বিশেষ প্রতিবেদন

বেকারত্ব দূরীকরণে পিএসসিকে ঢেলে সাজাতে হবে

“৩৮তম বিসিএস পরীক্ষার অনলাইন আবেদন শুরু হয়েছে। শেষ হবে ১০ আগস্ট। এরপর প্রিলিমিনারি পরীক্ষার সময় ঘোষণা করা হবে। অক্টোবরে এ পরীক্ষা আয়োজনের কথা ভাবা হচ্ছে”

Advertisement

গত দুই বছরে বাংলাদেশ কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সক্ষমতা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। পুরনো পদ্ধতি বাতিল করে নিয়োগ ও ফল প্রকাশে প্রযুক্তির ছোঁয়া লাগানো হয়েছে। দেশের বেকারত্ব দূরীকরণে পিএসসিকে আরও ঢেলে সাজাতে হবে। এজন্য আর্থিক সংশ্লিষ্টতা বাড়ানো দরকার। নিজেদের অর্জিত অর্থ দিয়েই তা সম্ভব বলে মনে করেন পিএসসি চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিক। জাগো নিউজের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় বর্তমানে পিএসসির সক্ষমতা এবং গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে কথা বলেন তিনি। 

জাগো নিউজ : রাষ্ট্র পরিচালনায় দেশে ক্যাডার ও নন-ক্যাডার তৈরি করে পিএসসি। পাশাপাশি সরকারি প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা নিয়োগেও সুপারিশ করে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে পিএসসির সক্ষমতা এবং চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগের পর আপনার গৃহীত পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি? 

ড. মোহাম্মদ সাদিক : আগের চেয়ে পিএসসির সকল পরীক্ষা ও ফল প্রকাশের সময় কমিয়ে আনা হয়েছে। বর্তমানে প্রযুক্তির সহায়তায় স্বল্প সময়ে সরকারি ক্যাডার ও নন-ক্যাডারে নিয়োগ পরীক্ষা সম্পন্ন হচ্ছে। অন্যান্য দেশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিসিএস পরীক্ষায় ব্যাপক পরিবর্তন ও সংস্কার করা হচ্ছে। সিলেবাসের আধুনীকায়ণ, পরীক্ষা পদ্ধতি ও নম্বর বন্টনে পরিবর্তন ছাড়াও সার্বিক বিষয় যুগোপযোগী করা হচ্ছে। 

Advertisement

৩৮তম বিসিএস পরীক্ষা থেকে একক পরীক্ষকের পরিবর্তে দ্বৈত পরীক্ষক পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। ইংরেজি ও বাংলা ভার্সনে (সংস্করণ) পরীক্ষার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ওপর ৫০ নম্বরের প্রশ্ন যোগ করা হয়েছে। সময় বাঁচিয়ে স্বল্প সময়ে উপযুক্ত প্রার্থী মনোনয়নের লক্ষ্যে পরীক্ষার খাতা বাসায় না নিয়ে পিএসসিতে বসেই দেখতে বলা হয়েছে।

জাগো নিউজ : ক্যাডার ও নন-ক্যাডার পদে এখন পর্যন্ত কতজনকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে?

ড. মোহাম্মদ সাদিক : ২০০১ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত ক্যাডার পদে ১২ হাজার ৭৯৩ জন এবং নন-ক্যাডার পদে চার হাজার ১৯৪ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এ সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এ সময়ে ক্যাডার পদে ২৬ হাজার ২০২ জন এবং নন-ক্যাডার পদে ২২ হাজার ৮২৯ জনকে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করেছে পিএসসি। 

৩৫তম বিসিএসের মাধ্যমে দুই হাজার ১৮১ জনকে ক্যাডার পদে এবং দুই হাজার ৬২৬ জনকে নন-ক্যাডার পদে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। 

Advertisement

জাগো নিউজ : ৩৬তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল কবে নাগাদ প্রকাশ হবে? 

ড. মোহাম্মদ সাদিক : ৩৬তম বিসিএসে পাঁচ হাজার ৯৯০ জন লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। গত ১২ মার্চ মৌখিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। শিগগিরই চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হবে। 

জাগো নিউজ : ৩৭ ও ৩৮তম বিসিএস পরীক্ষার ফলাফল ও সময়সূচি প্রসঙ্গে কিছু বলেন?

ড. মোহাম্মদ সাদিক : ৩৭তম বিসিএসে দুই লাখ ৪৩ হাজার ৪৭৬ জন অংশগ্রহণ করেন। এর মধ্যে আট হাজার ৫২৩ জন প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। গত ২৩ মে তাদের লিখিত পরীক্ষা শেষ হয়েছে। উত্তরপত্রের মূল্যায়নও শেষ হয়েছে। বর্তমানে তা নিরীক্ষণের কাজ চলছে। 

৩৮তম বিসিএস পরীক্ষার অনলাইন আবেদন শুরু হয়েছে ১০ জুলাই। শেষ হবে ১০ আগস্ট। এরপর প্রিলিমিনারি পরীক্ষার সময় ঘোষণা করা হবে। অক্টোবরে এ পরীক্ষা আয়োজনের কথা ভাবা হচ্ছে।

জাগো নিউজ : পিএসসিকে ডিজিটালাইজ করতে কোন ধরনের উদ্যোগ হাতে নিয়েছেন? 

ড. মোহাম্মদ সাদিক : পিএসসিকে ডিজিটালাইজ করতে নানা উদ্যোগ হাতে নেয়া হয়েছে। ফলাফল ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়েছে। ফলাফল প্রক্রিয়াকরণে সফটওয়ার সার্চ ইঞ্জিনের মাধ্যমে নয় হাজার ৬০০ নার্স নিয়োগের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হয়েছে। কমিশনের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় এমসিকিউ (বহু নির্বাচনী প্রশ্ন) মূল্যয়নে সফটওয়ার তৈরি করে নন-ক্যাডার পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পরীক্ষার দিন সকালে ছাপিয়ে পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়েছে। এতে পরীক্ষা আয়োজনের সময় অনেক কমে এসেছে।

বিসিএস পরীক্ষা পদ্ধতি আধুনিকায়নে আরও নতুন নতুন পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে।

জাগো নিউজ : বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠান হিসেবে পিএসসিকে গড়তে কী কী উদ্যোগ নিয়েছেন?

ড. মোহাম্মদ সাদিক : আগে পিএসসির প্রশ্নকারক, মডারেটর, পরীক্ষক ও নিরীক্ষকদের নামমাত্র সম্মানি প্রদান করা হতো। সেটি বৃদ্ধি করা হয়েছে। তবে এটিও পর্যাপ্ত নয়। পিএসসির আর্থিক সংশ্লিষ্টতা কম। তাই নিজেদের অর্জিত আয় দিয়ে বাংলাদেশ কর্ম কমিশনকে বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে। 

জাগো নিউজ : পরীক্ষা ও ফল প্রকাশে দীর্ঘসূত্রিতায় পরীক্ষার্থীদের মূল্যবান সময় নষ্ট হচ্ছে। এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছেন কি না?

ড. মোহাম্মদ সাদিক : হ্যাঁ, এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। দীর্ঘ সময় ধরে পরীক্ষা ও ফল প্রকাশে লাখো তরুণ-তরুণীর মূল্যবান সময় নষ্ট হচ্ছে। এ শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে পরীক্ষা পদ্ধতি পাল্টানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে পিএসসি। বিসিএস পরীক্ষা সংস্কারের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে পিএসসির চেয়ারম্যান ও সদস্যরা একাধিক বৈঠক করেছেন। 

জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামসহ সরকারের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে ইতোমধ্যে আলোচনা হয়েছে। সবুজ সংকেত পাওয়ার পরই এসব পরিবর্তন নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে।

পিএসসি চাইলেই নিয়ম পরিবর্তন করতে পারে না। এজন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অনুমতি এবং আইন পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়। এ কারণে চাইলেই তাৎক্ষণিক সবকিছু পরিবর্তন করা সম্ভব হয় না। তবে যেসব বিষয়ে পরিবর্তন প্রয়োজন সেগুলো আমরা রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য পাঠিয়েছি। সম্মতি পেলেই পিএসসির কার্যক্রমে আমূল পরিবর্তন হবে। 

বর্তমানে আমরা সার্কুলার জারি করা থেকে চূড়ান্ত ফল প্রকাশ পর্যন্ত সব কাজ এক বছরের মধ্যে সম্পন্নের চেষ্টা করছি। পিএসসি এখন একটি সার্চ ইঞ্জিনের উন্নয়ন করছে, যার মাধ্যমে সংক্ষিপ্ত সময়ে মেরিট ও কোটা নির্ধারণ সংক্রান্ত সমস্যা দ্রুত সমাধান করা যাচ্ছে। 

জাগো নিউজ : পরীক্ষা পদ্ধতি, নম্বর বন্টন ও সিলেবাস নিয়েও তো প্রশ্ন আছে…

ড. মোহাম্মদ সাদিক : বিসিএস পরীক্ষার পদ্ধতি, নম্বর বন্টন ও সিলেবাস নিয়েও বহুদিনের আপত্তি রয়েছে দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদসহ বিশেষজ্ঞদের। শিক্ষার্থীরাও বিভিন্ন সময় এসব বিষয় নিয়ে আপত্তি তুলেছেন। উন্নত দেশ-তো বটেই এশিয়ার দেশগুলোতে এ ধরনের পরীক্ষাও অনেক আধুনিক। তাদের সিলেবাস, মানবন্টন ও পরীক্ষা পদ্ধতি অনেক বেশি আধুনিক ও শিক্ষাবান্ধব। 

বিসিএসের যেকোনো পরীক্ষার সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে এক বছরের মধ্যে চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করতে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। 

প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতিতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়। একজন প্রার্থীর পক্ষে মাসের পর মাস ধরে পরীক্ষা দেয়া কষ্টকর। যে কারণে অনেক মেধাবী প্রতিযোগিতামূলক এ পরীক্ষায় অংশ নেন না। তবে প্রচলিত পদ্ধতি তো রাতারাতি পাল্টে ফেলা যাবে না। ধীরে ধীরে সংস্কার করা হচ্ছে। 

জাগো নিউজ : লিখিত পরীক্ষার নম্বর কমানো হয়েছে। এতে মেধাবীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন কি না? 

ড. মোহাম্মদ সাদিক : লিখিত পরীক্ষার নম্বর কমালেও প্রার্থীদের মেধা ও যোগ্যতা যাচাইয়ে কোনো ঘাটতি হবে না। কারণ কম নম্বরের মধ্যেও মানসম্পন্ন প্রশ্ন করে প্রার্থীর মেধা ও যোগ্যতা যাচাই করা সম্ভব।

জাগো নিউজ : বর্তমান পরীক্ষা পদ্ধতি সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন?

ড. মোহাম্মদ সাদিক : বিসিএস পরীক্ষা পদ্ধতি তিন স্তর বিশিষ্ট। ২০০ নম্বরের এমসিকিউ পদ্ধতির প্রিলিমিনারি পরীক্ষার পর হয় লিখিত পরীক্ষা। ৯০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষার পর তৃতীয় স্তরে ২০০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষা। লিখিত পরীক্ষায় বাংলা, ইংরেজি ও বাংলাদেশ বিষয়ে ২০০ করে ৬০০ নম্বর এবং আন্তর্জাতিক, গাণিতিক যুক্তি ও মানসিক দক্ষতা এবং সাধারণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে ১০০ করে মোট ৯০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ৯০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষা নিতে পিএসসির এক মাসের বেশি সময় লেগে যায়। 

ড. মোহাম্মদ সাদিক ১৯৫৫ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সুনামগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ১৯৭৬ সালে বিএ (সম্মান) এবং ১৯৭৭ সালে এমএ ডিগ্রি লাভের পর যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় হতে ১৯৯৪-৯৫ সালে পারসোনাল ম্যানেজমেন্টের ওপর পড়াশোনা করেন। পরে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ‘সিলেটিনাগরী লিপি’র ওপর গবেষণায় ভারতের আসাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।

ড. সাদিক সরকারের শিক্ষা সচিব ও বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ইতোপূর্বে তিনি বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্বে ছিলেন। যেমন- জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব, বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট (বিয়াম) ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক এবং বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস প্রশাসন একাডেমির পরিচালক ও ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক পদে দায়িত্ব পালন করেন। 

ড. সাদিক সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নজরুল ইন্সটিটিউট’র প্রতিষ্ঠাতা সচিব হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তিনি শিল্প মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, তথ্য মন্ত্রণালয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ভিন্ন ভিন্ন পদেও দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সুইডেনস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব এবং কাউন্সেলর হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৬ সালের ২ মে তিনি বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদান করেন।

এমএইচএম/এমএআর/জেআইএম