জাতীয়

উদ্বোধনের অপেক্ষায় ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন প্রকল্প

দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর অবশেষে শেষ হতে চলেছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চার লেন প্রকল্পের কাজ। কুমিল্লার দাউদকান্দি সেতু পর্যন্ত ১৯৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এই চার লেনের কাজ শেষ হয়েছে প্রায় ৯৫ শতাংশ। এরই মধ্যে যানবাহন চলাচলের জন্য ১৮৮ কিলোমিটার উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সুত্র জানায়, ১০ প্যাকেজের মধ্যে ২, ৩ ও ৫ নং প্যাকেজে ব্ল্যাক টপের কাজ বাকি রয়েছে। এটিও আগামী জুনের আগেই সম্পন্ন হবে। আর এর ফলে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা পণসামগ্রী খুব দ্রুতই রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে যাবে। এদিকে  সময়ের চাহিদার প্রেক্ষিতে চার লেনের গুরুত্ব এখন আর নেই বলে দাবি করেছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের মতে, ৯ বছর আগে নেয়া হয়েছিল চার লেন প্রকল্পের কাজ, কিন্তু ৯ বছরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের গুরুত্ব বেড়েছে অনেকখানি। সম্প্রসারিত হয়েছে ব্যবসা বাণিজ্য। সড়কে যানের ব্যবহার বেড়েছে বিশগুণেরও বেশি। তাই এটি এখন আট লেনে উন্নীতকরণ এবং এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ সময়ের দাবি। সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের (সওজ)’র ৩০ এপ্রিলের সরজমিন রিপোর্টের তথ্যমতে, চার লেন প্রকল্পটির সেতুর তিন প্যাকেজের মধ্যে একটি প্যাকেজে কিছুটা কাজ বাকি আছে। ২৩টি ছোট-বড় সেতুর কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ২৪৩টি বক্স কালভার্টের কাজও সম্পন্ন হয়েছে। তবে কুমিল­া ফ্লাইওভারটির কাজ বেশ কিছু বাকি রয়েছে। ফ্লাইওভারের কাজটি সম্পন্ন না হলেও চার লেন চালু করতে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। ফলে আগামী জুনের মধ্যে চার লেনের মূল কাজ শেষ হতে পারে। এছাড়া প্রকল্পের আনুষঙ্গিক আরো কিছু কাজ রয়েছে, যেগুলো পর্যায়ক্রমে সম্পন্ন করা হবে। এর মধ্যে রয়েছে চার লেনের বিভিন্ন স্থানে ৩৩টি ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ,  সড়ক বিভাজনে গাছ লাগানো ইত্যাদি।ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চট্টগ্রাম অংশের বিভিন্নস্থান ঘুরে দেখা যায়, চট্টগ্রামের সিটিগেইট থেকে ধূমঘাট ব্রিজ পর্যন্ত চট্টগ্রাম অংশের ৬৬ কিলোমিটার এর কাজ প্রায় শেষ। মধ্যখানে আইল্যান্ড সাজানো, কোথাও সংস্কার, কোথাও ফাইনাল লেয়ার দেয়ার কাজ চলছে এখন। শুধু মিরসরাই সদর এলাকার কিছু অংশে সিসি ঢালাই বাকি আছে। তবে এখানেও কাজ শেষ পর্যায়ে এবং শুধু রিজেন্ট ট্রিটমেন্ট চলছে বলে জানান ফোরলেন কর্মকর্তারা।  প্রকল্প ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী জুলফিকার আলীর জানান, জুনের মধ্যে শেষ করার কথা থাকলেও এখন আমরা জুন নয় চলতি মে মাসের মধ্যেই অবশিষ্ট সকল কাজই সম্পন্ন করে ফেলছি। সৌন্দর্যবর্ধনসহ টুকটাক কাজ সড়ক চালুর পর পর্যায়ক্রমে শেষ করা হবে। সংশ্লিষ্টদের মতে, মূল ঠিকাদার চীনের সিনোহাইড্রো করপোরেশনের কারণেই বারবার ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন প্রকল্প বাস্তবায়ন পিছিয়েছে। ১৯৬ কোটি ৭৯ লাখ টাকা কম দর প্রস্তাব করে সাত প্যাকেজের কাজ নিলেও এর পর থেকে বারবার ব্যয়বৃদ্ধির জন্য যোগাযোগ মন্ত্রণালয়কে চাপ দিয়ে যাচ্ছিল প্রতিষ্ঠানটি। এরই মধ্যে তিন দফা প্রকল্প ব্যয় বাড়ানো হলেও ২০১৩ সালের শেষ দুই মাসের রাজনৈতিক অস্থিরতায় আবারো ৩৪১ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চায় সিনোহাইড্রো। এ অর্থ না দিলে প্রকল্পের বাকি কাজ করতেও রাজি ছিল না প্রতিষ্ঠানটি। তবে পদ্মা সেতু প্রকল্পে নদী শাসনের কাজ পাওয়ার পর চার লেনের কাজ দ্রুত শেষ করে আনে প্রতিষ্ঠানটি। এ ব্যাপারে প্রকল্পের পরিচালক ইবনে আলম হাসান জানান, জমি হস্তান্তরে বিলম্ব, রাজনৈতিক অস্থিরতা, ঠিকাদারদের অবহেলাসহ নানা কারণে তিন দফা প্রকল্পের মেয়াদ পেছানো হয়েছে। তবে এখন জুনের মধ্যে মূল কাজ শেষ হতে পারে। এর পর সৌন্দর্যবর্ধনসহ ছোটখাটো অন্যান্য কাজ করা হবে। প্রকল্পের বাস্তবায়ন বিলম্বতার কারণে এরই মধ্যে কয়েক দফা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রকল্পটির ব্যয়। ২০০৬ সালে ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন প্রকল্পের প্রাথমিক ব্যয় ছিল ২ হাজার ১৬০ কোটি টাকা। ২০১০ সালে তা বাড়িয়ে ২ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা করা হয়। এর পর বিশেষ সংশোধনী আনলে ব্যয় দাঁড়ায় ২ হাজার ৪১০ কোটি টাকা। ২০১৩ সালে সর্বশেষ ব্যয়বৃদ্ধির পর তা দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। অর্থাৎ চার দফায় ব্যয় বেড়েছে ১ হাজার ২২ কোটি টাকা বা ৪৭ শতাংশ। তবে প্রকল্প ব্যয় আরো ৩০০ কোটি টাকা বাড়তে পারে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে দৈনিক ২৫-৩০ হাজার যানচলাচল করে। এর মধ্যে ১০-১২ হাজার শুধু ট্রাক লরি কিংবা কাভার্ডভ্যান রয়েছে। এই সড়কে যানজট যত দীর্ঘ হয় পণ্যের দামও তত বাড়ে। এই সড়ক বন্ধ হওয়া মানে অর্থনীতিতে ধস নেমে আসা। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানজটের কারণে আমদানি-রফতানি পণ্য পরিবহনে বিলম্ব হয়। শিপমেন্ট ঠিক রাখতে বাধ্য হয়ে অনেক সময় আকাশপথে পণ্য পাঠাতে হয়। এতে ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হয় প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। আর যাতায়াতে সময় অপচয়ের কারণে যাত্রীদের ক্ষতি ১ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া যানজটে জ্বালানি অপচয় হয় ২ হাজার কোটি টাকার, পরিবেশগত ক্ষতি ১ হাজার কোটি, স্বাস্থ্যগত ক্ষতি ৩০০ কোটি ও অন্যান্য ক্ষতি ১০০ কোটি টাকা। তাই এই হাজার কোটি টাকার ক্ষতি বাঁচাতে সরকার চার লেন প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করে। এব্যাপারে চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ‘যে সময় চার লেনের সুবিধার কথা চিন্তা করে প্রকল্পটি নেয়া হয়েছিল সে প্রেক্ষাপট এখন নেই। কারণ ৯ বছর পর ব্যবসা বাণিজ্য আরো সম্প্রসারণ হয়েছে। সে হিসেবে এখন চার লেনের গুরুত্ব নেই এখন এটিকে আট লেনে উন্নীতকরণ সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে। তার সাথে সাথে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে। ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সদস্য ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের সাবেক ডিন অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ জাকারিয়া বলেন, ‘মহাসড়কটি অর্থনীতির লাইফলাইন হওয়ায় দ্রুত চার লেনে উন্নীত করা উচিত। তবে এখনো কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। তাছাড়া যানবাহনের চাপ ক্রমে বাড়তে থাকায় চার লেন সম্পন্ন হলেও বেশি দিন এর সুবিধা পাওয়া যাবে না। এজন্য ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে। তখন আড়াই-তিন ঘণ্টায় ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়া যাবে।’পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান মনসুর বলেন, ‘ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করা বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি পদ্মা সেতুর চেয়েও ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন প্রকল্পের গুরুত্ব বেশি। তাই দ্রুত এটি বাস্তবায়ন করা উচিত।’চৌধুরী লোকমান/এসকেডি/আরআইপি

Advertisement