বিনোদন

হুমায়ূন আহমেদ বলতেন আমার সুরে মধু ঝরে : বারী সিদ্দিকী

বিশ্ব বরেণ্য বংশীবাদক বারী সিদ্দিকী। দেশ বিদেশে তিনি বাঁশি হাতে ঘুরে বেড়িয়েছেন। বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন সম্মানের সঙ্গে। বাঁশিতে তার এমনই জাদু, আচ্ছন্ন হয়ে থাকেন শ্রোতারা। কিন্তু এই বংশীবাদক একদিন গান গেয়েও শ্রোতাদের মন ভরাবেন সেটা হুমায়ূন আহমেদ না থাকলে হয়তো অজানাই থেকে যেত। প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকীতে তার স্মরণে বলতে গিয়ে তাই জানালেন বারী সিদ্দিকী।

Advertisement

তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি গান করতাম একান্তই নিজের জন্য। কোনোদিন গায়ক হবো এমন ভাবনা আমার ছিলো না। সবাই আমাকে বংশীবাদক হিসেবে চিনতেন। হুমায়ূন আহমেদের ছবি ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’-এ বাঁশি বাজাতে গিয়েই গায়ক হয়ে ওঠা। এবং সেটা তার জোরাজুরিতেই। ১৯৯৫ সালের দিকে হুমায়ূন সাহেবের একটি অনুষ্ঠানে সরাসরি গান করেছিলাম। সেটা উনার খুব মনে ধরেছিলো।

সেজন্য বারবার বলছিলেন ‌‌‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ ছবিতে আমাকে গাইতে হবে। আমি না করছিলাম। একপর্যায়ে তিনি বলে ওঠলেন আপনি গান না গাইলে সব রেকর্ড আমি বাতিল করে দেব। বাধ্য হয়েই গাইলাম। সেখানেই আমার প্রথম গানের রেকর্ড হয়। বাকীটুকু ইতিহাস।’

তিনি আরও বলেন, ‘হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে আমার খুব বেশি সখ্যতা ছিলো এ কথা বলবো না। উনাকে কাজের সূত্রেই দেখতে পেতাম। অদ্ভূত একটা মানুষ ছিলেন। জোছনা, বর্ষার প্রতি ছিলো তার পাগলামি টাইপের আকর্ষণ। কখনো মুখে অতো বেশি কথা বলতেন না। পাণ্ডিত্য জাহির করতেন না। এই জোছনা, বর্ষা, প্রকৃতি নিয়ে এতো ভালোবাসা ছিলো তাও কোনোদিন উগ্রভাবে কারো সামনে প্রকাশ করতেন না।

Advertisement

দেখতে পেতাম, সবাই মিলে খুব সিরিয়াস মুডে কাজ করছি এমন সময় বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। হঠাৎ দেখি হুমায়ূন সাহেব নেই। তিনি চলে গেছেন বৃষ্টিতে ভিজতে। দেখুন, অনেক সাহিত্যিকরাই বর্ষা নিয়ে লিখেছেন। কিন্তু উনার মতো করে কেউ বর্ষাবিলাসিতাকে উৎসব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি। প্রবল জোছনা রাতেও তিনি বাইরে বসে থাকতেন।’

বারী সিদ্দিকী হুমায়ূন আহমেদ ম্মরণে বলেন, ‘হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন দারুণ একজন সমালোচক। এবং তার সবচেয়ে বড় একটি গুণ ছিলো নিজের কাজগুলোকে তিনি অন্যের কাজের মতোই সমালোচনা করতে পারতেন। সাধারণত, কেউ নিজের কাজের খুঁত ধরতে পারেন না। তিনি পারতেন। কোনো একটা গান লেখার সময় সেটা বারবার পরিবর্তন করতেন যতোক্ষণ নিজের মনের মতো না হয়েছে। গান হয়তো রেকর্ড করা শেষ। একদিন পর হঠাৎ এসে তিনি বলতেন, ‘এই জায়গাটায় একটু চেঞ্জ করে দেন।’ এজন্যই তার কাজগুলো এতো নিখুঁত হতো।

এমনও হয়েছে উনাকে নিয়ে সারারাত কোনো গানের সুর করলাম, গানের রিহার্সেল করলাম সকালে যাবার সময় বললেন, ‘গানটা ভালো হয়নি। নতুন আরেকটা সুর করেন।’ অথচ রাতভর তিনি গানের সুর ও গায়কী নিয়ে বাহবা দিয়েছেন। আমিও কখনো তার কথার অমত করিনি। কারণ আমি জানতাম উনি আমাকে সম্মান করেন। আমার কাজগুলোকে অন্যভাবে দেখেন। তিনি বলতেন আমার সুর-গায়কীতে মধু ঝড়ে। তিনি গানের সমঝদার ছিলেন। সেজন্য তার কথা মেনে আবার নতুন সুর করতাম।’

হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে বারী সিদ্দিকী বলেন, ‘হুমায়ূন আহমেদ নিজের কাজেই যখন শতবার ভুল ধরতেন তো ভাবুন অন্যের কাজে কেমন করতেন। কোনো একটা গান রেডি হচ্ছে, সেটা শোনে সবাই বলছে দারুণ, অসাধারণ। কিন্তু তিনি বলতেন এটা ভালো হয়নি। অন্য কিছু হতে হবে। আবার আমি নিজের মনে কোনো একটা গান এমনি এমনি গাইছি তিনি সেটা শোনে আনন্দে নেচে উঠতেন। বলতেন- এটা দারুণ হয়েছে।’

Advertisement

বর্তমান প্রজন্মের গান নিয়ে বারী সিদ্দিকী বলেন, ‘এখন কেউ শিখতে চায় না। গান হয়ে গেছে টাকা আর তারকাখ্যাতির মেশিন। গুনগুন করে যা তা গাইছে আর ভিডিও ফুটেজ আনছে, হয়ে যাচ্ছে গানের মানুষ। কিন্তু কেউ টিকে থাকতে পারছে না। ইন্ডাস্ট্রি খুব খারাপ সময় পার করছে। গানের ভিত মজবুত না করে শিল্পীরা প্রাধান্য পেলে এর পরিবর্তন হবে না। চটকদারি বা মশলাদার গান দিয়ে কেউ অমরত্ব পায় না।’

নিজে একজন যন্ত্র সংগীতশিল্পী। এই দেশে যন্ত্র সংগীত শিল্পীদের মূল্যায়ণ নিয়ে তিনি বলেন, ‘যন্ত্র সংগীতশিল্পীরা শুধু এই প্রজন্মে নয়, আরও অনেক আগে থেকেই অবমূল্যায়িত। এখানে উৎসাহব্যাঞ্জক কিছু নেই বলে কেউ আগ্রহ পায় না। একজন যন্ত্রশিল্পীকে কয়জনে চেনে? তার পারিশ্রমিক কতো কেউ অনুমান করতে পারবে? গানের আঙ্গিনায় যন্ত্রশিল্পীরা হয়ে গেছে ভাড়াটে লোক।

এজন্যই এই মাধ্যমের খুব বেশি বিকাশ হয়নি। আমাদের ঐতিহ্যবাহী অনেক যন্ত্রের ব্যবহারও কমে গেছে। কিছু কিছু তো প্রায় বিলুপ্ত। এ নিয়ে আমাদের মনযোগী হওয়া উচিত। আধুনিকতার হাত ধরে প্রযুক্তি আসবেই, তাই বলে যার উপর ভিত্তি করে এতদূর এসেছে আমাদের সংগীত, তাকে অবহেলার সুযোগ নেই।’

আজকের দিনে হুমায়ূন আহমেদের বিদেহি আত্মার মাগফেরাত কামনা করে বারী সিদ্দিকী বলেন, ‘তার মতো সৃষ্টিশীল মানুষ কয়েক যুগে একবার আসেন। তার সৃষ্টির প্রতি সবার সম্মান রাখা উচিত।’

এলএ