খেলাধুলা

রাতের পল্টন ময়দান যেন ‘নেশার রাজ্য’

চলো চলো, পল্টন চলো- রাজনৈতিক অঙ্গনে এক সময়ের প্রচলিত স্লোগান এটি। পল্টন মানে ‘পল্টন ময়দান।’  যার নামের আগে জুড়ে আছে ‘ঐতিহাসিক’ শব্দটি। ঢাকার গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যের স্মারক এ ময়দানটি এক সময় বিখ্যাত ছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক জনসভার জন্য। মহান স্বাধীনতার সংগ্রাম ও বিভিন্ন সময়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের স্মৃতিময় স্থান এটি। 

Advertisement

সেই ঐতিহাসিক পল্টন ময়দান এখন আর চেনার উপায় নেই। দিনের আলো নিভে যাওয়ার পরই বদলে যায় ময়দানের চেহারা। পল্টন ময়দানসহ পুরো বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম চত্বরে ঢুকতে থাকে ভাসমান মানুষ। যাদের বেশিরভাগই মাদকসেবী আর মাদক ব্যবসায়ী। রাত একটু গভীর হলেই পল্টন ময়দান পরিণত হয় ‘নেশার রাজ্যে।’

পল্টন ময়দান আস্তে আস্তে ঢেকে যাচ্ছে বিভিন্ন ক্রীড়া স্থাপনায়। এক চিলতে মাঠ ছাড়া এখানে আর কোনো জায়গা নেই। মাঠের পশ্চিম পাশে যে খালি জায়গা  ব্যবহার হতো বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য, সর্বশেষ সে জায়গাটুকু ঢুকে গেছে অখ্যাত খেলা রোলার স্কেটিংয়ের পেটে। সেখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রোলার স্কেটিং কমপ্লেক্স।

কেবল ক্রীড়া স্থাপনাই নয়, পল্টন ময়দানে এখন বস্তিঘরও গড়ে উঠছে। রোলার স্কেটিং কমপ্লেক্স আর হ্যান্ডবল স্টেডিয়ামের মাঝে কে বা কারা করছেন নার্সারি ব্যবসা। নার্সারি ব্যবসার আড়ালেই সেখানে তোলা হয়েছে বস্তিঘর। রাতে বস্তিঘরে লোকজনের যাওয়া-আসা নিয়েও আছে নানা প্রশ্ন। 

Advertisement

জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের নাকের ডগায় বস্তি-ঘরবাড়ি তৈরি হলেও কিছু জানে না তারা। নার্সারি ব্যবসা ও সেখানে ঘর তুলে বসবাস প্রসঙ্গে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সচিব অশোক কুমার বিশ্বাস জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে আসার আগেই একজনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল ওই ফাঁকা জায়গাটার সৌন্দর্য রক্ষার। তবে কাউকে ব্যবসা করার জন্য নয়। আর ঘর তুলে থাকার তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না। এ ধরনের বস্তিঘরের মধ্যেই সাধারণত নানা ধরনের অপরাধমূলক কাজকর্ম হয়ে থাকে। ঘরটি ভেঙ্গে ফেলা হবে। আমি এখনই স্টেডিয়ামের প্রশাসককে বলে দিচ্ছি।’

বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের প্রশাসক মো. মোবারক করিম লিটনেরও একই কথা, তিনি দায়িত্ব নেয়ার আগেই ওখানে  নার্সারি ব্যবসা শুরু হয়েছে। ঘরও দেখেছি একটা। তবে ওই ঘরে নেশাখোরদের জাতায়াত আছে কিনা আমার জানা নেই। আমি খোঁজ নিচ্ছি।  সেখানে ঘর তুলে বসবাস করাও ঠিক না।’

হ্যান্ডবল স্টেডিয়ামের দক্ষিণ পাশেও আরেকটি বস্তিঘর তৈরির জন্য জিনিসপত্র এনে রাখা হয়েছে। আপাতত পলিথিন টানিয়ে সেখানে কেউ কেউ থাকছেন। বিভিন্ন জায়গায়  প্রকাশ্যেই মাদক বিক্রির অভিযোগ পাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের প্রশাসক গত ১২ জুন পল্টন থানায় চিঠি দিয়ে স্টেডিয়াম চত্বর থেকে নেশাখোরদের স্থায়ীভাবে উচ্ছেদের আবেদন করেছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। 

পল্টন ময়দান, সুইমিং পুলের আশপাশ, হকি স্টেডিয়ামের চারিদিক, ভলিবল ও কাবাডি স্টেডিয়ামের পাশের বিভিন্ন অন্ধকার জায়গায় রাত হলেই জড়ো হয় মাদকসেবী আর মাদক ব্যবসায়ীরা। প্রকাশ্যেই বিক্রি হয় মাদক, সেবনও হয় প্রকাশ্যে। মাঝে-মধ্যে তো কোনো কোনো জায়গায় লাইন পড়ে যায় মাদক কেনার জন্য। দেখলে মনে হয় যেন ন্যায্যমূল্যে জিনিসপত্র বিক্রি হচ্ছে। 

Advertisement

স্টেডিয়াম চত্বর থেকে কেনো নেশাখোর ও ভাসমান মানুষদের উচ্ছেদ করা যাচ্ছে না? ‘এটা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। রাতে স্টেডিয়াম পাহারার জন্য মাত্র ৫ জন লোক নিয়োজিত আছে। এর মধ্যে কারো কারো ছুটিছাটাও থাকে। এদের দিয়ে পুরো স্টেডিয়াম চত্বর নজরদারিতে রাখা সম্ভব নয়’-বলেছেন বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের প্রশাসক মো. মোবারক করিম লিটন।

তাহলে কী খেলাধূলার এ গুরুত্বপূর্ণ জায়গাটা এভাবে অরক্ষিতই থাকবে? ‘জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সচিব অশোক কুমার বিশ্বাসের কণ্ঠেও যেন অসহায়ত্বের সুর ‘আসলে পুলিশ ছাড়া এগুলো দূর করা সম্ভব না। একবার তাদের চিঠি দেয়া হয়েছে, প্রয়োজনে আবার দেব।’ 

বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম, মওলানা ভাসানী স্টেডিয়াম, উডেন ফ্লোর জিমন্যাসিয়াম, অলিম্পিক ভবন, হ্যান্ডবল স্টেডিয়াম, রোলার স্কেটিং কমপ্লেক্স, ভলিবল স্টেডিয়াম, বক্সিং স্টেডিয়াম, কাবাডি স্টেডিয়াম নিয়ে বিশাল এ চত্বর। বেশিরভাগ ক্রীড়া ফেডারেশনের কার্যালয়ও এখানে। খেলাধূলার এতবড় স্থানে একটি স্থায়ী পুলিশ বক্স প্রয়োজন আছে  কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে অশোক কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘হ্যাঁ, সেটা থাকলে তো ভালোই হয়। আমি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলব স্টেডিয়াম চত্বরে পুলিশ বক্সের ব্যবস্থার জন্য।’

বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের বারান্দাসহ বিভিন্ন ক্রীড়া স্থাপনার সামনে রাতে হাজার হাজার ভাসমান মানুষ অবস্থান করে। কেউ ঘুমায় কেউ আবার রাতভর নেশায় মত্ত থাকে। মজার তথ্য হলো-স্টেডিয়ামের বারান্দায় ভাসমান মানুষের ঘুমানোটাকে নাকি ইতিবাচক হিসেবে দেখেন স্টেডিয়ামের দোকান মালিকরা। রাতে দোকান ঘেঁষে ভাসমান মানুষ সারিবদ্ধ হয়ে ঘুমানোর কারণেই নাকি নিরাপদ থাকে দোকানগুলো!  

নেশাখোর, ভাসমান মানুষ ছাড়াও বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের আরেক সমস্যা গাড়ি। দিনের বেলায় স্টেডিয়াম চত্বরকে মনে হবে বিশাল গ্যারেজ। এখানে ফেডারেশনগুলোর কর্মকর্তা, দোকান মালিক ছাড়া অন্য কারো গাড়ি পাকিংয়ের বৈধতা নেই। তাহলে এত সারিসারি গাড়ী কাদের? ‘স্টেডিয়ামের আশপাশের অফিসের লোকজন তাদের গাড়ী স্টেডিয়াম চত্বরে এনে রাখে। আমরা কয়েকদিন আগে মাইকিং করে সতর্ক করেছি। তারপরও কমছে না’-বলেন বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের প্রশাসক মো. মোবারক করিম লিটন।

আরআই/এনইউ/পিআর