ভ্রমণ

অন্নপূর্ণায় সূর্যোদয়

নেপাল ভ্রমণের আগে ভ্রমণকারীদের অভিজ্ঞতা আর ইন্টারনেটে ঘাঁটাঘাঁটি নিয়ে সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি সম্পর্কে শুনেছিলেন- তা হল ‘অন্নপূর্ণায় সূর্যোদয়’। সব ব্যাখা শুনে আগ্রহের শীর্ষতালিকায় স্থান গেঁথে নিয়েছিল সূর্যোদয়। ওই ভোরের জন্য অপেক্ষাও ছিল মধুর। নেপাল ঘুরে বিস্তারিত জানাচ্ছেন রুখসানা মিলি-

Advertisement

পোখারা শহরের হোটেল থেকে সারাংকোটের জন্য যাত্রা যখন শুরু করেছি তখন ভোর চারটা। চারদিকে অন্ধকার। নেপালে চকচকে আলোর শহর নেই। পোখারার টিমটিমে আলোয় কুয়াশা আরো প্রলেপ দিয়ে একটা ভুতুড়ে ভাব তৈরি করেছে। মাইক্রোবাসে জানুয়ারি মাসের হাড়কাঁপুনি শীত থেকে বাঁচতে আপাদমস্তক প্যাক হয়ে বসেছিলাম। দক্ষ চালক পাহাড়ি রাস্তায় যাচ্ছে তা দেখতে না পেলেও বুঝতে পারছিলাম। 

ঠিক কতক্ষণ মনে নেই- বোধহয় মিনিট বিশেক বা আধঘণ্টা পর মাইক্রোবাসের জানালা থেকে দেখতে পেলাম জোনাকজ্বলা পোখারা শহরকে। উঁচু পাহাড়ি রাস্তার দুপাশে ছড়িয়ে থাকা পোখারা শহরের সেই রূপে একটা মুগ্ধতা এনে দিলো। পোখারা শহরের এই রূপের বর্ণনা অবশ্য যাওয়ার আগে পাইনি। গাড়ি পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে উপরে উঠে যখন গন্তব্যে থামল; তখন আমরা কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে সৌন্দর্য্যগুলো স্মৃতিবন্দি করলাম। 

গাড়ি থেকে নেমে সারাংকোটের সূর্যোদয় দেখার স্পটে পৌঁছতে কতগুলো পাহাড়ি সিঁড়ি ভাঙতে হল। কিন্তু সেই পরিশ্রমে ঠান্ডা কিছু কমেনি বরং স্পটে পৌঁছে ঠান্ডা বাতাসে দাঁতে দাঁতে বাড়ি লাগা শুরু হল। ওই স্পটে একটি দোকান ছিল। নেপালি দোকানি নারী আমাদের অবস্থা দেখে গাইডের অনুরোধে কিছু উলের চাদর ধার দিলেন। সঙ্গে গরম চা। গরম চা হাতে চেয়ার পেতে ভোর পাঁচটা থেকে সূর্য মামার জন্য শুরু হল আমাদের অপেক্ষার প্রহর। ছবি শিকারিরা ক্যামেরা হাতে নিয়ে তৈরি সেই দৃশ্য বন্দি করার জন্য। 

Advertisement

আমাদের গাইড আর আগে যারা গিয়েছেন, এমন সহযাত্রীরা জানালো কোন দিকে সূর্য উঠবে, আলো কোথায় পড়বে ইত্যাদি ইত্যাদি। 

কেবল মুখটুকু বের করে অপেক্ষার প্রহর গুনছি। অন্ধকার সরে গিয়ে হালকা ধোঁয়াশা হিমালয়ের অবয়বের দেখা পেলাম শুরুতে। জোনাকজ্বলা পোখারাও তখন স্পষ্ট হচ্ছে। সময় যাচ্ছে আর স্পষ্ট হয়ে উঠছে হিমালয়। অতিকায় অবয়ব মুগ্ধতা তৈরি করছে ক্ষণে ক্ষণে। ধোঁয়াশা, হালকা সাদা, নীলাভ সাদা, সাদাসহ অনেকগুলো রঙের দেখা মিলল অল্প সময়ের ব্যবধানে। এরপর এগিয়ে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। 

এক পাহাড়ের নিচে সূর্য মামা যখন আবির্ভূত তখন তার আগমনের বার্তা পেলাম বিপরীত দিকের আরেক পাহাড়ের চূড়ায়। আহা চূড়ায় দেখা প্রথম সেই আলোর ঝলকের রং-রূপ বর্ণনা করব সে সাধ্য আমার নেই। আচ্ছা লাল বা কমলা কতগুলো ধরন হতে পারে? শিল্পীরা হয়তো ভালো ব্যাখ্যা দিতে পারবেন। কিন্তু অন্নপূর্ণার চূড়ায় প্রথম আলোর রেখার পরে ক্ষণে ক্ষণে কত যে রঙের দেখা মিলেছিল তার বর্ণনা দিতে দক্ষ সাহিত্যিকের শব্দ ঝুলিও বুঝি হার মানবে। 

কখনো কমলা, কখনো লাল, কখনো বা ধাপে ধাপে হরেক রঙের মিশেল। সৃষ্টিকর্তার নিবিড় তুলির আঁচড়ে রঙের ঝলকে অন্নপূর্ণা হেসে উঠছিল। চূড়া ছাড়িয়ে আলোর রেখা ছড়িয়ে পড়ছিল আকাশজুড়ে। বুকের মধ্যে অপার সৌন্দর্য তৈরি করছিল একইসঙ্গে হাহাকার আর প্রাপ্তি। সেই অনুভূতির তুলনা নেই। অপার এই অন্নপূর্ণা দর্শন ক্যামেরা বন্দি করতে ব্যস্ত দর্শনার্থীরা। আমি কেবল মনের চোখেই বন্দি করছি। আলো-সৌন্দর্যে অনুভূতি শীতকে হার মানিয়েছে ততক্ষণে। উঠতে উঠতে সূর্য পুরো অন্নপূর্ণাকে যখন আলোয় ভরিয়ে দিলো; তখন শুরু হল আমাদের ফিরতি যাত্রা। 

Advertisement

সারাংকোটের সূর্যোদয় আমার স্মৃতিপটে যে আলোক রেখা তৈরি করেছে তা অক্ষয়। অন্নপূর্ণাকে বলে এলাম আবার আসবো। তোমার অপার সৌন্দর্যমাখা সূর্যোদয় দেখতে। ইংরেজ দার্শনিক ফ্রান্সিস বেকন বলেছেন, ‘দ্য বেস্ট পার্ট অব বিউটি ইজ দ্যাট হুইচ নো পিকচার ক্যান এক্সপ্রেস।’ অন্নপূর্ণায় সূর্যদেবতার উদয়ে যে রঙের খেলা তা কি ছবিতে ধরে রাখা বা ছবি দিয়ে বর্ণনা সম্ভব? বেকনের এই উক্তি বোধহয় এ দৃশ্যের জন্যই। যা চর্মচক্ষুতে বন্দি করে স্মৃতির কোঠরে রেখে রোমন্থন করা যায়। 

এসইউ/পিআর