শিল্পী মানেই স্রষ্টা। শিল্পী মানেই দায়িত্বশীল। হুমায়ূন আহমেদ শিল্পী। হুমায়ূন আহমেদ স্রষ্টা। হুমায়ূন আহমেদ দায়িত্বশীল। তিনি দায়িত্বশীল বলেই বেঁচে আছেন মানুষের মাঝে। বেঁচে আছেন শিল্পকর্মে। বেঁচে আছেন তার সৃষ্ট চরিত্র, দায়িত্ব ও কর্তব্যে। তবে শিল্পী হুমায়ূন ও ব্যক্তি হুমায়ূনকে কখনো আমরা এক করে দেখতে চাই না। তিনি আমাদের হাসিয়েছেন, হাসাতে হাসাতে কাঁদিয়েছেন, দুঃখের সাগরে ভাসিয়েছেন, ভাসাতে ভাসাতে তীরের সন্ধান দিয়েছেন। এটা কেবল তার দ্বারাই সম্ভব। তির্যকভাবে নির্মম সত্যগুলো হাসতে হাসতে উপস্থাপন করেছেন। পাঠককে বা দর্শককে নিজের অজান্তেই নিয়ে গেছেন ভাবনার অতলে।

Advertisement

জন্মই যার আজন্ম শিল্পের তাগিদে। মরণেও তার ক্ষয় নেই। তিনি আছেন থাকবেন। তিনি বেঁচে আছেন বাংলার ঘরে ঘরে। ছড়িয়ে আছেন দেশের সীমানা পেরিয়ে অসীম আকাশে। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির পিচ্ছিল এ জগতে ধৈর্য, প্রজ্ঞা ও সৃষ্টিশীলতা দিয়ে টিকে রইলেন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। দুহাতে গড়েছেন সম্পত্তি। রেখে গেছেন সম্পদ।

হুমায়ূন আহমেদের নুহাশপল্লী তার ভক্তদের জন্য তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতে তিনি হয়তো ব্যতিক্রম, যাকে শেষ পর্যন্ত অভাব-অনটন স্পর্শ করতে পারেনি। বরং তিনি অভাবকে জয় করেছেন। মানুষকে খুঁজে খুঁজে এনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তার সিনেমা-নাটকে কাজ করে অনেকেই তারকাখ্যাতি অর্জন করেছেন। মিডিয়াঙ্গনে এখনো টিকে আছেন শুধু হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টি বলে।

একটা মানুষ একসঙ্গে এত কাজ কীভাবে করেন? তা ভাবিয়ে তোলে সমালোচকদের। বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্যের একচ্ছত্র অধিপতি, মহীরুহখ্যাত এ মহান ব্যক্তি সম্পর্কে অনেক কথাই বলা সম্ভব। কী তার চলনে, কী তার বলনে, ব্যবহারে, চিন্তায়, চেতনায়, কর্মে প্রবলভাবে প্রভাব বিস্তার করে প্রত্যেকটি মানুষের জীবনে। সীমাহীন দারিদ্র্য, পিতৃহারা সংসার আগলে রেখে নিজের পাশাপাশি ভাইদের সুপ্রতিষ্ঠিত করা তার দ্বারাই সম্ভব। মায়ের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা, টান ও ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটে তার জীবন দর্শনে।

আসলে তিনি তো তিনিই। কারো সঙ্গে তিনি তুল্য নন। তিনি আমাদের আদর্শ। আমাদের অনুপ্রেরণা; আমাদের পাথেয়। চলার শক্তি। চিন্তার উৎস। ধ্যান-জ্ঞানের অপার আধার। তিনি ফিরে ফিরে আসেন, ফিরে ফিরে আসবেন। তার অশরীরী আত্মার অস্তিত্ব টের পাই বইমেলায়, নুহাশপল্লীর নির্জন বাগানের জোছনা রাতের অবগাহনে। তাকে খুঁজে পাই বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণে। প্রিয় কোনো বারান্দায়। গাঁয়ের মেঠোপথে, নদীর তীর ঘেঁষে ফুটে থাকা কাশফুলের থোকায় থোকায়।

তিনি আছেন, তিনি থাকবেন। তিনি স্রষ্টা, স্রষ্টারা অন্তিম প্রলয়ের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত টিকে থাকেন। তিনিও থাকবেন। তাঁর সৃষ্টি যতদিন থাকবে। তিনি থাকবেন, তাঁর কর্ম যতদিন থাকবে। যেখানে তিনি আছেন, আমার বিশ্বাস সুখেই আছেন। সুখেই থাকবেন। যদি কখনো মনে পড়ে যায় আমাদের— তুমি চলে এসো। তাঁকে বলবো, ‘যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো।’ আমরা তোমাকে বরণ করে নেব পরম আদরে। তুমি ছাড়া আমরাও শূন্য।

এসইউ/জেআইএম