ইস্যু পেলে সরকারের সমালোচনায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠে দেশের অন্যতম প্রধান বিরোধী শক্তি বিএনপি। যেকোনো ইস্যুতে সংবাদ সম্মেলন, বিবৃতি, মানববন্ধন, প্রতিবাদ সভায় সরকারের সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে দলটি। তাই অনেকে মনে করেন সমালোচনার মধ্যেই আটকে আছেন দলটির নেতারা।
Advertisement
সারাদেশে চলমান বন্যা পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্তরা সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা পাচ্ছেন না- এমন অভিযোগ করলেও এখন পর্যন্ত কোথাও ত্রাণতৎপরতা চালায়নি বিএনপি। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, রাজনৈতিক সমালোচনার জন্যই সমালোচনা করছেন তারা।
গত দুই সপ্তাহ ধরে চলমান বন্যায় দেশের বেশ কয়েকটি জেলার লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন। সরকারিভাবে ত্রাণতৎপরতা পরিচালিত হলেও সেটি প্রয়োজনের তুলণায় অপ্রতুল বলে মনে করছেন ভুক্তভোগীরা।
বন্যা শুরুর পর থেকে বন্যার্তদের পর্যাপ্ত ত্রাণ দিতে সরকার ব্যর্থ হচ্ছে বলে সমালোচনার ঝড় তোলে বিএনপি। দলটির কেউ কেউ অভিযোগ করেন, সরকারি দলের নেতাকর্মীরা ত্রাণসামগ্রী লুটপাট করছেন। আবার কেউ বলেন, বিনা ভোটে ক্ষমতায় আসার কারণে জনগণের কঠিন দুর্দিনে যথাসময়ে পাশে দাঁড়াচ্ছে না সরকারি দল।
Advertisement
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মুখে সমালোচনা করলেও ভয়াবহ বন্যায় কোনো ত্রাণতৎপরতা হাতে নেয়নি বিএনপি। দলের পক্ষ থেকে সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের ত্রাণ দেয়ার আহ্বান জানিয়েই অনেকটা দায় সেরেছেন দলটির শীর্ষস্থানীয়রা।
এবারের বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জামালপুর, লালমনিরহাট, বগুড়া, কুড়িগ্রাম, সিরাজগঞ্জ ও পাবনার নিম্নাঞ্চলের মানুষ। জাগো নিউজের জামালপুর প্রতিনিধি মেহেদী মাহমুদ খান জানান, জেলায় বন্যা শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে বিএনপির পক্ষ থেকে কোনো ত্রাণ দেয়া হয়নি।
লালমনিরহাট প্রতিনিধি রবিউল ইসলাম জানান, চলতি বন্যায় জেলার বহু মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। গত ১০ দিন ধরে শুকনো খাবার খেয়ে কোনোভাবে জীবন বাঁচিয়ে রেখেছেন অনেকে। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণতৎপরতা লক্ষ্য করা গেলেও বিএনপির কোনো ভূমিকা লক্ষ করা যায়নি। বন্যার্তদের পাশে বিএনপির নেতাকর্মীদের দাঁড়াতে দেখা যাননি।
বগুড়া প্রতিনিধি লিমন বাশার জানান, এবারের বন্যায় জেলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এখন পর্যন্ত বিএনপির কাউকে দুর্গতদের পাশে দাঁড়াতে দেখা যায়নি। তবে সোনাতলা উপজেলার বিএনপি সমর্থিত চেয়ারম্যান নিজ উদ্যোগে কিছু ত্রাণ বিতরণ করেছেন।
Advertisement
এছাড়া কুড়িগ্রাম, সিরাজগঞ্জ ও পাবনার দুর্গতদের মাঝে দলটির পক্ষ থেকে কোনো ত্রাণতৎপরতার খবর পাওয়া যায়নি। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন জাগো নিউজের স্থানীয় প্রতিনিধিরা।
গত কয়েকদিন ধরে নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী প্রতিনিয়ত সংবাদ সম্মেলন করে বন্যার্তদের বিষয়ে সরকারের উদাসীনতার কথা তুলে ধরছেন। এনিয়ে জ্বালাময়ী বক্তব্যও দিচ্ছেন। পাশাপাশি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, জাতীয় প্রেস ক্লাব, নয়াপল্টনের ভাসানী ভবনে আয়োজিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বন্যার্তদের পর্যাপ্ত সহযোগিতা না করায় দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা সরকারের তীব্র সমালোচনা করছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিএনপির পক্ষ থেকে ত্রাণ তৎপরতা পরিচালনার জন্য বিশেষ কোনো টিম গঠন করা হয়নি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
প্রেস ক্লাবকেন্দ্রিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সরব দলের ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু সম্প্রতি একটি মানববন্ধনে বলেছেন, দেশের কিছু অঞ্চলে নীরব দুর্ভিক্ষ চলছে। হাওর বিপর্যয় ও পাহাড়ধসের পরে দেশের উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চল বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলো কোনো ত্রাণ পাচ্ছেন না, যেগুলো দেয়া হচ্ছে তা আওয়ামী লীগের লোকজন লুটপাট করছে। বন্যায় দুর্গত মানুষগুলোকে রক্ষার প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে সর্বদলীয় বৈঠক করা। আসুন আমরা দলমত নির্বিশেষে বন্যায় দুর্গত মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াই।
সম্প্রতি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে অনুষ্ঠিত এক আলোচনা সভায় বিএনপির ভাইস-চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমান বলেন, বন্যা নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, আমাদের চালের মজুদের অভাব নেই। অথচ বন্যায় দুর্গত মানুষগুলো ভয়াবহ খাদ্য সংকটে ভুগছে। তারা রিলিফ পাচ্ছে না। বন্যায় দুর্গত এলাকায় যে সমস্ত চাল ও খাদ্যসামগ্রী যাচ্ছে সেগুলো আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নিজেদের মধ্যে বিতরণ করে রিলিফগুলো লুটপাট করছে।
সার্বিক বন্যার পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে নানা সমালোচনা করলেও বন্যার্তদের জন্য বিএনপি কী করছে- এমন প্রশ্নের জবাবে আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, আমাদের দলের নেতাকর্মীরা সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে বন্যার্তদের জন্য কাজ করছেন। সমস্যাটা হলো আমরা এত বড় ইস্যুতে নিজেরা অর্থ দিয়ে বড় করে রিলিফ প্রদান করতে পারছি না। এখানে সরকারের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। কিন্তু সরকার যথাযথভাবে সে দায়িত্ব পালন করছে না। তাদের অবহেলাগুলো চিহ্নিত করে আমরা সরকারকে সহযোগিতার চেষ্টা করছি।
সাবেক এ মন্ত্রী বলেন, সীমিত চেষ্টায় যেখানে যেমন পারছি সেখানে কিছু রিলিফ, কিছু জিনিসপত্র এমনকি নগদ টাকাও দিচ্ছি। স্থানীয় নেতাকর্মীদের বলে দিয়েছে যেন তারা তাদের সামর্থ অনুযায়ী সহযোগিতা করে।
বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াতে বিএনপির গৃহীত কর্মসূচি সম্পর্কে জানতে চাইলে দলের ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিষয়ক সহ-সম্পাদক শফিকুল হক মিলন বলেন, বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াতে কেন্দ্র থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সরকারের কাছে অনুরোধ জানানো হয়েছে যাতে দুর্গতদের মঝে যথাযথভাবে ত্রাণ বিতরণ করা হয়। স্থানীয় পর্যায়ের নেতাকর্মীদেরও পাশে দাঁড়াতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে প্রতিনিয়ত তৃণমূলের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ রাখছি।
পানিবন্দী মানুষের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে কোনো পরিকল্পনা আছে কি না- জানতে চাইলে দলের স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. মীর ফাওয়াজ হোসেন শুভ জানান, যেসব এলাকা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেসব এলাকায় হেলথ টিম পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। সাধ্যের মধ্যে আমরা সবটুকু দেয়ার চেষ্টা করছি। ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিটি জেলায় বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা প্রদান, বিনামূল্যে ওষুধ বিতরণের জন্য নেত্রী নির্দেশ দিয়েছেন। তার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতিটি জেলায় টিম পাঠাব। দ্রুতই কাজ শুরু হবে বলেও জানান তিনি।
দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এ প্রসঙ্গে বলেন, ইতোমধ্যে স্থানীয় বিএনপি ও অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মীরা বন্যাদুর্গতদের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ শুরু করেছেন। বিএনপির পক্ষ থেকে এ ধরনের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।
বন্যার্তদের পর্যাপ্ত সহযোগিতা না করায় সরকারের সমালোচনা করা হচ্ছে কিন্তু বিএনপির পক্ষ থেকে ত্রাণ তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না- এ বিষয়ে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান জাগো নিউজকে বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোতে সামর্থ অনুযায়ী স্থানীয় নেতাকর্মীরা সাহায্য-সহযোগিতা করছেন। কোনো তৎপরতা চলছে না- এমন অভিযোগ সঠিক না। পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে।
এমএম/এমএআর/জেআইএম