সোমবার ভয়াল ২৫ মে। ২০০৯ সালের ২৫ মে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ও ঘুর্ণিঝড়ের প্রভাবে সৃষ্ট সর্বনাশা আইলা আঘাত হানে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় জনপদে। মূহুর্তেই লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় সাতক্ষীরার শ্যামনগর, আশাশুনি উপজেলার উপকূলবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকা। স্বাভাবিকের চেয়ে ১৪-১৫ ফুট উচ্চতায় সমুদ্রের পানি ক্ষণিকের মধ্যে গৃহহীন করে দেয় লাখো পরিবারকে।নারী, পুরুষ, শিশুসহ ৭৩ জন নিহত হন। আহত হন দুই শতাধিক মানুষ। হাজার হাজার গবাদি পশুসহ ঘরবাড়ি ভেসে যায়। ভেসে যায় লক্ষ লক্ষ হেক্টর চিংড়ি ঘের আর ফসলের ক্ষেত। ধ্বংস হয়ে যায় উপকূল রক্ষা বাধ আর অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা, পদ্মপুকুর ও আশাশুনির প্রতাপনগর এলাকায় মানুষের হাহাকার থামেনি। দু`মুঠো ভাতের জন্য রীতিমতো লড়াই করতে হয় তাদের। সৃষ্টি হয়নি পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ। এখানে রয়েছে সুপেয় খাবার পানির তীব্র সঙ্কট। মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হয় এসব এলাকার মানুষদের। সংস্কার হয়নি রাস্তাঘাট। কর্মস্থানের সুযোগ না থাকায় এলাকা ছেড়ে কাজের সন্ধানে অন্যত্র চলে গেছেন অনেকে। প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম সংখ্যক সাইক্লোন সেন্টার নির্মিত হয়েছে।ভয়াবহ এ দুর্যোগে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ও পদ্মপুকুর ইউনিয়ন। ৪ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে পদ্মপুকুর ইউনিয়নের ঠাকরুনতলা সড়কটি ধসে পড়ে। ধসে পড়ে গড়কুমারপুর রাস্তাটিও। আইলার ৬ বছর পেরিয়ে গেলেও এ রাস্তা দু’টি মেরামত না হওয়ায় চাউলখালী গ্রাম ও কালিতলা গুচ্ছগ্রামের দুই শতাধিক পরিবার আজো জনবিচ্ছিন্ন। নৌকাই তাদের একমাত্র ভরসা।অপরদিকে, বনদস্যুদের অত্যাচারে সুন্দরবন, কপোতাক্ষ ও খোলপেটুয়া নদীর উপর নির্ভরশীল এ এলাকার মানুষের জীবনযাপন দুর্বিসহ হয়ে পড়েছে। ফলে বিকল্প কর্মসংস্থানের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারছেন না উপকূলীয় এ জনপদের প্রায় ৮০ হাজার মানুষ। আইলার পরপরই কিছু সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে কাজের বিনিময়ে খাদ্য প্রকল্পের কাজ হলেও এখন আর কোনো কাজ হচ্ছে না। আর এ কারণেই ক্রমে ক্রমে বাড়ছে দরিদ্র ও হত দরিদ্রের সংখ্যা বলে জানালেন, গাবুরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জিএম মাসুদুল আলম মাসুদ।তিনি আরও জানান, দুর্গত এলাকা এখনো নানা সমস্যায় জর্জরিত। খাবার পানির তীব্র সঙ্কট। আইলায় মিষ্টি পানির আধারগুলো সব নষ্ট হয়ে গেছে। আজো পুকুর বা জলাশয় খনন করে মিষ্টি পানি সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এলাকায় কাজ নেই। বেড়িবাধ দিয়ে নদীর লোনা পানি চিংড়ি ঘেরে উঠতে দেয়া হচ্ছে না। বিধায় চিংড়ি চাষো হচ্ছে না।শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবু সায়েদ মো. মনজুর আলম খাবার পানির সঙ্কট ও বাধ ভাঙন আতঙ্কের কথা স্বীকার করে জাগো নিউজকে জানান, ১৯৬০ সালের বাধ নির্মাণের পর থেকে উপকূলীয় অঞ্চলের এসব বাধগুলো সংস্কার বা রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাবস্থা করা হয়নি। এ বাধের জন্য আমরাও ভয়ে থাকি আবার কখন ভেঙে যায়! আর বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) মাধ্যমে সুপেয় খাবার পানির সঙ্কট দূর করার চেষ্টা করছি। তারপরও অনেক সমস্যা থেকে যায়।এনজিও সংস্থার প্রকল্প ক্যাশ ফর ওয়ার্কের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থ বাধ দ্রুত সংস্কারের জন্য সরকার ইউনিয়ন বা উপজেলা পরিষদকে একটি থোক বরাদ্দ প্রদানের জন্য ইতোমধ্যে একটি প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে।সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক নাজমুল আহসান জাগো নিউজকে জানান, বেড়িবাঁধ, সুপেয় পানিসহ যেসব সমস্যা রয়েছে তা সমাধানের জন্য সরকার ও বেসরকারি সংস্থার যৌথ প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। বাধগুলো স্থায়ীভাবে সংস্কারের জন্য ইতোমধ্যে ঊর্ধ্বতন মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।অন্যদিকে, সরকারের কাছে টেকসই উপকূল রক্ষা বাধ নির্মাণ, সুপেয় খাবার পানির সঙ্কট দূর করা ও কর্মস্থানের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে আতঙ্কমুক্ত স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরিয়ে আনার দাবি এ অঞ্চলের মানুষের।এমজেড/আরআই
Advertisement