ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। ১৯৯৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে স্নাতক পাস করেন। ২০০১ সালে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সদস্য পদ লাভ করেন। পরবর্তীতে ইংল্যান্ডের নর্দামব্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুনরায় আইনে স্নাতক ডিগ্রি এবং ২০০৯ সালে অস্ট্রেলিয়া থেকে ‘ব্যারিস্টার অ্যাট-ল’ সম্পন্ন করেন। ২০০৯ সালে তিনি ‘নিউ সাউথ ওয়েলস সুপ্রিম কোর্ট’ বারের সদস্য হন।
Advertisement
আইন পেশার পাশাপাশি তিনি একজন মানবাধিকারকর্মী ও ফেমিনিস্ট অ্যাকটিভিস্ট (নারীবাদীকর্মী)। গবেষণা করছেন সমতলের আদিবাসীদের ভূমি অধিকার নিয়েও।
তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের ৫৭ ধারা এবং সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। দুই পর্বের ধারাবাহিকের শেষটি আজ প্রকাশিত হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।
জাগো নিউজ : ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দিল আদালত। এ নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে সংসদের ভেতরে ও বাইরে। এ বিষয়ে আপনার বিশ্লেষণ কী?
Advertisement
ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া : ষোড়শ সংশোধনীর মামলাটিতে আদালতের সহায়ক হিসেবে যারা এমিকাস কিউরি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন, তাদের বেশ কয়েকজনের বক্তব্য শোনার সুযোগ হয়েছিল। তাদের যুক্তিতর্ক শুনেছি।
পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ পেলেই বোঝা যাবে আসলে বিচারপতিরা কী ব্যাখ্যা দিয়েছেন? নাগরিকরা এক দৃষ্টিকোণ থেকে এ রায়কে বিশ্লেষণ করছেন আর আমরা পেশাদার আইনজীবীরা অন্য এক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করছি।
জাগো নিউজ : রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার মালিক জনগণ। সংবিধানেরও…
ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া : হ্যাঁ। জনগণই সকল ক্ষমতার মালিক। কিন্তু জনগণ তো সরাসরি ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন না। তারা প্রতিনিধি নির্বাচন করে ক্ষমতার প্রয়োগ করতে পারেন। কিন্তু এসবই এখন কিতাবি ব্যাপার। জনগণ আসলে কতটুকু ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে, তা ভাবনার বিষয়।
Advertisement
আমরা কথায় কথায় সংবিধান সামনে এনে থাকি। কিন্তু সংবিধানের দুর্বলতা নিয়ে কথা বলি না। সংবিধান কোনো বাইবেল নয় যে, পরিবর্তন হবে না। ১৬বার তো পরিবর্তন হলো। অসংখ্যবার পরিবর্তন হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান। সময় ও বাস্তবতার নিরিখে পরিবর্তন হতেই পারে।
ক্ষমতা পোক্ত করতে সংবিধান পরিবর্তনে যতটুকু গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, জনগণের ক্ষমতার প্রশ্নে সেই গুরুত্ব পায়নি।
জাগো নিউজ : রায়ে কি জনগণের ক্ষমতার গুরুত্ব পেয়েছে? কিতাবি বিষয় হলেও সংবিধান জনগণের, সংসদ জনগণের।
ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া : সংসদের ক্ষমতা, জনগুরুত্ব আমরা দেখতে পাচ্ছি। প্রধান বিচারপতি ক্রমাগতভাবে বলে যাচ্ছেন, ‘সরকার নানাভাবে বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ করছে। নিম্ন আদালতগুলো পুরোটাই সরকার দখলে নিয়েছে। সরকার উচ্চ আদালতকেও দখলে নিতে চায়।’ প্রধান বিচারপতির এমন বক্তব্য গণমাধ্যমেও পরিষ্কারভাবে প্রকাশ পেয়েছে।
প্রধান বিচারপতির এ বক্তব্য তো বায়বীয় নয়। গণমাধ্যমেও বিচার বিভাগের নানা বিষয় গুরুত্ব পাচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা যদি সংসদের হাতে চলে যেত, তাহলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সামাল দেয়া আসলে কঠিন হয়ে যেত। দ্বিচারিতা তো আমাদের মধ্যে আছেই।
জাগো নিউজ : যেমন...
ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া : আমাদের সংসদ সদস্যরা অনেকেই কিন্তু আইনজীবী। তারা সংসদে বসছেন। আবার আদালতেও মামলার পক্ষে লড়ছেন। তারা যদি বিচারপতিদের বিচারক হন, তাহলে তারা আদালতে এসে অধস্তনদের কাছে বিচার প্রত্যাশা করতেন কীভাবে? বিষয়গুলো নিয়ে কিন্তু কথা বলা হয় না।
জাগো নিউজ : দ্বৈত সত্তা থাকতেই পারে। সংসদ সদস্য হলেও আদালতে এসে তিনি আইনজীবী হিসেবে লড়ছেন। সংসদ সদস্য হিসেবে নয়।
ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া : এটিও কিতাবি কথা। আমি যদি জানি আপনি আমাকে অপসারণ করার ক্ষমতা রাখেন, তাহলে আপনার সকল কাজে ‘জি হুজুর’ বলা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় থাকবে না। কিতাবি ব্যাখ্যা দিয়ে তো সমাজ চলে না। আপনাকে প্রায়োগিক প্রেক্ষাপট মূল্যায়ন করতে হবে।
রাষ্ট্রের স্তম্ভগুলো নিয়ে কথা বলতে হলে সংবিধানকে ধ্রুব হিসেবে মানা হয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে সংবিধান হচ্ছে সামাজিক চুক্তি। যে কোনো পরিস্থিতিতে এ চুক্তির পরিবর্তন হতেই পারে।
জাগো নিউজ : কিন্তু পরিস্থিতি বুঝে জোড়াতালির সমাধান দিয়ে সংবিধানের ক্ষমতা দুর্বল করে দেয়া হচ্ছে কি না?
ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া : বিষয়টি ঠিক তা নয়। রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগই সংবিধান দ্বারা পরিচালিত হওয়ার কথা।
অনেকেই মনে করেন, আইন বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগ মিলেমিশে কাজ করবে। আমি কিন্তু এমনটি মনে করি না। আমি মনে করি, একটি অপরটির পিছে লেগে থেকে চেক অ্যান্ড ব্যালান্স নীতি অনুসরণ করবে।
যদি শাসন বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগ ব্যর্থ হয়, তাহলে বিচার বিভাগ দেখবে। বিচার বিভাগের সমস্যা আইন প্রণেতারা দেখবেন।
আইন মানেই সংসদ কর্তৃক প্রণীত কোনো বিধান নয়। আইন হচ্ছে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা, ঐতিহ্য, প্রথা, নীতির ব্যবহার থেকে সৃষ্টি। বিচার বিভাগ আইন বিভাগের ওপর কতটুকু হস্তক্ষেপ করে তারও একটি দীর্ঘ ইতিহাস আছে। আদৌ করছে কি না- সেটাও দেখতে হবে? সুতরাং এ রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে আইনপ্রণেতাদের যে প্রতিক্রিয়া, তা কিন্তু বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় ‘প্রশ্নের’ জন্ম দেয়।
জাগো নিউজ : কিন্তু সরকারের লোকেরা তো বলতে চাইছেন, এ রায় ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফেরার পথ রুদ্ধ করে দিল।
ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া : ’৭২- এর সংবিধান নিয়ে নাগরিকের মধ্যে কতগুলো ধারণার জন্ম দেয়া হয়েছে, যা পুরোপুরি রাজনৈতিক। বলা হয়, ’৭২- এর সংবিধানে ফিরে গেলে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। সাংবিধানিক আর কোনো সংকট থাকবে না- এটি প্রগতিশীল সংগঠনগুলো বলে, আওয়ামী লীগও বলে। এ বলাটা রাজনীতির জন্য বলা।
যারা ওই সময়ে সংবিধান প্রণয়নে ছিলেন, তারা বিভিন্ন সময় সংবিধানের দুর্বলতা নিয়ে মন্তব্য করেছেন, সাক্ষাৎকারও দিয়েছেন। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের আপত্তি জানিয়ে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ওয়াকআউট করেছিলেন। বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করার সরাসরি নির্দেশনা দেয়া হলো না। অতএব ’৭২- এর সংবিধান নিয়ে তো এমন অনেক বিতর্ক ছিল-ই।
’৭২- এর সংবিধান বাইবেল নয়, পরিবর্তন হতেই পারে। সংবিধান গুটিকয়েক মানুষ বুঝবে- এটি নয়। সংবিধানের মালিক জনগণ। জনগণ যদি সংবিধান সহজে না বোঝেন, তাহলে মনে করতে হবে এখানে ত্রুটি আছে। জনগণকে বোঝাতে সংবিধান হাজারবার পরিবর্তন হতে পারে।
সাধারণ মানুষের কী অধিকার, নাগরিক হিসেবে তার কী দায়িত্ব রয়েছে- তা সংবিধান পড়ে সহজেই বুঝতে পারবে।
ব্যাপারটি এমন দাঁড়িয়েছে যে, ১৯৭২ সালের পর থেকে সংবিধান এলিটদের জন্য কাজ করছে, এখনও তাই করছে। স্বাধীনতার জন্য যারা বেশি ত্যাগ স্বীকার করছেন, তাদের প্রতিনিধিত্ব এ সংবিধান করেনি।
জাগো নিউজ : কেন এমন মনে করছেন?
ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া : ‘রাষ্ট্রের সমস্ত ক্ষমতার মালিক হচ্ছেন জনগণ’- এই একটি লাইন লিখে দিয়েই পার। সত্যিকার অর্থে সাধারণ মানুষের ক্ষমতায়নে সংবিধান কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি।
জাগো নিউজ : নির্বাচন, ভোটাধিকার প্রয়োগে তো সাধারণ মানুষ অংশ নিচ্ছে…
ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া : নির্বাচন সুষ্ঠু হলেও সাধারণ মানুষ তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে না। ১৯৭২ সালের সংবিধান রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধনের ক্ষেত্রে এমন কিছু কিছু বিধানের কথা বলে দিয়েছে যে, কেউ চাইলেই নির্বাচন করতে পারেন না। রাজনৈতিক দল গঠন করে নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন না। সরাসরি না করা হয়নি সংবিধানে। কিন্তু এমন শর্ত জুড়ে দেয়া আছে, যা সাধারণের পক্ষে পূরণ করা সম্ভব না। সংবিধান-ই কৌশলী অবস্থান তৈরি করে দিয়েছে রাজনৈতিক এলিটদের জন্য। এ কারণেই মন্দের ভালো মন্দকেই নির্বাচিত করতে বাধ্য হচ্ছেন জনগণ।
জাগো নিউজ : টানাপোড়েন তো সব জায়গাতেই। একটি অধিকার পেলেই কি বিচার বিভাগ স্বাধীন হয়ে যাবে? স্বেচ্ছাচারিতা বিচার বিভাগেও হতে পারে?
ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া : এ আলোচনা আমাদের আইনজীবীদের মধ্যেও হচ্ছে। মুখে বলে দিলেই তো স্বাধীনতা ভোগ করা যায় না।
আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। আসলে কী হচ্ছে এবং বিচার বিভাগ স্বেচ্ছাচারিতা থেকে বের হয়ে আসতে পারবে কি না- তা সময়ই বলে দেবে। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান তো স্থগিত ছিল। এখন আবার চালু করতে গেলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করলেই সব সমাধান হবে কি না? কারণ এ কাউন্সিল আগেও ছিল। বিচারপতিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকার পরও সুপ্রিম কাউন্সিলকে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। বিচারপতিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার সুযোগও তৈরি হয়নি।
এ-জন্যই আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া আপাতত সমালোচনা করা ঠিক হবে না বলে মনে করি।
জাগো নিউজ : এ বিতর্ক কোথায় গিয়ে ঠেকতে পারে বলে মনে করেন?
ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া : রাষ্ট্রপক্ষ রিভিউ করতে পারেন। এর বাইরে আর কোনো সুযোগ আছে বলে মনে করি না। তবে রিভিউ করে আসলে রায়ের পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না।
পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ পেলেই সব বোঝা যাবে। কিছু নির্দেশনা থাকবে বলেও মনে হয়।
এএসএস/এমএআর/এইচআর/পিআর