আন্তর্জাতিক

মুহাম্মদ আলী আর লিস্টনের সেই ঐতিহাসিক লড়াই

বক্সিংয়ের কথা উঠলেই কিংবদন্তী মুহাম্মদ আলীর নাম চলে অাসে। ৫০ বছর আগে প্রথম যে লড়াইয়ে তিনি বিশ্বকে চমকে দিয়েছিলেন, তা বক্সিং ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত লড়াইগুলোর অন্যতম। মুহাম্মদ আলী তখনও মুহাম্মদ আলী হয়ে ওঠেননি। তার নাম ছিল ক্যাসিয়াস ক্লে, নতুন এক বক্সার। 

Advertisement

১৯৬৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। বক্সিং রিং এ বিশ্ব হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন সনি লিস্টনের বিরুদ্ধে হুংকার দিচ্ছেন ক্যাসিয়াস ক্লে নামের এক আনকোরা কৃষ্ণাঙ্গ তরুণ।

ক্লের ভাষায়, আমিই হতে যাচ্ছি বিশ্ব সেরা। লিস্টনের বয়স হয়েছে। আমার পাশে তার কোনো জায়গা নেই। বেচারা সনি লিস্টনকে আমি একটা শিক্ষা দিতে চাই। লিস্টন যেহেতু সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আমার বিরুদ্ধে লড়াই করার; কিভাবে ঘুষি খেয়ে পড়ে যেতে হয়, সেটা তাকে শেখাবো। 

তবে মানুষজন ভেবেছিলেন লিস্টন আসলে ক্ল্যাসিয়াস ক্লে-কে মেরে ত্ক্তা বানিয়ে দেবেন। সনি লিস্টনের নক-আউট পাঞ্চের কথা তারা সবাই জানেন।

Advertisement

নিউ ইয়র্ক টাইমসের সবচেয়ে বম বয়সী ক্রীড়া প্রতিবেদক ছিলেন রবার্ট লিপ সাইড। তাকে পাঠানো হয়েছিল ওই সংবাদ সংগ্রহের জন্য। তিনিও ধারণা করেছিলেন ক্লে হেরে যাবেন। খেলা শেষে হাসপাতালে ক্লে-কে দেখার জন্য তাকে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল পত্রিকা কর্তৃপক্ষ। 

সম্প্রতি রবার্ট লিপ সাইড তার আত্মজীবনী প্রকাশ করেছেন। সেখানেই বিষয়গুলো নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতা প্রকাশ করেন তিনি। 

তিনি লেখেন, দুই বক্সার রিং এর মাঝখানে মুখোমুখি হওয়ার আগে পর্যন্ত আমি একবারও ভাবিনি, এই লড়াইয়ে ক্যাসিয়াস ক্লে জেতার বিন্দুমাত্র আশা আছে। কিন্তু যখন তারা সামনা সামনি দাঁড়ালেন; আমি প্রথম বারের মতো বুঝলাম যে ক্যাসিয়াস ক্লের শরীর আসলে সানি লিস্টনের চেয়ে বড়।

আমরা প্রস্তুত হচ্ছিলাম ডেভিড আর গলাইয়াথের লড়াই দেখার জন্য। কিন্তু আদতে দেখলাম, আমরা যাকে ডেভিড ভাবছি, তিনি লিস্টনের চেয়ে কয়েক ইঞ্চি লম্বা, আর প্রায় তার সমানই চওড়া। তখন আমরা ভাবছিলাম, হয়তো আজকে কোনো একটা কিছু ঘটে যেতে পারে।

Advertisement

শুরু থেকেই লড়াইয়ের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিল ক্যাসিয়াস ক্লে। সে পুরো রিং জুড়ে নেচে বেড়াচ্ছিল। যখন খুশি ঘুষি বাগিয়ে আঘাত করছিল লিস্টনকে। প্রায় পুরো সময়টা জুড়ে লড়াইয়ের নিয়ন্ত্রণ ছিল ক্যাসিয়াস ক্লের হাতে। 

লিস্টনের শরীরে সেরকম বিরাট কোনো আঘাতের চিহ্ণ আমরা দেখছিলাম না। সুতরাং আমরা আসলে বুঝতে পারছিলাম না ঠিক কি ঘটছে। এটা একটা হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন্সশীপ লড়াই। জেতার জন্য এখানে বক্সাররা প্রাণ দিয়ে হলেও লড়বে, সেটাই আশা করা হয়।

কিন্তু লিস্টন হার মেনে নিলেন। তিনি পরে বলেছিলেন, তার বাঁ হাত কাজ করছিল না, সেটা কোনো কারণে অকেজো হয়ে পড়েছিল।

আমাদের মনে তখন প্রশ্ন জাগল, আসলেই কি তাই, নাকি লিস্টন আসলে কাপুরুষ। নাকি তিনি আসলে ক্লের কাছে অসম্মানজনকভাবে হেরেছেন। নাকি এটা একটা পাতানো খেলা!

অনেকে আনন্দে চিৎকার করছিলেন, কেউ কেউ লিস্টনকে তুলোধুনা করছিলেন। অনেকে ছিলেন বিভ্রান্ত। তারা বুঝতে পারছিলেন না কি ঘটছে। আসলে কি ঘটেছে সে ব্যাপারে কেবল একজনই যেন নিশ্চিত ছিলেন। তিনি হচ্ছেন ক্যাসিয়াস ক্লে। তিনি বক্সিং রিং এর দড়ি ধরে চিৎকার করছিলেন, আমি দুনিয়া কাঁপিয়ে দিয়েছি, আমিই এখন বিশ্বের রাজা।

ক্লের কাছে লিস্টনের এই অবিশ্বাস্য হার পরের দিন সব পত্রিকার প্রধান শিরোনাম। রবার্ট লিপসাইডের রিপোর্টও ছাপা হল নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রথম পাতায়। আর তরুণ ক্যাসিয়াস ক্লে ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নিয়ে পরবর্তী কয়েক মাস ধরে পত্রিকার শিরোণাম হয়ে থাকলেন। তার নুতন নাম হলো মুহাম্মদ আলী।

সনি লিস্টন আবার ফিরতি লড়াইয়ে এসে আলিকে বুঝিয়ে দেবেন, কে শ্রেষ্ঠ, সেটাই আশা করা হচ্ছিল। কিন্তু এই ফিরতি লড়াইটা যখন হল, সেটি কিন্তু শেষ হয়ে গেল চোখের পলকে।

এই লড়াইটা আসলে এক রাউন্ডেরও কম সময়ে শেষ হয়ে যায়। রিং এর ভেতরে দুজনে মুখোমুখি দাঁড়ানোর পর সনি লিস্টন মুহাম্মদ আলীর দিকে এগিয়ে আসতেই মেঝেতে পড়ে গেলেন।

প্রথম রাউন্ডের লড়াই শুরু হতে না হতেই সনি লিস্টন যেভাবে মাটিতে পড়ে গেলেন, তাতে সবাই অবাক হলেন। কারণ যে নক আউট পাঞ্চে তিনি ধরাশায়ী হলেন সেটা আসলে কেউ দেখতে পাননি। রবার্ট লিপ সাইড লেখেন, মুহাম্মদ আলীর এই পাঞ্চটি পরে 'ভৌতিক পাঞ্চ' নামে পরিচিতি পায়।

রবার্ট লিপ ধারাভাষ্যকার হাওয়ার্ড কোসেলের পাশে বসে ছিলেন। রিংসাইডে বসা লোকজনের মধ্যে একমাত্র তার সামনেই একটি টিভি মনিটর ছিল। এ কারণেই আসলে মুহাম্মদ আলীর সেই ভৌতিক পাঞ্চটি তিনি বার বার দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। 

পুরো দৃশ্যটি এগারোবারের মতো দেখার সময় তিনি দেখলেন, সনি লিস্টন সামনে এগিয়ে আসছেন। তার সঙ্গে মুহাম্মদ আলীর দূরত্ব খুবই কম, মুহাম্মদ আলী তার ডান হাত দিয়ে ঘুষি মারলেন, কিন্তু এত কাছে থেকে ঘুষিটি মারলেন, তা প্রচন্ড শক্তিতে আঘাত করল সনি লিস্টনের মুখে।

দর্শকরা বুঝতে পারছিল না কি ঘটছে। কিন্তু এই লড়াই আর নতুন করে শুরু হয়নি। বক্সিং ইতিহাসে এই লড়াইয়ে আলী তার প্রতিপক্ষকে নকআউটে পরাজিত করেন বলে উল্লেখ আছে। 

আলীর ঘুষি খেয়ে মাটিতে পড়ে যাওয়া লিস্টন পরে আর দাঁড়াতে পারেননি; কিন্তু সেরার আসনে জায়গা করে নিয়েছেন মুহাম্মদ আলী। তার নামের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে বক্সিংয়ের নাম। বিবিসি বাংলা।

কেএ/পিআর