ভ্রমণ

মেদিনী হাওরে এক রাত

এক.

Advertisement

আষাঢ়ি পূর্ণিমা তিথিতে রাতভর হাওরে ভাসবো- বিষয়টি দু’দিন আগেও জানা ছিল না। হঠাৎ করেই ঢাকা শহরের কোলাহল ছেড়ে চলে গেলাম মেদিনী হাওরে। বিস্তীর্ণ হাওরের মাঝখানে ট্রলারে ভাসতে ভাসতে কাটিয়ে দিলাম এক রাত! গান, আড্ডা, ফান আর খাওয়া-দাওয়ার সঙ্গে ছিল ফানুস ওড়ানোর বাড়তি আনন্দ।

মেদিনী হাওর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলা সদরের উত্তর দিকে লঙ্গন নদীর পাড় থেকে শুরু করে হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার সীমানায় গিয়ে শেষ হয়েছে। যেখানে শুষ্ক মৌসুমে থাকে সবুজ আর সোনালি রঙের খেলা। এ হাওরে প্রচুর ধান ফলে। বর্ষাকালে মাইলের পরম মাইল শুধু পানি দেখা যায়। সে এক অপরূপ দৃশ্য। নাসিরনগর ডাকবাংলোর অদূরে হাওরের বুকে দাঁড়িয়ে থাকা পুরনো দোল মন্দিরের ওপর জন্ম নেওয়া অশ্বত্থ গাছটি ইতোমধ্যেই দেশে-বিদেশে পরিচিত হয়ে উঠেছে। বর্ষাকালে দোল মন্দির-অশ্বত্থ দেখে কোনো পর্যটকই মুগ্ধ না হয়ে পারে না। 

হাওরে জোৎস্না উপভোগ ও লোকগান গাওয়ার আমন্ত্রণ এসেছিল ফেসবুক বন্ধু ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের সুমন চৌধুরীর কাছ থেকে। সুমন জানালেন, সেখানকার সংস্কৃতিমনা একদল তরুণ, যারা তার বন্ধু ও পরিচিতজন; মেদিনী হাওরে নৌ-ভ্রমণ, জোৎস্না উদযাপন, ফানুস ওড়ানো, লোকগানের কনসার্ট ও খানাপিনার আয়োজন করেছে। আমি গেলে খুশি হবে। নাসিরনগর ডাকবাংলো ঘাট থেকে সুমন চৌধুরীর তোলা মেদিনী হাওরের একটি ছবিতে আমার কমেন্টের সূত্র ধরে এ আমন্ত্রণ আসে। মফস্বল শহরটির বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি দফতরের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ নাসিরনগরের বাইরের তিন-চার জন অতিথি থাকবেন বলেও জানালেন। এমন সুযোগ কে হাতছাড়া করে বলুন! আমিও লুফে নিলাম। এক মুহূর্ত দেরি না করে জানালাম, ‘আসছি’। 

Advertisement

হাওরে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে শনিবার সকালের ট্রেনেই চলে গেলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজে অধ্যয়নরত আমার বোন লাকীর সঙ্গে দেখা হলো রেল স্টেশনেই। আমার আসার খবর পেয়ে ও অপেক্ষা করছিল। এরপর দুপুর পর্যন্ত কয়েকজন সুহৃদের সঙ্গে আড্ডা হলো। তাদের মধ্যে জেলা শহরটির প্রবীণ সংস্কৃতিকর্মী চমন শিকদার, সাংবাদিক বিশ্বজিত পাল বাবু, রুহুল আমিন সজল, একটি প্রকাশনা সংস্থার কর্মকর্তা সোহেল আহাদ ও যুবলীগ নেতা মো. সোহেলের নাম উল্লেখ না করলেই নয়। 

আমার স্কুল জীবনের বন্ধু হ্যাপী বিশ্বাসের বাসায় দুপুরের খাবার খেতে যেতে হলো। তার স্বামী বীর কুমার চৌধুরী আগেই নিমন্ত্রণ করে রেখেছিলেন। সেখানে খাওয়া-আড্ডা শেষে বিকেল নাগাদ রওয়ানা হলাম নাসিরনগরের উদ্দেশ্যে। আমার অনুরোধে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে হাওর ভ্রমণের সঙ্গী হলেন স্থানীয় সাংবাদিক রুহুল আমিন সজল। 

আমরা যখন নাসিরনগর ডাকবাংলো ঘাটে পৌঁছলাম, ততক্ষণে নৌ-ভ্রমণে অংশগ্রহণকারীরা সেখানে জড় হয়েছেন। ফেরিওয়ালার কাছ থেকে বাদাম কিনে সবাই ট্রলারের ছাদে উঠে বসলাম। ডেকোরেশনের কিছু কাজ তখনো বাকি। তরুণ কর্মী নানা রঙের কাপড়ে দ্রুত ট্রলারটাকে সাজিয়ে যাচ্ছে। মোটা রঙিন কাপড়ের শামিয়ানাও টানানো হলো। প্রায় চল্লিশজনের তরুণ দলটি হৈ-হুল্লোড় করতে করতে ছুটে চললাম হাওরের বুকে। বিশাল মাঝি-মাল্লা, ডেকোরেটরের কর্মী আর জেনারেটর অপারেটরসহ সংখ্যাটা দাঁড়ালো প্রায় পঁয়তাল্লিশে।

ডাকবাংলোর ঘাট থেকে ট্রলার ছুটল সোজা উত্তর-পশ্চিমে। চারিদিকে পানি আর পানি। অনেক দূরে দেখা যাচ্ছে ছোট ছোট গ্রাম। হাওরের পানিতে যেন ভেসে আছে। বিশাল হাওরের বুকে ছোট ছোট ডিঙি নৌকায় জেলেদের মাছ ধরতেও দেখা গেল। নাসিরনগর উপজেলার হাওরবেষ্টিত ইউনিয়ন সদর গোয়ালনগর বাজারে যখন পৌঁছলাম, ততক্ষণে রাত। সেখানে চা পান করে ট্রলারে ফিরতে ফিরতে কনসার্টের সকল আয়োজন শুরু হয়ে গেল। 

Advertisement

শব্দ ব্যবস্থাপনা (সাউন্ড সিস্টেম) সম্পন্ন হতেই উৎসাহী শিল্পীরা গান গাওয়া শুরু করে দিল। তাদের কেউ পেশাদার শিল্পী না হলেও আবেগ, আন্তরিকতা ও জোশে প্রতিটি গানই চমৎকার লেগেছে। বাদ্যশিল্পীরাও চমৎকার বাজিয়েছে। 

গান-ফানের সঙ্গে ট্রলারও ছুটে চলছে। পার্শ্ববর্তী ভলাকুট ইউনিয়নের কান্দিপাড়া, ভলাকুট সদর, কান্দি, নাসিরনগর সদর ইউনিয়নের টেকানগর, নাসিরপুর- এসব গ্রামের পাশ ঘেঁষে লঙ্গন নদী ধরে ট্রলার ফের নাসিরনগর ডাকবাংলো ঘাটে ভিড়ল। তখন রাত প্রায় সাড়ে ৯টা। স্থানীয় এক রেস্টেুরেন্টে অর্ডার দিয়ে রান্না করা বিশেষ খাবারসহ দরকারি জিনিসপত্র ট্রলারে উঠিয়ে আধঘণ্টা পর আবার আমরা ছুটলাম হাওরের পানে। এবার আমাদের সঙ্গে যুক্ত হলেন নতুন গড়ে ওঠা ‘লঙ্গন ব্যান্ডের’ কয়েকজন শিল্পী। 

দুই. 

বিস্তীর্ণ হাওরে বর্ষার পানি ভরপুর। এমনিতেই হাওরে গেলে মন উদাস হয়ে ওঠে। প্রকৃতির উদারতা মানুষের মধ্যেও প্রভাব ফেলে। তার ওপর যদি বর্ষকালের জোৎস্না রাত হয়, ব্যাপারটাই অন্যরকম! আষাঢ়ি পূর্ণিমা তিথি হলেও সেদিন আকাশে মেঘ ছিল। হাওরজুড়ে রাতভর ছিল আবছা আলো। মেদিনী হাওরের সেই দোল মন্দির-অশ্বত্থের কাছে গিয়ে ট্রলার নোঙর করা হলো। জায়গাটা চমৎকার। মাঝে মাঝেই মেঘ সরে গিয়ে পরিপূর্ণ জোৎস্নায় ঝিলিক দিয়ে উঠছিল হাওরের ছোট ছোট ঢেউ। মন উতল করা বাতাসে বাউল-মুর্শিদী-লোকগীতির আসরও জমেছিল বেশ। 

‘কোন মেস্তুরি নাও বানাইছে কেমন দেখা যায়/ ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খী নাও’, ‘হবিগঞ্জের জালালী কইতর, সুনামগঞ্জের কুড়া/ সুরমা নদীর গাঙচিল আমি শূন্যে দিলাম উড়া’, ‘বকুল ফুল, বকুল ফুল’, ‘গ্রামের নও-জওয়ান, হিন্দু মুসলমান/ আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’, ‘আইল রে নওয়া (নয়া) জামাই, আসমানেই তারা/ বিছানা বিছাইয়া দে রে, শাইল ধানের ন্যাড়া/ জামাই বও, জামাই বও’, ‘বন্ধু তোর লাইগা রে, আমার তনু জরজর’, ‘ওই শোনা যায় শ্যামের বাঁশির ধ্বনি লো/ সোনা বন্ধে লইয়া যায় পরাণী’, ‘অসময়ে ধরলাম পাড়ি, পাড়ে যাওয়া বিষম দায়/ ও গুরুধন তরাইয়া নিও গো আমায়’, ‘এই যে দুনিয়া, কিসের লাগিয়া/ এত যত্নে গড়াইয়াছেন সাঁই’, ‘আমার মন মজ রে/ ওরে মন রঙ্গিয়ার চরণে মন মজ’, ‘লোকে বলে, বলে রে/ ঘর-বাড়ি ভালা না আমার’, ‘কী সুন্দর এক গানের পাখি/ মন নিয়া সে খেলা করে’- এমন অনেক লোকগানে হাওরের বাতাস সুরময় হয়ে ওঠে।  

মঈন, সবুজ, মনির, জানু, রাজীব- প্রত্যেকেই চমৎকার চমৎকার গান গেয়েছে। সবার চাপাচাপিতে আমাকেও গাইতে হলো। কিন্তু সারা রাতে কয়েক দফায় আমার মতো অখ্যাত শিল্পীর গাওয়া গানের সংখ্যা যে ১৪-তে গিয়ে ঠেকবে, নৌ-ভ্রমণে যাওয়ার আগে কল্পনাও করিনি। চেষ্টা করেছি জনপ্রিয় দেশের গান আর লোক সংগীত গেয়ে শ্রোতা-দর্শকদের মন ভরাতে। দু’তিনটি আধুনিক গানও ছিল। আয়োজকদের দু’তিনজন গানগুলো ফেসবুকে লাইভ (সরাসরি প্রচার) করায় অনেক বেশি দর্শকের মনোভাবও জানা গেছে! 

উপস্থাপক সবুজ ও সুমনের চাপাচাপিতে অংশগ্রহণকারী প্রায় সবাই গান গাইতে হয়েছে। কেউ কেউ পুরো গান গাইতে না পারলেও অংশবিশেষ হলেও গেয়েছেন। নাসিরনগর উপজেলা সহকারী শিক্ষা অফিসার রবিউল ইসলাম, সোনালী ব্যাংকের ফান্দাউক শাখার ম্যানেজার অমিতাভ দাস, ব্যাংকের ওই শাখার কর্মকর্তা আসাদ, নাসিরনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সেনিটারি ইন্সপেক্টর মো. জামাল আহমেদ, থানার এএসআই বাবুল মিয়া, উপজেলা আনসার বিডিবি কর্মকর্তা নূরুজ্জামান মুন্না- প্রত্যেকেই গান গেয়ে অংশগ্রহণকারীদের আনন্দ দিয়েছেন। 

আয়োজনের উস্কানিদাতা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মুমিনুল হক ক্যানভাসারের ভূমিকায় অভিনয় করেই সবার মন ভড়িয়ে দিয়েছেন। বিশেষ করে তার আমন্ত্রণেই সুদূর রাজবাড়ী জেলা থেকে এসে নৌ-ভ্রমণে যোগ দিয়েছিলেন উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা ফারুক হোসেন এবং কুমিল্লা থেকে এসে যোগ দিয়েছিলেন উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোসলেহ উদ্দিন। 

স্থানীয় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ছিলেন স্কুলশিক্ষক সবুজ দাস, আশীষ দেব, নাজমুল হুদা, ইউপি সচিব রাজীব গোপ, বায়িং হাউজ কর্মকর্তা অজিত সুত্রধর, ব্যবসায়ী মঈন, সেলিম মিয়া, আশীষ চৌধুরী, মোশাররফ, রাহাত, মিঠুন, রাজীব, কলেজছাত্র অনুপ, অরূপ, গ্রামীণফোনের স্থানীয় কর্মী মনির, নিউটন। খোকন, সাজ্জাদ, জিয়া, গগন, রতন, অনুপ, শতদল, অজিত প্রমুখ গানের তালে তালে নেচেছেন। 

গানের ফাঁকে রাজহাঁসের মাংসের ঝাল তরকারি, চিংড়ি মাছ ভুনা ও ডিম ভুনা দিয়ে দীর্ঘদিন মনে রাখার মতো রাতের খাবার খেয়েছি আমরা। এই একদিনের খাবার রান্না করেই নাম করে ফেলেছে স্থানীয় বাজারের ‘কলাপাতা রেস্টুরেন্ট’। অবশ্য রান্নার জন্য রাজহাঁস আয়োজকরাই সরবরাহ করেছে। হাওরের ভেতর অনেক দূরের গ্রাম ‘নওয়াগাও’ থেকে রাজহাঁস এনে দিয়েছেন স্কুলশিক্ষক সবুজ। রাতভর ছিল ঝালমুড়ি ও চকলেট পার্টি। 

মাঝরাতে চাঁদমামা মেঘের আড়ালে চলে যাওয়ার পর আকাশে ওড়ানো হয়েছে ফানুস। হাওরে বাতাস থাকায় যদিও সবগুলো ফানুস ঠিকমত ওড়ানো যায়নি। সুমন চৌধুরী ও তার বন্ধুদের জোর চেষ্টায় যে কয়টা ফানুস ওড়ানো গেছে, তাতেই সবাই খুব খুশি হয়েছে। অন্ধকার আকাশে বাতাসের ঠেলায় দ্রুত গতিতে আলোকিত ফানুস উড়ে যাওয়ার সময় সবার হাততালির শব্দ এখনো যেন কানে বাজছে।  

স্মরণীয় একটি নৌ-ভ্রমণ শেষে আমরা যখন ডাকবাংলোর ঘাটে ফিরছিলাম, তখন ফজরের আজান হচ্ছিল। অর্থাৎ ভোর হয়ে গেছে! আমাদের ঘোর তখনো কাটেনি। একটা রাত হাওরের পানিতে কাটিয়ে দিলাম! হাওরে নৌ-ভ্রমণ ও রাতযাপনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল জোৎস্না দেখা, সে আশা শতভাগ পূরণ হয়নি। আকাশে মেঘ ছিল। একটু পরপরই কালো মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ছিল সোনালি চাঁদ। অবশ্য জোৎস্না উপভোগ করতে না পারার অতৃপ্তি ঘুচিয়ে দিয়েছে মন উতল করা শীতল দখিনা বাতাস আর হাওরের মৃদু ঢেউ।

মেদিনী হাওরের সেই রাতের কথা অনেক অনেক দিন মনে থাকবে। দেশের অন্যান্য হাওরঘেঁষা এলাকায় বন্যা চলছে। মেদিনী হাওরঘেঁষা গ্রামগুলোতে এখনো এমনটা হয়নি। তবুও এই নৌ-ভ্রমণে এসে বন্যাদুর্গত হাওরবাসীর কথা মাঝে মাঝেই মনে পড়ছিল। 

এসইউ/পিআর