মতামত

জগতে বিশাল এক নারীজাতি গড়ে উঠছে, নারীসত্তাকে খুন করে

নারী জাগরণের একটা কোটেশন প্রায় দেখি, "বিয়ে করা আর বাচ্চা পয়দা করা ছাড়াও একটি মেয়ের জীবনে আরও অনেক কিছু করার আছে, তাঁকে দাবিয়ে রাখবেন না"। কথা হলো যে জীবনে কিছু করার ইচ্ছা রাখে, নারী হোক বা পুরুষই হোক, তাঁকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারেন না। শত বাঁধা বিপত্তিকে তুচ্ছ করে হলেও সে জীবনে কিছু করবেই। এই একটা জায়গায় নারী পুরুষ দুজনই ডেসপারেট। 

Advertisement

পৃথিবীজোড়া যে হারে সমকামিতার বৈধতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এমতাবস্থায় মেয়ে মানুষ যদি বাচ্চা পয়দা করা বন্ধ করে দেয় তাহলেতো পৃথিবী জনসংখ্যাহীনতার হুমকির সম্মুক্ষীণ হবে। মনে পড়ছে 'ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স অ্যান্ড মনিটরি ইকোনোমিকস' এ সেকুলার স্ট্যাগনিশান নিয়ে পড়েছিলাম। ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে অর্থনীতিতে "Secular Stagnation" বলে একটা টার্ম খুব আলোচনায় এসেছিলো। হারবার্ড প্রফেসর এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের সিনিয়র ইকোনমিস্ট ল্যারি সামার ২০১০ সালে ওবামার চিফ ইকোনমিক এডভাইজার নিযুক্ত হন। ল্যারি বর্তমান বিশ্বের অর্থনৈতিক মন্দার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সেকুলার স্টেগনেশন ব্যাখ্যা করেন। সেকুলার স্টেগনেশন অনুযায়ী জনসংখ্যা হ্রাস বর্তমান বিশ্বের অর্থনৈতিক মন্দার একটি অন্যতম প্রধান কারণ। বিশেষ করে জাপানে এটি একটি বড় সমস্যা। সুতরাং আমি বলিকি মেয়েদের বাচ্চা পয়দা করতে দাবিয়ে রাখবেন না দয়া করে। তাছাড়া উপরোক্ত উক্তিটিতে মেয়েদের যে অনেক কিছুর করার আহ্বান করা হয়েছে সেগুলো নিশ্চয়ই বাচ্চা পয়দা করেও করা যায় তাইনা? 

নাচতে না জানলেতো উঠান বাঁকা হবেই। তাছাড়া যেহেতু আমি নিজেও একটি বাচ্চা পয়দা করেছি সেহেতু, একজন নারীর পক্ষে বাচ্চা পয়দা করার চাইতে বেশি অনেক কিছু করা আর কি হতে পারে ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। একজন নারী ছাড়া দেখি কে, কোন পুরুষ পারে বাচ্চা পয়দা করতে করে দেখাকতো। আমি জানি আমার অনেক নারী বন্ধুরা আমার নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে নেতিবাচক এবং সেকেলে ভাবেন। এমন মেসেজও পেয়েছিলাম যে আমি নারীকে শুধু গৃহিণী হওয়ার পরামর্শ দেই। অথচ আমি নিজেই কোনদিন শুধু গৃহিণী ছিলাম না। আমার মেয়ের জন্মের এক বছর পরই আমি কাজে ফিরে যাই। কিন্তু তবু আমি মনে করি কেউ যদি গৃহিণী হতে চায় তবে তাতে তাঁর আপত্তি থাকা উচিত নয় এবং তাতে নিজেকে অকেজো ভাবাও উচিত নয়। আবার সাংসারিক প্রয়োজনে তাঁর কাজ করার অপরিহার্যতা থাকলে তাঁকে উপেক্ষা করে মাতৃত্ব ফলালেও চলে না। কারণ আমার সন্তানের জীবনে আমার ভূমিকা আর কারো চাইতে অনেক বেশি। নিজের দায়িত্ব পালনের মধ্যে দিয়ে নিজেকে গড়াও যায়। 

জীবনটাকে পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করাই মানবজীবনের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিৎ। একজন নারী এবং একজন মা হিসেবে আমি মাতৃত্বকেই সবচাইতে বেশি উপভোগ করেছি। জীবনের প্রতি সমস্ত দৃষ্টিভঙ্গি আমার পাল্টে গেছে মা হয়ে। পরিপূর্ণ মাতৃত্ব থেকে প্রাজ্ঞতার যে আভাস একজন নারী পায়, তা অনুধাবন করতে পারলে তাঁর পথ সে নিজেই খুঁজে পাবে একদিন। মহাত্মা গান্ধী যখন অনশনে ছিলেন তখন আত্মশক্তির জন্য বারবার একটা কথা বলতেন, "মাই লর্ড, মেইক মি মোর ওম্যানলি। বিং ওম্যানলি ইজ নট অনলি এবাউট ওম্যান, ইটস এবাউট হিউম্যানিটি, ইটস এবাউট একজিস্টেন্স" নারীর ক্ষমতা যে কতো ঐশ্বরিক তা আমরা নিজেরাও জানিনা। এই ঐশ্বরিক মতৃত্ব, একজন নারীর জীবন যেখানে শুরু হয়, তাঁকেই সে জীবনের ইতি ভাবে। তাই পুরুষের সাথে তাঁকে প্রতিনিয়ত প্রতিযোগিতা করতে হয়। 

Advertisement

যে পাশে থেকে ভালোবাসবে, ভরসা দেবে, তাঁর সাথে প্রতিযোগিতা কেন? যে কোন লেখার অন্তঃর্নিহিত ভাবটি অনুধাবন করা অত্যন্ত জরুরি। আমার লেখায় যেমন নারীর দুঃখ আছে, অপারগতা আছে, তার মাঝে নারীর বিশালত্বের আভাসও আছে। নারী যে সমগ্র সৃষ্টির উৎস সে কথা আছে। কাব্যিক ভাবে, আধ্যাত্মিকভাবে দেখলে মনে হবে নারীর সমতুল্য যদি কেউ থাকে তবে সে কেবল ঈশ্বর। আর সে জন্যই বাহ্যিকতার দিক থেকে, বাস্তবতার দিক থেকে আধুনিক চলমান জীবনে নারী পুরুষের চাইতে অনেক বেশি পিছিয়ে। আমি নিজে একজন নারী হয়ে নারীকে দুর্বল আমি কোনোদিন ভাবি না। তবে তাঁর দায়বদ্ধতাকে আমি অস্বীকার করিনা। 

একজন শক্তিশালী মানুষ কেবল নিজের শক্তিকেই অনুধাবন করেন না, নিজের দুর্বলতার সম্পর্কেও স্পষ্ট ধারণা রাখে। নারী তাঁর নারীসত্তাকে উপলব্ধি করলেই সে নারী হয়ে ওঠে। নিজের প্রতি অস্বচ্ছ ধারণাই সকল মানুষের অন্যের প্রতি সকল বিদ্বেষের মূল। আধুনিক জগতে বিশাল এক নারীজাতি আছে তাতে কোন সন্দেহই নেই, কিন্তু নারীসত্তা আছে বড় ক্ষুদ্র এক অংশ। ভিতরে উন্নয়ন হলে, তবেই সে নারী স্বাধীন নারী। তার চারপাশকে আপনিই সে নিজ আয়ত্ত্বে নিয়ে আসে। পড়ুয়া নারীই একমাত্র শিক্ষিত হয়, আর কর্মজীবী নারী হয় অভিজ্ঞ প্রতিদ্বন্দ্বিনী। কর্মের জগত অস্থির, ক্লান্তিকর, প্রতিযোগিতার। কিন্তু শিক্ষার জগত মর্যাদার, স্থিরতার, প্রাজ্ঞতার। কর্মের মধ্যে নারী অভিজ্ঞতা লাভ করে, বিজ্ঞতা বা প্রাজ্ঞতা নয়। কর্মের দ্বারা সে বাহ্যিক শক্তি অর্জন করে, অন্তরের মুক্তি নয়।

লেখক : ডাবলিন ট্রিনিটি কলেজের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী।

এইচআর/এমএস

Advertisement