কুড়িগ্রাম জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। হু-হু করে বাড়ছে নদ-নদীর পানি। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন গ্রাম। বুধবার ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলমারী পয়েন্টে বিপদসীমার ৩৬ সেন্টিমিটার ও সেতু পয়েন্টে ধরলা নদীর পানি বিপদসীমার ২৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছে।
Advertisement
ঘরে ঘরে দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানি, শুকনা খাবার, জ্বালানি ও খাদ্য সংকট। দেখা দিয়েছে পানিবাহিত রোগ। সরকার যে ত্রাণ বরাদ্দ দিয়েছে তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। আবার বরাদ্দ যা পাওয়া যাচ্ছে তা মাঠ পর্যায়ে বিতরণ হচ্ছে ঢিলেঢালাভাবে। ফলে বন্যার্ত মানুষের দুর্ভোগ এখন চরমে। সরকারের বরাদ্দকৃত ত্রাণ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম বলে অভিযোগ জনপ্রতিনিধিদের।
সদর উপজেলার পাঁচগাছি ইউপি চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন জানান, তার ইউনিয়নে ৬ হাজার পরিবার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হলেও মাত্র ৮ মেট্রিক টন চাল পাওয়া গেছে। যা দিয়ে ৮০০ পরিবারকে ১০ কেজি করে চাল দেয়া হয়েছে।
চাল বিতরণকালে বুধবার সরেজমিন সেখানে গেলে চর সিতাইঝাড় গ্রামের মঞ্জু ও নুরজাহান জানান, গলা পানি ভেঙে ইউনিয়ন পরিষদে এসে স্লিপ না পাওয়ায় ত্রাণ পাননি তারা।
Advertisement
রৌমারী উপজেলা সদরের ৯নং ওয়ার্ড কান্দাপাড়ার তিন শতাধিক পরিবার সাতদিন ধরে পানিতে ভাসছে। বুধবার বিকেলে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত এখানকার মানুষের কাছে কোনো ত্রাণের চাল পৌঁছেনি। রৌমারী সদর ইউপি চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম শালু এ এলাকায় ভোট কম পাওয়ায় এ বঞ্চনার শিকার ওই এলাকার দুর্গত মানুষ।
চাঁদ মিয়া, মোসলেম, সাজু, কামাল ও ময়েনের বাড়ি ভেঙে গেছে বন্যার তোড়ে। আব্দুল আজিজ (৬০), হাসেন আলী (৮৫), মর্জিনা (২৫), আব্দুল বারেক (৪০), বারেক নজিমুদ্দিন (৪৫) জানান, তাদের অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটছে। ঘরে খাবার নেই। নেই জ্বালানী। বিশুদ্ধ পানির অভাব। হাতে কাজ নেই। নেই টাকা। ফলে চরম দুর্ভোগে দিন কাটছে। তাদের অভিযোগ চেয়ারম্যানকে ভোট না দেয়ায় ত্রাণ জুটছে না তাদের ভাগ্যে।
৯নং ওয়ার্ডের মেম্বার তমিজ উদ্দিন জানান, কান্দাপাড়া, বাঘমারার আংশিক এবং পালের চরের কয়েকশত পরিবার বানের পানিতে ভাসছে। ত্রাণ মিলছে না। মঙ্গলবার চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম শালু মাত্র দুই বস্তা চাল (১০০ কেজি) ওই এলাকার জন্য বরাদ্দ দেন। তা নেইনি। কারণ এ চাল মাত্র ১০টি পরিবারকে দেয়া যেত। অথচ ক্ষতিগ্রস্ত তিন শতাধিক পরিবার। রোষানলে পড়ার ভয়ে তা দুর্গত এলাকায় নিয়ে যেতে পারিনি।
তিনি আরও জানান, বুধবার বিকেলে কান্দাপাড়া গ্রামের আমির হামজা (৫৫) অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে রৌমারী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দেখা দিয়েছে পানিবাহিত রোগ। ঘরে ঘরে থাবার কষ্ট, পানির কষ্ট, পয়ঃনিষ্কাশনের কষ্ট। সব রাস্তা ডুবে যাওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে।
Advertisement
রৌমারী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মজিবর রহমান বলেন, রৌমারীর সব চেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ৯নং ওয়ার্ডে এখন পর্যন্ত ত্রাণ পৌঁছেনি মূলত ইউপি চেয়ারম্যানের খাম-খেয়ালিপনার কারণে। এ উপজেলার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা ৮ হাজার ২৮৪টি। এখন পর্যন্ত ত্রাণ বরাদ্দ পাওয়া গেছে ১৫ মেট্রিক টন চাল ও ৫০ হাজার টাকা। যা চাহিদার তুলনায় একেবারে অপ্রতুল। অপর দিকে রাজিবপুর উপজেলায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার তিন হাজার। এখন পর্যন্ত বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১০ মেট্রিক টন চাল ও ২৫ হাজার টাকা।
উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নের অনন্তপুর-কুমারপাড়া বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের উপর দিয়ে পানি ঢুকে তৎসংলগ্ন ১০টি গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া কুড়িগ্রাম-যাত্রাপুর পাকা সড়কে পানি ওঠায় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। রাজারহাটের মেকলি, সদর উপজেলার বাংটুরঘাট, মোঘলবাসাসহ কয়েকটি স্থানে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে ফাটল দেখা দেয়ায় তা মেরামতের চেষ্টা করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
চিলমারী উপজেলার ৬ ইউনিয়নে প্রায় ১৫ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বুধবার উপজেলার ৬ ইউনিয়নে প্রায় ২ হাজার পরিবারের মাঝে ১০ কেজি করে মোট ২০ মেট্রিক টন চাল বিতরণ করা হয়। কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক আবু ছালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খান ত্রাণ বিতরণে অংশ নেন।
উপজেলার রমনা খামার এলাকার শবেদা (৭০) জানান, গত ৪ দিন ধরে তিনি পানিবন্দি থাকলেও এখন পর্যন্ত কোনো সাহায্য তিনি পাননি। একই কথা বললেন খামার এলাকার নদী তীরবর্তী পানিবন্দি হাজিরন বেগম (৬০), নজির হোসেন (৭০), মজিদা বেওয়াসহ (৫০) আরও অনেকে। প্রয়োজনের তুলনায় ত্রাণ সামগ্রী অপ্রতুল হওয়ায় অনেকে সাহায্য পায়নি বলেন জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধিরা।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয়ের দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এনামুল হক জানান, এ পর্যন্ত ৩শ মেট্রিক টন জিআর চাল, ৮ লাখ ২৫ হাজার টাকা ক্যাশ ও ২ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার ৯ উপজেলায় বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। বুধবার পর্যন্ত চলতি বন্যায় দেড় লক্ষাধিক মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়াও ৪ হাজার ২১৬ পরিবার ভাঙনে নিঃস্ব হয়েছে।
বন্যায় আউশধান, পাট, আখ, কলা, আমন বীজতলাসহ আক্রান্ত জমির পরিমাণ ৩ হাজার ৮১২ হেক্টর। এতে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সংখ্যা ২১ হাজার ৩৩০ জন। বন্যা ও নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ির সংখ্যা ৩৮ হাজার ৩১২টি। বন্যার তীব্র স্রোতে দেড় কিলোমিটার বাঁধ, ১৭টি ব্রিজ এবং ১৪১ কিলোমিটার রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৪৩টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আংশিক এবং ১টি সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
নাজমুল হোসাইন/আরএআর/বিএ