এইচ এম এরশাদ নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে হটিয়ে অবৈধভাবে সামরিক শাসন জারি করে ক্ষমতা দখলের পর সব রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ করেছিলেন। এরপর প্রথমে ঘরোয়া রাজনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়। তারপর আসে সরাসরি রাজনৈতিক তৎপরতা চালানোর সুযোগ। এরশাদের নয় বছরে এ ধরনের অভিজ্ঞতা অনেকবারই হয়েছে আমাদের। কখনো রাজনৈতিক তৎপরতা বা ঘরোয়া রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হতো, কখনো নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হতো। কিন্তু তখন রাজনৈতিক দলগুলো সে নিষেধাজ্ঞা সবসময় মেনে চলেনি। বরং এরশাদের কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা ভাঙার মধ্যেই ছিল আন্দোলনের সাফল্য। সাধারণ নিষেধাজ্ঞা তো বটেই, এমনকি কারফিউ ভেঙেও আন্দোলন হয়েছে এরশাদের বিরুদ্ধে। ৮৩এর মধ্য ফেব্রুয়ারির আন্দোলন তো হয়েছিল সামরিক শাসনের সময়ে। ৮৭ বা ৯০এর আন্দোলনও তো এরশাদের অনুমতি নিয়ে হয়নি।
Advertisement
এখন সেই রামও নেই, সেই অযোধ্যাও নেই। এখন রাজনৈতিক তৎপরতার ওপর নিষেধাজ্ঞাও নেই, অনুমতিও নাই। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে আপসহীন বিএনপি এখন বিরোধী দলে। কিন্তু এখন বিরোধী দলের অনুমতি ছাড়া রাজনৈতিক তৎপরতা চালানোর চেষ্টাও নাই, সম্ভবত সামর্থ্যও নাই। অনেকদিন ধরেই বিএনপির প্রকাশ্য রাজনৈতিক তৎপরতা চালানোর সুযোগ পাচ্ছে না। সমাবেশ করার অনুমতি চাইলেও পাচ্ছে না। কোনো একসময় বিএনপি সমাবেশ করতে গিয়ে সহিংসতা চালিয়েছে। সেই অপরাধে বা অজুহাতে তাদের আর সমাবেশ করার অনুমতি দেয়া হয় না। যদিও বিএনপি অনেক আগেই সহিংসতার পথ ছেড়ে নিয়মতান্ত্রিক ধারায় ফিরে এসেছে। কিন্তু সহিংসতার দায় এখনও এড়াতে পারেনি। রাজপথে সভা-সমাবেশ করার অনুমতি না পেলেও বিএনপির আবাসিক নেতা রুহুল কবির রিজভি আহমেদ নিয়মিতই নয়াপল্টনের কার্যালয়ে ব্রিফিঙের নামে রাজা-উজির মারেন। অন্য নেতারাও প্রেসক্লাব বা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে নিয়মিতই কথার বিপ্লব ঘটান। বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশানের কার্যালয়েও মধ্যরাতের রাজনীতি চলে। তবে দুদিন আগে উত্তরায় জেএসডি নেতা আ স ম আব্দুর রবের বাসায় যা হলো, তা ছাড়িয়ে গেছে গণতন্ত্রের সকল নিয়ম-কানুন।
বাংলাদেশের রাজনীতির মূলধারা দুটি- আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী বিরোধী। স্বাধীনতার পরপর আওয়ামী বিরোধী ধারার নেতৃত্ব ছিল জাসদের হাতে। কাল পরিক্রমায় সেই জাসদ এখন আওয়ামী লীগে বিলীন প্রায়। আর পঁচাত্তরের পর আওয়ামী বিরোধী ধারার নেতৃত্ব নিয়ে আবির্ভাব ঘটে বিএনপির। অনেকদিন ধরেই আওয়ামী লীগ-বিএনপির বাইরে একটি তৃতীয় শক্তির উত্থানের চেষ্টা, অন্তত আওয়াজ আছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে। কখনো সে চেষ্টা শুভ শক্তির, কখনো অশুভশক্তির। বাংলাদেশের বাম দলগুলো সেই এরশাদ আমল থেকে আওয়ামী লীগ-বিএনপির বাইরে বিকল্প শক্তির উত্থানের চেষ্টা করে আসছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো বামদের সে চেষ্টা কখনো জনগণের আনুকূল্য পায়নি। আগামী নির্বাচনকে সামনে রাজনীতিতে নানা মেরুকরণ চলছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট আর বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের বাইরে এরশাদ একটি জোট করেছেন। এর পাশাপাশি বাম এবং উদারপন্থিরা মিলে আরেকটি জোট গড়ার চেষ্টা করছেন। সে চেষ্টার অংশ হিসেবেই আ স ম আব্দুর রবের বাসায় বসেছিলেন কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতারা। আ স ম আব্দুর রবের জেএসডি ছাড়াও সেই বৈঠকে বিকল্পধারা, গণফোরাম, বাসদ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, নাগরিক ঐক্য, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ছাড়াও এতদিন অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে তৎপরতা চালানো সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।
এই সংগঠনগুলোর অস্তিত্ব থাকলেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোনো প্রভাব নেই। এইসব দলে সংগঠনের চেয়ে ব্যক্তির গুরুত্ব বেশি। যেমন সেই বৈঠকের হোস্ট আ স ম আব্দুর মুক্তিযুদ্ধের সময়কার চার খলিফার একজন। স্বাধীনতার পর জাসদের হয়ে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখিয়ে তারুণ্যকে ধ্বংস করেছেন। ৮৮ সালের সংসদে এরশাদের গৃহপালিত বিরোধী দলের নেতা রব পরে শেখ হাসিনার প্রথম মন্ত্রিসভায়ও ছিলেন। আ স ম আব্দুর রব এখন জেএসডি নামে জাসদের একটি ভগ্নাংশের নেতৃত্ব দেন। কিন্তু এখন দলের চেয়ে ব্যক্তি বড়। সেদিন জড়ো হওয়া বেশিরভাগ নেতাদেরই একই অবস্থা। সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরীর এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে আর কোনো উপযোগিতা নেই। উপযোগিতা হারিয়ে ফেলা আরেক বিগশট ড. কামাল হোসেন রওয়ানা দিলেও পরে আর যোগ দেননি সেদিনের বৈঠকে। কাদের সিদ্দিকী এখন আর বাঘ নয়, কাগুজে বাঘ। মাহমুদুর রহমান মান্না, কমরেড খালেকুজ্জামান, কমরেড সাইফুল হক- সবার ক্ষেত্রেই এই কথা খাটে।
Advertisement
সংগঠনের চেয়ে ব্যক্তির সার্কুলেশন বেশি, যা আসলে কোনো কাজে লাগে না। কিন্তু রাজনীতিতে প্রভাবহীন, গুরুত্বহীন এই ব্যক্তিদের চা খাওয়ার আড্ডাকে হঠাৎ গুরুত্বপূর্ণ করে তুললো পুলিশ। তৃতীয় শক্তি গড়ার আশায় তারা চা খেতে বসেছিলেন। আ স ম আব্দুর রবের স্ত্রী বললেন, তিনি অতিথিদের রান্না করে খাওয়াবেন। কিন্তু হঠাতই পুলিশের একজন কর্মকর্তা এসে তাদের বৈঠক করা যাবে না বলে জানান। কেন করা যাবে না, জানতে চাইলে তিনি ওপরের নির্দেশের কথা জানান। কিন্তু সেই ওপরটা কত ওপর, সেই ওপরটা কে; তা তিনি বলেননি। আধঘণ্টা পর আবার এসে সেই পুলিশ কর্মকর্তা এসে আবার তাগাদা দেন দ্রুত বৈঠক শেষ করার জন্য। যদিও শেষ পর্যন্ত তারা ডিনার শেষ করতে পেরেছিলেন।
আ স ম আব্দুর রবের বাসায় যারা ঈদ পরবর্তী ডিনার পার্টিতে বসেছিলেন, তারা সবাই সরকার বিরোধী হিসেবে পরিচিত। তারা নিশ্চয়ই সেখানে সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। কীভাবে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে হারানো যায়, তার কৌশল নির্ধারণে কথা বলেছেন। কিন্তু সরকার বিরোধিতা করা তো কোনো দেশে, কোনো আইনেই অপরাধ নয়। নিষিদ্ধ ঘোষিত কোনো সংগঠন গোপনে কোথাও বসে রাষ্ট্রবিরোধী কোনো তৎপরতা চালালে সেখানে পুলিশ হানা দিতে পারে, ঘেরাও করে রাখতে পারে। কিন্তু নিবন্ধিত কয়েকটি রাজনৈতিক দলের কয়েকজন সুপরিচিত নেতা এক সাথে বসে কথা বললে, সরকার বিরোধী জোট করার উদ্যোগ নিলে, খাওয়া-দাওয়া করলে সেখানে পুলিশ যাবে কেন? কোন ওপরের নির্দেশে? বাংলাদেশের সংবিধানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সমাবেশ করার স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়া আছে। একজন সামান্য পুলিশ অফিসারের অত সাহস কোত্থেকে হলো যে তিনি সুপরিচিতি রাজনীতিবিদদের সাংবিধানিক অধিকার ক্ষুণ্ন করেন?
হতে পারে পুলিশ যে ওপরের নির্দেশের কথা বলেছে, তা সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। যদি এটা সত্যি হয়, তাহলে বলতেই হবে, নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার নার্ভাস। সবকিছুতে তারা অপ্রয়োজনীয় অতি প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। কিন্তু টানা নয় বছর ক্ষমতায় থাকা একটি দল এতটা নার্ভাস হতে পারে, এটা ঠিক মনে হচ্ছে না আমার কাছে। আমি বরং ভাবছি, হয় অতি উৎসাহী কেউ অথবা সরকারের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা কেউ এই কাজটি করেছে। এর আগে বেগম খালেদা জিয়ার বাসায় নিস্ফল অভিযান চালিয়েছিল পুলিশ। সে অভিযান থেকেও সরকারের কোনো অর্জন নেই। আ স ম আব্দুর রবের বাসায় পুলিশের হানায়ও সরকারের কোনো লাভ হয়নি। যতটুকু হয়েছে, পুরোটাই ক্ষতি। ধরুন, সেদিন পুলিশের কোনো বাধা ছাড়াই বৈঠকটি হলো, তাতে পরদিন কোনো পত্রিকাতেই এ বৈঠকের নিউজ ছাপা হতো না। কিন্তু পুলিশের বাধার কারণেই এটি এখন আলোচিত ঘটনা। পত্রিকায় নিউজ হচ্ছে, প্রতিবাদে বিবৃতি হচ্ছে, টক শো’তে আলোচনা হচ্ছে। কিছুই না একটি বৈঠককে সরকার অনেককিছুই বানিয়ে দিল। কার স্বার্থে?
আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনীতিতে নানা তৎপরতা চলছে। সরকারও বারবার একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলছে। কিন্তু মুখে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলে বাস্তবে রাজনীতিবিদদের ঘরোয়া আড্ডায়ও পুলিশী অভিযান চালালে প্রশ্ন উঠবে সরকারের আন্তরিকতা নিয়েই। আ স ম আব্দুর রবের বাসায় হামলা প্রসঙ্গে অনেকেই ৮৩এর মধ্য ফেব্রুয়ারিতে ড. কামাল হোসেনের বাসা থেকে সামরিক সরকারের অভিযানে রাজনৈতিক নেতাদের তুলে নিয়ে যাওয়ার স্মৃতিচারণ করেছেন। সামরিক সরকারের সাথে আমরা গণতান্ত্রিক সরকারের আচরণকে মেলাতে চাই না। তবে গণতান্ত্রিক সরকারের কাছ থেকে আমরা গণতান্ত্রিক আচরণই আশা করবো। মানুষের মতপ্রকাশের, সংগঠন করার, সমাবেশ করার অধিকার যেন ক্ষুণ্ন না হয়। সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ থাকলে তা সুনির্দিষ্ট ভাবেই বলতে হবে। ‘ওপরের নির্দেশ’ ধরনের ঢালাও যুক্তি দিয়ে গণতান্ত্রিক অধিকার ক্ষুণ্ন করা অন্যায়, অগণতান্ত্রিক।
Advertisement
probhash2000@gmail.com
এইচআর/জেআইএম