অর্থনীতি

সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে পরিবর্তন আসছে

সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের সীমা বেঁধে দেয়ার পাশাপাশি বিনিয়োগ করতে হলে সরকারকে অর্থের উৎস জানাতে হবে। এ খাতে বিনিয়োগে দুই স্তরবিশিষ্ট সুদ চালুর পরিকল্পনাও করা হচ্ছে। সম্প্রতি সঞ্চয়পত্র বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এসব বিষয় উঠে আসে।

Advertisement

সূত্র জানায়, ব্যাংকিং খাতে ঋণের চাহিদা না থাকায় বর্তমানে আমানতের সুদের গড় হার ৫ শতাংশের নিচে নেমে গেছে। শেয়ারবাজারের অবস্থাও নাজুক। ফলে টাকা বিনিয়োগের এ দুই বড় ক্ষেত্র থেকে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। নিরাপদ বিনিয়োগের জন্য মানুষ সরকারি সঞ্চয়পত্রের ওপরই বেশি নির্ভরশীল। অন্য যেকোনো খাতে বিনিয়োগের তুলনায় এখানে মুনাফার হার প্রায় দ্বিগুণ, গড়ে প্রায় ১১ থেকে ১২ শতাংশ। তাছাড়া এ খাতে বিনিয়োগে অর্থের উৎস সম্পর্কে এখনও কোনো প্রশ্ন করা হয় না। আর এসব সুযোগ কাজে লাগিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ হয়ে থাকতে পারে বলে আশঙ্কা সরকারের।

মূলত সামাজিক ও আর্থিক সুরক্ষা দেয়ার জন্য সরকার নিম্ন মধ্যবিত্ত, সীমিত আয়ের মানুষ, বয়স্ক, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য এ প্রকল্প চালু করে। কিন্তু সঞ্চয়পত্রের এই মুনাফা অধিকাংশ ভোগ করছে সমাজের উচ্চবিত্ত ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এ কারণেই এ খাতে বিনিয়োগে পরিবর্তন আনা হচ্ছে বলে জানা গেছে।

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ নীতিমালা সংশোধনের উদ্যোগ সরকারের ইতিবাচক পদক্ষেপ। সংশোধনগুলো করা হলে রাষ্ট্র ও প্রকৃত সুবিধাভোগীরা উপকৃত হবেন। তবে তারা সতর্ক করে বলেছেন, নিম্নবিত্ত মানুষ যেন এতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেটি অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে।

Advertisement

এদিকে জাতীয় সঞ্চয় স্কিমের বিনিয়োগে ঊর্ধ্বগতি রোধ করতে সঞ্চয় স্কিমের বিধি-বিধানে এমন পরিবর্তন আনার প্রস্তাব করেছে জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতর। সম্প্রতি এ প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে সঞ্চয়পত্রের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা সংস্থাটি। অধিদফতরের মহাপরিচালক বাবলু কুমার সাহা স্বাক্ষরিত ওই প্রস্তাবে বলা হয়েছে, পেনশনার সঞ্চয়পত্র ছাড়া অন্যান্য সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগসীমা কমিয়ে সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা নির্ধারণ করা যেতে পারে।

বর্তমানে পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র, ডাকঘর সঞ্চয়পত্রে একক নামে সর্বোচ্চ ৩০ লাখ এবং যৌথ নামে সর্বোচ্চ ৬০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করা যায়। পেনশনার সঞ্চয়পত্রে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা এবং পরিবার সঞ্চয়পত্রে সর্বোচ্চ ৪৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করা যায়। আর প্রতিষ্ঠানের বেলায় কোনো ঊর্ধ্বসীমা নেই। যেসব সঞ্চয় স্কিমে যুগ্ম নামে বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে, তা বন্ধ করার প্রস্তাবও এসেছে অধিদফতর থেকে। এছাড়া প্রতিষ্ঠান ও নাবালকের সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বন্ধের প্রস্তাব করেছে অধিদফতর।

সঞ্চয়পত্রের যেকোনো স্কিমে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীর আয়ের উৎস জানানোর বিধান চালুর প্রস্তাব করেছে সঞ্চয় অধিদফতর। একই সঙ্গে নারী, প্রতিবন্ধী ও সমাজের বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিকদের সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পরিবার সঞ্চয়পত্রে অনধিক ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগকারীদের জন্য মুনাফার হার আরও আকর্ষণীয় করার প্রস্তাব দিয়েছে সংস্থাটি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিআইডিএসের সাবেক গবেষণা পরিচালক ড. জায়েদ বখত বলেন, সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ নীতিমালা সংশোধন করা দরকার। প্রতিষ্ঠানকে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের সুযোগ দেয়ার কোনো মানে নেই। নাবালকদের বিনিয়োগ সুযোগ না থাকাই ভালো। কারণ নাবালকের অর্থের নিরাপত্তা নিয়ে অনেক জটিলতা তৈরি হয়। তবে বয়স্ক নাগরিক ও পেনশনারদের বিষয়ে বিশেষভাবে চিন্তা করতে হবে।

Advertisement

এ বিষয়ে অর্থ বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, করণীয় ঠিক করতে অর্থ মন্ত্রণালয়ে সম্প্রতি একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ খাতে বিনিয়োগ হয় অনেক বেশি। টাকার অঙ্কের পরিমাণও ভালো। একক ও যুগ্ম বা যৌথ নামে পৃথকভাবে সঞ্চয়পত্র কেনা যায়। এক্ষেত্রে অপ্রদর্শিত অর্থ কিংবা কালো টাকা বিনিয়োগের বিষয়টি একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। কারণ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে টাকার উৎস নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় না। তাই সঞ্চয়পত্রে অপ্রদর্শিত অর্থ ঢোকা বন্ধ করতে এ খাতে বিনিয়োগে টাকার উৎস নিয়ে প্রশ্ন তোলার কথা বলা হয়েছে বৈঠকে।

বৈঠকে এর সুদের হার নিয়েও আলোচনা হয়েছে। বর্তমানে আমানতের সুদের গড় হার ৫ শতাংশের নিচে। এর সঙ্গে মিলিয়ে সঞ্চয়পত্রের সুদের হারও ৭ বা ৮ শতাংশ করা উচিত বলে মনে করে অর্থ বিভাগ। কারণ সাধারণত ব্যাংক আমানতের সুদের হারের চেয়ে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ১ বা ২ শতাংশ বেশি হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এ ব্যবধান ৪ শতাংশের বেশি। তাছাড়া সঞ্চয়পত্র বিক্রির ধারা অব্যাহত থাকলে অর্থবছর শেষে এ খাত থেকে ঋণের পরিমাণ কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা বলা মুশকিল। ফলে সুদ বাবদ সরকারকে অতিরিক্ত অর্থ পরিশোধ করতে হবে, যা স্বল্প ও মধ্য মেয়াদে সরকারের বাজেটের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করবে। তাছাড়া সরকারের সম্পদ উদ্বৃত্তের পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে সঞ্চয় প্রকল্পের সুদের হার রিভিউ অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।

তবে অর্থ বিভাগ বলছে, যেহেতু বর্তমানে এটি নিরাপদ বিনিয়োগের ক্ষেত্র তাই এ খাতে দুই স্তর সুদ হার প্রবর্তন করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে পারিবারিক ও পেনশনার সঞ্চয়পত্রসহ সবগুলোয় ৩০ লাখের বেশি বিনিয়োগ হলে কমে যাওয়া সুদ দেয়া হবে। আর ৩০ লাখের কম বিনিয়োগ হলে বিদ্যমান ১১ থেকে ১২ শতাংশ হারে সুদ দেয়া হবে।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, অর্থ বিভাগ বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করছে। এগুলোর ব্যাপারে শিগগিরই সুপারিশ তৈরি করে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে পাঠানো হবে। সুপারিশ অনুমোদন পেলে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ক্রেতাকে অবশ্যই এ অর্থ কোথা থেকে এসেছে তা উল্লেখ করতে হবে। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট কাগজপত্রও জমা দিতে হতে পারে। পাশাপাশি প্রথমবারের মতো দ্বি-স্তর সুদ বাস্তবায়ন হবে। তবে সবকিছুই নির্ভর করছে অর্থমন্ত্রীর অনুমোদনের ওপর।

এর আগে গেল বছরের ২৩ মে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ২ শতাংশ কমানো হয়েছে। এতে পরিবার সঞ্চয়পত্রের সুদ হার ১৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ করা হয়েছে। পেনশনার সুদ হার সঞ্চয়পত্রের ১৩ দশমিক ১৯ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশে পুনর্নির্ধারণ করা হয়। পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রের বর্তমান সুদ হার ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ, আগে ছিল ১৩ দশমিক ১৯ শতাংশ। তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের সুদ হার ১২ দশমিক ৫৯ শতাংশ থেকে কমিয়ে করা হয়েছে ১১ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকে মেয়াদি ও সাধারণ হিসাবে বর্তমানে ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ হারে সুদ দেয়া হচ্ছে। আগে দেয়া হতো ১৩ দশমিক ২৪ শতাংশ। তবে প্রবাসীদের জন্য ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ডের (৫ বছর মেয়াদি) সুদের হার আগের মতো ১২ শতাংশই রাখা হয়েছে। সঞ্চয়পত্রের সঙ্গে সামাজিক নিরাপত্তা প্রিমিয়াম নামে আরও এক থেকে দেড় শতাংশ সরকার থেকে ভর্তুকি দেয়া হতো। সেটিও তুলে দেয়া হয়েছে। ফলে মুনাফার হার আরও কমে গেছে।

সঞ্চয়পত্রের সুদের হার যে কমানো হবে তা অর্থমন্ত্রী বেশ কয়েকবার বলেছেন। অর্থমন্ত্রী জানান, অনন্তকালের জন্য সঞ্চয়পত্রের সুদের হার নির্দিষ্ট থাকতে পারে না। সুদের হারের সঙ্গে মূল্যস্ফীতির গভীর সম্পর্ক রয়েছে, মূল্যস্ফীতি বাড়লে সুদের হার বাড়ে আর মূল্যস্ফীতি কমলে সুদের হার কমে। বিষয়টি তাই আমাদের পুনর্বিবেচনা করতে হবে।

সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র খাত থেকে সরকার নিট ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিল ১৯ হাজার ৬১০ কোটি টাকা। অথচ গেল এপ্রিলে বিক্রি হয়েছে ৪২ হাজার ৯৮ কোটি টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে ৩০ হাজার ১৫০ কোটি টাকা নেয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে।

এমইউএইচ/ওআর/আরআইপি