সাগর পথে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় নিখোঁজ হয়েছেন হবিগঞ্জের ২৪ যুবক। তাদের কয়েকজন থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ার কারাগারে আটক রয়েছেন বলেও খবর প্রচার হয়েছে। তবে এখনো তাদের পরিবার নিশ্চিত নয় আদৌ তারা বেঁচে আছেন কি না! কার ভাগ্যে কি ঘটেছে তারো নিশ্চিত খবর কারো জানা নেই।দিনের পর দিন পেরিয়ে গেলেও কারো সঙ্গে যোগাযোগও করতে পারছেন না পরিবারের সদস্যরা। এ অবস্থায় তাদের প্রতিটি পরিবারেই এখন শুধুই শোকের মাতম চলছে। অনেকেরই বৃদ্ধ মা-বাবা শোকে পাথর হয়ে গেছেন। কারো কারো পরিবারের সদস্যরা দিন কাটাচ্ছেন অনাহারে, অর্ধাহারে।খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বানিয়াচং, আজমিরীগঞ্জ ও চুনারুঘাট উপজেলার অজপাড়াগাঁকে নিজেদের ব্যবসার জন্য নিরাপদ হিসেবে বেছে নিয়েছেন দালাল চক্র। তারা এসব এলাকায় সম্প্রতি সক্রিয় হয়ে উঠেন। দরিদ্র পরিবারগুলোর সন্তানদের সহজে প্রলোভনে ফেলা সম্ভব বলেই তারা এমন কৌশল অবলম্বন করেন। অল্প খরচে বিদেশ গিয়ে অধিক আয় ও উন্নত জীবন-যাপন করার প্রলোভন দেখান দালাল চক্র। তাদের মিষ্টি কথায় সহজেই বিশ্বাস স্থাপন করেন গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র পরিবারগুলো।এ সুযোগে বানিয়াচং, আজমিরীগঞ্জ ও চুনারুঘাট উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের অন্তত ২৪ জন যুবককে তারা বাগে আনতে সক্ষম হন। প্রত্যেকের কাছ থেকেই বিভিন্ন সময় চাপ দিয়ে ২ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করে নিয়েছেন। এসব দালালদের সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছেন চুনারুঘাট উপজেলার বালা সীমান্তের টেকেরঘাট গ্রামের আব্দুল গনির ছেলে হিরাই (বর্তমানে মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছেন), বাচ্চু, মঞ্জব আলীর ছেলে মাসুক, আব্দুল আলী, মৃত সুরুজ আলীর ছেলে জিয়া উদ্দিন, আব্দুন নুর ওরফে কন্টই মোল্লার ছেলে আব্দুল কাদির।বানিয়াচং ও আজমিরীগঞ্জে রয়েছে শিবপাশার ইউপি মেম্বর আব্দুল আজিজ। নিখোঁজদের মধ্যে বানিয়াচংয়ের ২, আজমিরীগঞ্জের ২ ও চুনারুঘাটের ২০ জনের নিখোঁজের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এদিকে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে সম্প্রতি গণকবরের সন্ধান পাওয়ার পর থেকে এসব দালাল গা ঢাকা দেন। তাদেরও কোন সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না।পুত্র শোকে পাথর চুনারুঘাট উপজেলার গাজীপুর ইউনিয়নের দিঘীরপাড় গ্রামের অভিবাসন প্রত্যাশি নিখোঁজ জসিমের বাবা আব্দুল হাই জানান, তার ছেলেকে জিম্মি অবস্থায় রেখে নির্যাতন করেন স্থানীয় টেকেরঘাট গ্রামের দালাল বাচ্চু ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা। ইতোমধ্যেই তারা ৫ লাখ টাকা আদায় করে নিয়েছেন। তিনি সর্বস্ব বিক্রি করে এসব টাকা দিয়েছেন। কিন্তু তার পরও সন্তানের কোন খোঁজ না পেয়ে এখন তিনি পাগলপ্রায়।আরেক নিখোঁজ যুবক আজমিরীগঞ্জ উপজেলার শিবপাশা ইউনিয়নের পশ্চিমভাগের তিনকোশা মহলার মৃত নিহার মনির চৌধুরীর ছেলে নোমান চৌধুরী। ৬ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। বাবার মৃত্যুর পর তিনি স্থানীয় বাজারে ব্যবসা করে পরিবার চালাতেন। সম্প্রতি দালালদের মাধ্যমে কম খরচে বিদেশ যাওয়ার প্রস্তাব পান। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি সিদ্ধান্ত নেন বিদেশ গিয়ে পরিবারের আরো উন্নতি করবেন। আরও বেশি টাকা রোজগার করবনি। এমন চিন্তা থেকেই তার নৌপথে মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা। কিন্তু প্রায় ২ মাস অতিবাহিত হলেও তার ভাগ্যে কী ঘটেছে তা তার পরিবার জানেন না। একদিনো তার সঙ্গে পরিবারের যোগাযোগ হয়নি। এ কথা জানিয়েছেন তার ছোট ভাই উমান চৌধুরী।তিনি বলেন, পশ্চিমভাগের গোপী চন্দ্র চন্দ ও নোমান ভাই মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে ৫৩ দিন পূর্বে রওয়ানা হন। তারা এখন হয়তো সাগরে জাহাজে অথবা নৌকায় আটক রয়েছেন। পশ্চিমভাগের অলিউরও তাদের সঙ্গে মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম পর্যন্ত গিয়েছিলেন। সেখান থেকে কৌশলে তিনি পালিয়ে বাড়িতে ফিরে আসেন। আজ পর্যন্ত তার ভাইয়ের কোন খোঁজ পাননি। দালালের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। ভাই না থাকায় নিজেরা মারাত্মক অর্থ কষ্টে পড়েছেন বলেও তিনি দাবি করেন।আরেক নিখোঁজ বানিয়াচং উপজেলা সদরের শরীফ উদ্দিন রোডের রশিদ আহমদের ছেলে সাইফুল ইসলাম জুসেদ (২৭)। শোকে পাথর বাবা রশিদ আহমদ জাগো নিউজকে জানান, প্রাপ্ত বয়স হওয়ার পর থেকেই সে সংসারের ঘানি টানা শুরু করে। আড়াই তিন বছর পূর্বে সাড়ে চার লাখ টাকা দিয়ে সিএনজি অটোরিকশা কিনে নিজে দিন-রাত চালিয়ে দেড় দু’হাজার টাকা আয় করে। প্রতিদিনের আয় বাবা-মা`র কাছে জমা দিত। ১ সন্তানের বাবা জুসেদ কোনো দিন স্ত্রী শামীমা আক্তারের কাছে আয়ের টাকা দেননি। সুখি পরিবার হলেও সোনার হরিণ পাওয়ার নেশা তার মাথায় চড়ে।অটোরিকশা চালাতে গিয়ে মানব পাচারকারী দলের সদস্যদের খপ্পড়ে পড়েন জুসেদ। তাদের কথায় প্রলুব্ধ হয়ে কাউকে না জানিয়ে পহেলা এপ্রিল বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যান। ৭ মে জুসেদের বাবাকে জানানো হয় তার ছেলে মালয়েশিয়ার বর্ডারে আছেন। একটি ফোন নম্বর দিয়ে তারা বলেন, এই নম্বরে যোগাযোগ করলে জুসেদকে পাবেন। সে অনুযায়ী তিনি উক্ত নম্বরে ফোন করে ছেলের সঙ্গে কথা বলেন। তখন জুসেদ জানায়, তারা থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার বর্ডারে অমানবিক কষ্টে জাহাজে আছেন।শিবপাশা ইউপি`র রহমত আলীর ছেলে মেম্বর আব্দুল আজিজ ও আলী আকবরের ছেলে মকবুল আলী`র মাধ্যমে উদ্ধারের জন্য আকুতি জানান তিনি। আজিজ ও মকবুলের কাছে বারবার ধর্ণা দিয়েও ছেলেকে উদ্ধারের কোনো কূলকিনারা না পেয়ে তারা এখন পীর ফকিরের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন।চুনারুঘাটের দালাল হিরাই ও বাচ্চু মিয়ার মা রহিমা খাতুনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বিষয়টি অস্বীকার করে জাগো নিউজকে বলেন, কিভাবে তারা বিদেশ গেছেন সে ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না। তাদের সঙ্গে তার কখনোই দেখা হয় না। এমনকি তারা বাড়িতেও আসে না।বানিয়াচংয়ের ইউপি চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী জাগো নিউজকে জানান, তার এলাকা ও আজমিরীগঞ্জে শিবপাশার ইউপি মেম্বর আব্দুল আজিজ দালাল চক্রের সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন। এসব দালাল চক্রের সদস্যদের বিচার দাবি করেন তিনি।গাজীপুর ইউপি চেয়ারম্যান মাওলানা তাজুল ইসলাম জাগো নিউজকে জানান, নিখোঁজ যুবকদের দেশে ফিরিয়ে আনা, তাদের টাকা উদ্ধার ও দালালদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে তিনি উদ্যোগ নেবেন।চুনারুঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) অমূল্য কুমার চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় বিষয়টি আলোচনা হয়েছে। ইউপি চেয়ারম্যান মাওলানা তাজুল ইসলাম বলেছেন, তার ইউনিয়নে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে। তবে তাদের কী অবস্থা তিনি জানাতে পারেননি। তিনি বলেন, সভায় আমি বলেছি নির্দিষ্ট করে যদি কেউ অভিযোগ দেন তবে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।সৈয়দ এখলাছুর রহমান খোকন/এমজেড/আরআই
Advertisement