শিশু গৃহকর্মী আদুরিকে (১১) নির্যাতন করে মৃত ভেবে ডাস্টবিনে ফেলে দেয়ার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় গৃহকর্ত্রী নওরীন জাহান নদীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একইসঙ্গে তাকে ১ লাখ টাকা অর্থদণ্ড প্রদান করা হয়েছে। এই টাকা পাবেন আদুরি। গৃহকর্মী নির্যাতন বন্ধে এই রায় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এখনো অনেকগুলো আইনি ধাপ বাকি আছে। শেষ পর্যন্ত গৃহকর্মী নির্যাতনের সাজা যাতে বহাল থাকে এবং কার্যকর হয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সেটি নিশ্চিত করতে হবে।
Advertisement
ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুন্যাল-৩ এর বিচারক জয়শ্রী সমদ্দার গতকাল মঙ্গলবার এ রায় ঘোষণা করেন। মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, ২০১৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় রাজধানীর বারিধারা ও ডিওএইচএস তেলের ডিপোর মাঝামাঝি রেললাইন সংলগ্ন একটি ডাস্টবিনের পাশ থেকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয় কঙ্কালসার ও মৃতপ্রায় গৃহকর্মী আদুরিকে। উদ্ধারের সময় তার শরীরে অসংখ্য নির্যাতনের চিহ্ন ছিল। মারধর, গরম খুন্তি ও ইস্ত্রির ছ্যাঁকা, ব্লেড দিয়ে শরীরে আঘাত, মাথায় কোপ, খেতে না দেওয়া- কিছুই বাদ যায়নি নির্যাতনের তালিকা থেকে।
প্রায় দেড় মাস আদুরিকে চিকিৎসা দেয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সুস্থ অবস্থায় যখন তাকে রিলিজ দেয়া হয় তখনও সে ভালোভাবে কথা বলতে পারত না। শরীর প্রচণ্ড দুর্বল ছিল। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে ওই বছরের ৭ নভেম্বর পটুয়াখালী জেলার জৈনকাঠি ইউনিয়নের নিজ গ্রামে ফিরে যায় আদুরি। ওই ঘটনায় ২৬ সেপ্টেম্বর পল্লবী থানায় নওরীন জাহান নদী, তার স্বামী সাইফুল ইসলাম মাসুদ, মাসুদের দুলাভাই চুন্নু মীর ও তাদের আত্মীয় রনিকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়। তবে পুলিশি তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় চার্জশিট থেকে মাসুদ, চুন্নু মীর ও রনির নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া তদন্তে নদীর মা ইসরাত জাহানের সম্পৃক্ততা পাওয়ায় নতুন করে তাকে আসামি করা হয়। মামলার পর ২৬ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার করা হয় নদীকে। সেই থেকে নদী কারাগারে আছেন।
আমাদের দেশে গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনা নতুন নয়। কিন্তু সমাজের প্রভাবশালীরা এর সাথে জড়িত থাকায় নির্যাতনের ঘটনায় শাস্তি হওয়ার নজির খুব একটা নেই। অথচ অপরাধীর শাস্তি না হলে সে অপরাধের পুনরাবৃত্তি হতেই থাকে। গৃহকর্মী নির্যাতন বন্ধে তাই নির্যাতকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া জরুরি। পাশাপাশি গৃহকর্মী নির্যাতনের আর যেসব মামলা রয়েছে সেগুলোরও নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন। রাজধানীর মিরপুরে শিশু সাবিনাকে নির্যাতনের দায়ে গৃহকত্রীর বিরুদ্ধে সম্প্রতি মামলা হয়েছে। এই মামলারও কোনো অগ্রগতি নেই। সামান্য ডিম পোচ করতে না পারায় শিশু সাবিনাকে খুন্তির ছ্যাকা দিয়ে নির্যাতন করা হয়। দুঃখজনক হচ্ছে সমাজের প্রভাবশালী ও সচেতন অংশ দ্বারাও গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। এটি বন্ধ হওয়া উচিত।
Advertisement
সরকার ২০১৫ সালের ২১ ডিসেম্বর গৃহকর্মকে ‘শ্রম’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি-২০১৫’-এর খসড়া অনুমোদন করে। এই নীতিমালা অনুমোদন পাওয়ায় শ্রম আইন অনুযায়ী গৃহকর্মীরা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পাবেন এমনটি বলা হয়। গৃহকর্মীদের নির্যাতন করলে প্রচলিত আইন অনুযায়ী সরকার ব্যবস্থা নেবে- এমন কথাও বলা হয়েছে নীতিমালায়। দুঃখজনক হচ্ছে যে, নীতিমালা প্রণয়নের পর গৃহকর্মীদের ব্যাপারে একটি শৃঙ্খলা ফিরে আসবে-এমনটি আশা করা হলেও বাস্তবে তা হয়নি। কিন্তু দিনের পর দিন এ অবস্থা চলতে পারে না। গৃহকর্মী নির্যাতনকারীর কঠোর সাজা হওয়া প্রয়োজন। নইলে ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকবে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে মানবিকতার উন্মেষ ঘটিয়ে গৃহকর্মীদের অধিকার রক্ষায় স্বয়ং নিয়োগকর্তাকেই বড় ভূমিকা পালন করতে হবে। তবেই গৃহকর্মীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা পাবে। শিশু গৃহকর্মী আদুরিকে নির্যাতন মামলায় রায়ে গৃহকত্রীর যাবজ্জীবন সাজা সমাজে একটি বার্তা দিবে বলে আমরা আশাবাদী।
এইচআর/আরআইপি